ভূমিকা : মধ্যযুগের সামন্ত প্রথা বলতে আমরা বুঝি এমন কতগুলো বিধি, নিয়ম, প্রথা ও ব্যবস্থার সমষ্টি যেখানে শক্তিশালী মানুষ অধীনস্তদের উপর আধিপত্য বিস্তার করত। আর দুর্বলেরা সহ্য করত শক্তিশালী ভূস্বামীদের নির্মম নির্যাতন, অত্যাচার ও অবহেলা। সামন্ত সমাজে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন রাজা নিজে। সমস্ত জমিই ছিল তার অধীনে। কিন্তু রাজা তার পছন্দমত জমিগুলো অধিনস্ত ভূস্বামীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। এদিক থেকে ব্যাপক ক্ষমতার মালিক হন সামন্ত প্রভুরা। ফলে তারা নির্বিধায় কৃষকের উপর নির্যাতন করত। ফলে সামন্ত সমাজের কুফলও ছিল বিস্তৃত।
সামন্ত প্রথার কুফল : মধ্যযুগে ইউরোপের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো সামন্ত প্রথা। নিম্নে মধ্যযুগের সামন্ত প্রথার কুফলগুলো আলোচনা করা হলো :
১. রাজাকে দুর্বল করে দেয় : একটা রাজ্যের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় প্রধান যার নেতৃত্বে থাকে রাজা নিজে। কিন্তু সাসন্ত প্রথা রাজা তথা কেন্দ্রীয় শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। লর্ডদের মধ্যে ক্ষমতা বিভাজন হওয়ায় রাজার প্রত্যক্ষ ক্ষমতা বিনষ্ট হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তার অবস্থিতি থাকে অপ্রত্যক্ষভাবে। সামন্ত প্রভুরা নিজস্ব শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। যা দ্বারা তারা রাজার কর্তৃত্বকেও চ্যালেঞ্জ করতো। এমনকি সামন্ত শর্তানুযায়ী লর্ড বা ব্যারনদের রাজা কোনো কিছু করতে বাধ্য করতে পারতেন না। ফলে রাজা ক্রমশ দুর্বল হয়ে যায়।
২. সামন্ত প্রভু বা লর্ডদের আধিপত্য : সামস্ত প্রথা সামন্ত প্রভুদের একচ্ছত্র আধিপত্য দান করেছিল। ম্যানর ছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক একক। যা লর্ড রাজার নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই পরিচালনা করতেন। লর্ডদের আচরণ এমন ছিল যে, তারাই হচ্ছেন স্বাধীন শাসক। এর ফলে তাদের আধিপত্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। প্রত্যক্ষ শাসন ক্ষমতার ভার সামন্ত প্রভুরা গ্রহণ না করলেও তারাই ছিল এ যুগের ক্ষমতার প্রধান নিয়ামক শক্তি। সামন্ত প্রভুদের ইচ্ছার বাইরে রাজা কর্তৃক কোনো যুদ্ধ ঘোষণাও সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ সামন্ত প্রভুদের আধিপত্য শুধু কৃষকের উপরই বহাল ছিল না রাজাও সামন্ত প্রভুদের অনেকটা আজ্ঞাবহ ছিল।
৩. যুদ্ধ বিগ্রহ : গ্রহক পক্ষে সামন্ত যুগ ছিল শান্তির অন্তরায়। সামন্ততন্ত্রের শর্তানুযায়ী লর্ড বা ব্যারণ শান্তি শূঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় রাজাকে সাহায্য সহযোগিতা করবে এবং রাজা যখন যা নির্দেশ দিবেন তা পালন করবেন ও সৈন্য পাঠাবেন। কিন্তু অধিকাংশ লর্ডই বা ব্যারণগণ নিজের ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখতে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকতেন। এমনকি ক্ষেত্রে বিশেষ কয়েকটি লর্ড মিলে রাজার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করতেন।
৪. ক্ষমতার দ্বন্দ্ব : সামন্ত যুগে প্রত্যেক সামন্ত প্রভু তার নিজের ভূসম্পতি ও ভূমিদাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চাইতেন। ক্ষমতা বৃদ্ধির এই প্রতিযোগিতা সামন্ত যুগে ইউরোপকে অশান্ত করে তুলেছিল এবং প্রতিবেশী লার্ডদের পারস্পরিকদ্বন্দ্ব মধ্যযুগে ইউরোপে সামরিক ঐক্যবোধের সম্ভবনাকে বিনষ্ট করে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলার ফলে তারা বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতেও ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। ফলে তাদের এরূপ আচরণে জনগণ সর্বদায় শঙ্কাং ও নিরাপত্তাহীনতায় দিন যাপন করত।
৫. সামন্ত প্রভুদের বিলাসবহুল জীবন যাপন : সামন্ত যুগে সামন্ত প্রভুরা বিলাস বহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। -সামন্ত প্রভুদের বিশাল সম্পদ তাদেরকে বিলাসি করে তুলেছিল। এ সম্পদের মূল উৎস ছিল কৃষক। তাদের বসবাস ছিল। সুরক্ষিত দুর্গমন রাজ প্রাসাদে। এতে দামি দামি আসবাবপত্রও ছিলো কিন্তু অবহেলায় দিন যাপন করে নির্যাতিত কৃষক।
৬. সামাজিক নিষ্ক্রিয়তা ও গতিহীনতা : সামন্ততন্ত্র সমাজকে উন্নয়ন ও গতিশীল করার পরিবর্তে সমাজকে নিষ্ক্রিয় ও গতিহীন করে তুলে ছিল। কারণ এস্টেট ও ম্যানর গুলো ছিল স্বয়ং সম্পূর্ণ- যা জনগণের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রয়োজন মেটাত। সামন্ত প্রথার ম্যানরগুলো নিজেই ছিল যেন একটি পরিপূর্ণ জগৎ যেখানে জনগণ জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ করত । অর্থাৎ ম্যানর প্রথার কারণে সামন্ততন্ত্র সমাজকে গতিহীন ঐক্য বন্ধ সমাজে পরিণত করেছিল।
৭. সীমিত অগ্রগতি : সামস্ত সমাজে সামগ্রিক অগ্রগতি ছিল হতাশাব্যঞ্জক। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি ছিল খুবই সীমিত। নতুন কোনো ধারণার প্রবেশ বা প্রয়োগ সামন্ত সমাজে ছিল না। অর্থনৈতিকভাবে সমাজ ছিল অপরিবর্তনীয় ও অনুন্নত। কারণ সামন্ত প্রভুরাও চাইতেন না যে সমাজে কৃষি শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটুক ।
৮. জাতীয় ঐক্য বিঘ্নিত : সামন্ততন্ত্র সামগ্রিকভাবে জাতীয় ঐক্যকে ব্যহত করেছিল। কারণ সামন্ত প্রথার জাতি ও জাতীয় ঐক্যের ধারণা ছিল অনুপস্থিত। সামন্ত প্রথার জনগণ রাজার থেকে বেশি লর্ড বা সামন্ত প্রভুর প্রতি বেশি অনুগত থাকত। স্থানীয় ভাবে লর্ডই ছিলেন সর্বোচ্চ অবস্থানকারী এবং তাদের কথা জনগণ মেনে চলত। ফলে জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ছিল না।
৯. কৃষকের উপর নির্যাতন : সামন্ত যুগে কৃষক ছিল সর্বোচ্চভাবে অবহেলিত। তাদের কোনো মানবিক মর্যাদা ছিল না। নানাবিধ কর ও বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দেওয়া সত্ত্বেও তারা নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেত না। লর্ডদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করলে এবং কর প্রদানে ব্যর্থ হলে কৃষককে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হতো। তাকে বন্দি করে চুনের গুদামে আটক রাখা হতো। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষ তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো।
১০. কৃষকের নিম্ন জীবনমান : সামন্ত যুগে সবচেয়ে অবহেলায় দিনযাপন করত কৃষক সমাজ। অথচ অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তিই ছিল এই কৃষক। তাদের বাসস্থান ছিল ছোট্ট একটি কুড়েঘর যাতে কোনো আসবাবপত্র ছিল না। শীতের দিনে তাদেরকোন গরম কাপড় ছিল না। একই ঘরে তাদের সাথে তাদের পশু গুলোও থাকত। অধিকাংশ সময় তাদেরকে অনাহারে অর্ধহারে দিন যাপন করতে হতো। এই ছিল সামন্ত যুগে কৃষকের জীবন চিত্র।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সামন্ত প্রথার নানাবিধ কুফল বিদ্যমান। তবে এ নিয়ে নানাদিক থেকে বিতর্কও রয়েছে। তবুও পরবর্তীকালে ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে বিকাশ সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় তার আভাস পাওয়া যায় । এতোদা সত্ত্বেও সামন্ত সমাজে সর্বোচ্চ নির্মমতার ও অবহেলা, অযত্ন, নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার কৃষক শ্রেণিকে উপেক্ষা করা যায় না। কারণ তারাই ছিল এ সমাজের মূল চালিকা শক্তি।