ম্যানর প্রথার সংজ্ঞা : ম্যানর প্রথা হচ্ছে সামন্তবাদ বা সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজের একটি অর্থনৈতিক সংগঠন। অর্থাৎ মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক কৃষিভিত্তিক সমাজে ম্যানর ছিল একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এ প্রথাকে সামন্ত তান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মূলতঃ সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠানিক ভিত্তি। ম্যানর প্রথা এমনই একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা যা বিকাশিত হয়েছিল গ্রামের ম্যানরকে কেন্দ্র করে। সামন্ত যুগে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ছিলো গ্রামীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এ স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীন অর্থনীতিতে ম্যানর প্রথা ছিল এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা যেখানে কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে পশু পালন, কাপড় বুনন, মাছ চাষ, মুরগি পালন, খাদ্য উৎপাদনসহ জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সব কিছু উৎপন্ন হতো। ম্যানূর প্রথা নিয়ন্ত্রণ করতো ম্যানরের কৃষি ব্যবস্থা, সার্ফদের জীবনযাত্রা এবং লর্ডসহ তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক। কাজেই বলা যায় উৎপাদন ব্যবস্থাকে অব্যহত রাখার জন্য সমাজের নিম্ন স্তরের প্রকৃ ও তার অধীনস্ত প্রজার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে সামন্ত প্রথার কাঠামোর মধ্যে যে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিল তাই ম্যানর প্রথা নামে পরিচিত। ম্যানর প্রথার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিলেন লর্ড।
কিভাবে সুইপার সোশ্যাল ( Swiper social) যুক্ত হয়ে টাকা ইনকাম করবেন?
ম্যানর প্রথার উৎপত্তি ও গঠন প্রকৃতি :
মধ্যযুগে ইউরোপের ইতিহাসে ম্যানর প্রথা গঠন ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। নিম্নে ম্যানর প্রথার গঠন ও আয়তন উল্লেখ করা হলো :
১. ম্যানর প্রথা গঠনের ইতিহাস : ভ্যাসাল বা সামন্তগণ তার প্রভু বা লর্ড থেকে বেতনের পরিবর্তে কিংবা সেনাবাহিনী পরিচালনার জন্য যে জমি পেতেন তাকে বলা হতো ফিফ (fief)। ফিফ গুলো গঠিত হতো এক বা একাধিক জমিদার বা তালুক নিয়ে। এ রকম এক বা একাধিক ফিফ নিয়ে গঠিত হতো একটি ম্যানর। ফিফ ছিলো ভূমির একটি রাজনৈতিক একক আর ম্যানর ছিল ফিফের উপর উৎপাদনের মূল একক অর্থাৎ ম্যানর ছিল একটি অর্থনৈতিক একক।
২. গ্রাম কেন্দ্রিক ম্যানর প্রথা গঠন : গ্রামকে কেন্দ্র করেই মূলত এক একটি ম্যানর প্রথা গড়ে ওঠে। অর্থাৎ ম্যানর প্রথার মূল একক ছিলো গ্রাম। গ্রামকে কেন্দ্র করে ৪৭৬ খ্রিস্টের পরবর্তী সময়ে ম্যানর প্রথা গড়ে ওঠে। যা ছিল সামন্ত বাদের একটি অর্থনৈতিক কাঠামো বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অর্থাৎ মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে কৃষিভিত্তিক গ্রামকেন্দ্রিক ম্যানর ছিল একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
৩. কৃষিভিত্তিক ম্যানর প্রথা গঠন : ম্যানর প্রথার মূল কেন্দ্রবিন্দুই ছিল কৃষক। কৃষিভিত্তিক এ প্রথাকে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার অত্যাবশকীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলতঃ সামন্ততান্ত্রিক ভূমি ও কৃষিব্যবস্থায় ভূস্বামী কর্তৃক যে উৎপাদন কাঠামো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হয় তার মাধ্যমেই ম্যানর প্রথা গড়ে ওঠে।
