সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে মঠতন্ত্রের প্রভাব কি ছিল তা আলোচনা কর।

admin

 

ভূমিকা : মধ্যযুগে ইউরোপের ইতিহাসে মঠতন্ত্র একটি আলোচিত বিষয় ছিল। খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারও প্রসারে যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিশেষ অবদান রাখে তার মধ্যে মঠতন্ত্র ছিল অন্যতম। আর এ মঠকে কেন্দ্র করে মঠে বসবাসকারী সন্ন্যাসীদের জীবনাচারণ মঠতন্ত্র নামে পরিচিত। ধর্মীয় কার্য সাধন ছাড়াও মধ্যযুগে মঠের নানাবিধ কার্য পালনীয় ছিল, যে কারণে সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে মঠতন্ত্রের প্রভাব ছিল সুদুর প্রসারী।


সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে মঠতন্ত্রের প্রভাব কি ছিল তা আলোচনা কর।


 মঠতন্ত্রের প্রভাব : সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে মঠতন্ত্রের প্রভাব নিম্নে উল্লেখ করা হলো :


১. নিয়মানুবর্তিতা : মঠ জীবন ছিল খুবই কষ্টের। সেন্ট বেসিল ও বেনিডিক্ট প্রবর্তিত সন্ন্যাস জীবনের বিধি ও নিয়ম কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হতো। প্রতিজ্ঞা পালনে ব্যর্থ হলে অথবা সন্ন্যাসজীবনে বিধি-বিধান পালনে ব্যর্থ হলে তাকে মঠ থেকে বের করে দেওয়া হতো। মঠ জীবনের নিয়ম-শৃঙ্খলা পালনের দায়িত্ব পালন করতেন মঠের অধ্যক্ষ, সন্ন্যাসীদের নিকট তিনিই ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। এর ফলে মঠ জীবনে অত্যন্ত কঠোর নিয়মানুবর্তিতা গড়ে ওঠে।


২. প্রার্থনা ও একাগ্রতা সৃষ্টি : মঠ জীবনের অধিকাংশ সময় সন্ন্যাসীদেরকে প্রার্থনায় নিমগ্ন থাকতে হতো। সাধু বেনিডিক্ট ছিলেন দক্ষিণ ইতালির মন্টেক্যাসিলো নামক সংঘের প্রধান। এ সংঘের সন্ন্যাসীদেরকে তিনি সাধারণ প্রার্থনার পাশাপাশি প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত আত্ম মগ্নতার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর এই নির্দেশ পরবর্তী সময়ে অন্যান্য মঠেও পালন করা হতো। ফলে মঠগুলো কুসংস্কার মুক্ত প্রকৃত ধর্ম চর্চা শুরু হয়।


৩. দৈহিক পরিশ্রমের মর্যাদা দান : মঠ জীবনে দৈহিক পরিশ্রমকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। পরিশ্রমকে প্রার্থনার অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। তাই মঠ সন্ন্যাসীদেরকে তাদের নিজের খাদ্য নিজেকেই উৎপাদন করতে হতো। এছাড়া বস্ত্র বুনন, পরিষ্কার করা, ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখাসহ ইত্যাদি কাজ নিজ হাতে সন্ন্যাসীদের সম্পাদন করতে হতো। মঠের জমিতে তারা চাষাবাদ করে ফসল ফলাত।


৪. আর্তমানবতার সেবা : দৈহিক পরিশ্রমের অংশ হিসেবে সন্ন্যাসীদেরকে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হতো। অনাথকে আশ্রয় দান, অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করা ও পরিচর্যা, অসহায়, বৃদ্ধ, দুঃস্থকে সাহায্য করা ইত্যাদি নিয়ম কঠোরভাবে পালন করতে হতো। মধ্যযুগের প্রথম দিকে মঠগুলো ছিল অসহায় ও দুঃস্থ মানুষে শেষ ভরসা স্থল।


৫. অর্থনৈতিক গতি সঞ্চার : অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার, নতুন পদ্ধতির দ্বারা মঠবাসীরা পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতির জীবনে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিল। প্রথম দিকে মঠগুলো অল্প পরিসরে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু কালক্রমে তা বিশাল বড় বড় ভূ-খণ্ডের মালিক হয়। যেহেতু মঠে সন্ন্যাসদের নিজের খাদ্য নিজের উৎপাদন করতে হতো তাই উৎপাদন বেড়ে যায়। এতে সন্ন্যাসদের কায়িক শ্রম নিবেদিত হওয়ায় এটি সমাজের একটি শ্রমশক্তিতে পরিণত হয়।


৬. কৃষি কাজে অবদান : মধ্যযুগে মঠের সন্ন্যাসীরা কৃষিকাজে যথেষ্ট অবদান রাখে। পতিত জমিতে আবাদ, উন্নত বীজ সংগ্রহ, জলাভূমি হতে পানিসেচ ও নিষ্কাষণ এবং জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য তারা নানা প্রকার উপায় অবলম্বন করে। একমাত্র তাদের চেষ্টার ফলে ইউরোপের অনেক পতিত জমি শষ্য জমিতে পরিণত হয়। যাতে অন্যান্যরাও উৎসাহিত হয়।


৭. জ্ঞান চর্চা : জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান দান করা মঠ সন্ন্যাসীদের অবশ্যই পালনীয় কর্ম হিসেবে বিবেচিত ছিল। তাই মধ্যযুগে সন্ন্যাসীরা ধর্ম চর্চা, বিদ্যা চর্চাকে অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখত। মঠকেন্দ্রিক জ্ঞান চর্চা বা মঠের বাইরেও কিছু স্কুল স্থাপন করেছিল। শুধু তাই নয় বিদ্যাচর্চা করতে গিয়ে সন্ন্যাসগণ প্রাচীন অনেক দলিলপত্র ও গ্রন্থের অনুলিপি তৈরি করেন- যা মধ্যযুগের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিনের ধর্মীয় কর্তব্য পালন ও ধর্মজ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসীরা প্রতিদিন ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও এসব গ্রন্থের অনুলিপিও সংরক্ষণ করতেন।


৮. শিল্প ও স্থাপত্যে প্রভাব : সন্ন্যাসীরা কঠোর পরিশ্রমী ছিলো। তারা তাদের পরিশ্রমের অংশ হিসেবে মঠের আশপাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল বয়ন, চর্ম ও নির্মাণ এবং কৃষিজাত শিল্প। সন্ন্যাসীরা কতগুলো অট্টালিকা তৈরি করে তা সংরক্ষণ করে যেগুলোকে রোমানদের নৈপূণতা প্রদর্শিত হয়। তারা চিত্রকল্প বিশেষ করে কাঠের উপর খোদাই করা, ধাতুর উপর বিভিন্ন শিল্প কর্ম, কাপড় বুনন ও অলংকার তৈরি এবং অঙ্কনে পারদর্শিতা অর্জন করে। তাই কারো কারো মতে মধ্যযুগে মঠকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল।


৯. খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার ও প্রসার : মঠের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল ধর্মের বাণী প্রচার করা। গীর্জার পাশাপাশি মঠসমূহ খ্রিস্টধর্ম প্রচারে ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রাখে। মঠ সন্ন্যাসীদের বড় ভূমিকা হচ্ছে জার্মান বর্বর উপজাতিকে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করা। এতে একই সাথে ধর্মের প্রসার বাড়বে অন্যদিকে রোম আক্রমণ রোধ করা যাবে। এজন্য যুগে যুগে বহু মহান পোপ বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছিল


১০. পোপতন্ত্রের অভ্যুদয় : সন্ন্যাসবাদের বিকাশ চার্চের ইতিহাসকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারের সাথে সাথে পোপ তার অবস্থানকে দৃঢ় করে। পোপতন্ত্রের অভ্যুদ্বয়ের পথ সুগম করে। যদিও আশ্রমগুলো অনেক সময় একে অপরে বিবাধে জড়িয়ে পড়ত কিন্তু চার্চের কর্তৃত্বের প্রতি তারা সব সময় আনুগত্য প্রকাশ করত । ফলে পোপতন্ত্র বিকাশে বাধা হয়নি।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে উদ্ভব ও বিকাশ লাভে মঠতন্ত্রের প্রভাব ছিলো অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন ধর্মের প্রচার ও প্রসার হয়েছে অন্যদিকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রসিদ্ধি অর্জিত হয়েছে। মঠ জীবনে সন্ন্যাসরা কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলায় সমাজ থেকে অবক্ষয়তার চিত্র দূর করা সম্ভব হয়েছে । অনৈতিকতার জায়গায় নৈতিকতা স্থাপিত হয়েছে। সন্ন্যাস ও শিষ্যরা পাপ মোচনের পথ খুঁজে পেয়েছে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!