৪. অর্থনৈতিক কাঠামো ভিত্তিক ম্যানর প্রথা গঠন : মধ্যযুগে সামন্ত সমাজে ম্যানর প্রথা অর্থনৈতিক কাঠামোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। ম্যানর প্রথা হলো সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজের একটি অর্থনৈতিক সংগঠন মূলতঃ মধ্যযুগে ম্যানর প্রথা ছিল উৎপাদনমুলকঃ অর্থনৈতিক সংগঠন।
৫. কৃষক শোষণে ম্যানর প্রথা গঠন : ম্যানর প্রথার মূল কেন্দ্র বিন্দু ছিল লর্ড। ম্যানর অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাশাপাশি মানুষের, সামাজিক, রাজনৈতিক নিরাপত্তার জন্য গড়ে ওঠে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল ভিন্ন। কাল মার্কস মনে করেন ম্যানরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হচ্ছে স্বাধীনতাহীন শ্রমজীবী মানুষের দ্বারা বড় বড় ভূসম্পতিতে কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্য সামগ্রি উৎপন্ন করতে গড়ে ওঠে।
৬. ক্ষুদ্র ম্যানরের আয়তন : ম্যানর প্রথার আকার গঠন প্রকৃতির ভিত্তিতে এর আয়তন নির্বাচন করা হতো। সবচেয়ে ছোট ম্যানরের আয়তন ছিল ৩০০ একর এবং এর অন্তর্ভুক্ত পরিবার ছিল ১২-১৫ টি। এ জন্য প্রতিটি পরিবারের জন্য ৩০ একর পর্যন্ত জমি বরাদ্ধ দেওয়া হতো। পরিবারের সব সদস্য জমি চাষাবাদ করতেন। এ সমস্ত জমি থেকে উৎপন্ন ফসলের বিশেষ অংশ শর্ত সাপেক্ষে লর্ড বা সামন্ত প্রভুকে দান করতে হতো।
৭. বৃহৎ ম্যানরের আয়তন : সামন্ত সমাজে ম্যানরের মধ্যে বড় বা বৃহৎ ম্যানরের আয়তন ছিল সর্বোচ্চ ৫০০০ একর জমি পর্যন্ত। অর্থাৎ বিভিন্ন অবস্থান ভেদে ম্যানরের আয়তন ছিল বিভিন্ন রকম। ম্যানরগুলোর যে আয়তন তাজে চারণভূমি,ঘাসভূমি, বন, পতিত জমি ও লর্ডদের বাসভূমি বাদ ছিল। শুধুমাত্র চাষযোগ্য জমিগুলো বৃহৎ ম্যানরদের মধ্যে বরাদ্ধ দেওয়া হতো।
৮. বৃহৎ ম্যানরের পরিবারের আকার : বৃহৎ ম্যানরের আয়তন বেশি হওয়ায় পরিবারের আয়তন ও আকার বড় ছিল। একটি বড় ধরনের ম্যানরের অন্তঃ ৫০ টি পরিবার বাস করতে পারতো। পরিবারের আকার ও সদস্যনুযায়ী তাদের মধ্যে জমি বরাদ্ধ দেওয়া হতো। ক্ষুদ্র ম্যানরের ন্যায় বৃহৎ ম্যানরের পরিবারের উৎপাদিত ফসলের সিংহভাগ লর্ডকে প্রদান করতে হতো ।
৯. শতাধিক ম্যানর মালিক : ম্যানর প্রথাকে “ভূমিহীন লর্ড নেই” ও লর্ডহীন ভূমি নেই” এই ধারণাটি সামস্ত সমাজে ম্যানর প্রথার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে প্রজোয্য ছিল। রাজা ও মাঠগুলির অধীনে প্রায় শতাধিক ম্যানর ছিল। অভিজাতদের মধ্যে সামাজিক স্তরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে একজন নাইটও কমপক্ষে একটি ম্যানরের মালিক ছিলেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ম্যানর প্রথা ছিল মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষিভিত্তিক ও গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক সংগঠন। ম্যানর প্রথা দ্বারা ম্যানরের মধ্যে কেন্দ্রিভুত অর্থনৈতিক, সামাজিক কার্যকলাপকে বোঝাত। ম্যানর প্রথায় মূল একক ছিল ফিফ, এক বা একাধিক ফিফ নিয়ে গড়ে উঠত এক একটি ম্যানর। জমির আকার অনুযায়ী ম্যানর পরিবার নির্ধারিত হতো। কাজেই বলা যায় ম্যানর প্রথা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ।