ফরাসি বিপ্লবে তৃতীয় সম্প্রদায়ের অবদান আলোচনা কর।

admin

  ভূমিকা :

ইউরোপের ইতিহাসে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব এক অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত করেছিল। মানব সভ্যতার অগ্রগতির বর্তমান ধারণা এবং বর্তমান সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো এ বিপ্লবের মাধ্যমে রূপ লাভ করেছে। সর্বাত্মক রাজশক্তির হলে জনসাধারণের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্র ও জাতির স্বার্থের পার্থক্য, জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা সবকিছুই এ বিপস্নব হতে জন্মলাভ করেছিল। গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী প্রভৃতি এর মূল্যবান অবদান। বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের জনগণ যাজক সম্প্রদায়, অভিজাত সম্প্রদায় ও বুর্জোয়া সম্প্রদায় ও ভিন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল । এদের ভিতরে বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের অবস্থান ছিল তৃতীয় শ্রেণির। এ সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায় ফরছি বিপ্লব আনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।


ফরাসি বিপ্লবে তৃতীয় সম্প্রদায়ের অবদান আলোচনা কর।

তৃতীয় শ্রেণির ভূমিকা :

ফরাসি বিপ্লবের সময় বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত, শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুর সকলেই ছিল তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এদেরকে অধিকারহীন শ্রেণিও বলা যায়। তৎকালীন ফ্রান্সের মোট লোকসংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন যার মধ্যে ৯৩ ভাগ তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ শ্রেণিগুলো বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত ছিল। তবে ফরাসি বিপ্লবের সময় অভিজাতদের আধিপত্য ও শোষণ নীতির জন্য নিজেদের বিবাদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়। তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে যে উপশ্রেণি ছিল তাদেরকে সাকুল্য, কৃষক ও বুর্জোয়া শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়।


বুর্জোয়া শ্রেণি : তৃতীয় শ্রেণির মুখপাত্র ছিল বুর্জোয়া শ্রেণি। নিম্নে এ শ্রেণি ফরাসি বিপ্লব আনয়নে যে ভূমিকা পালন করেছিল তা আলোচনা করা হলো :


১. বুর্জোয়া শ্রেণি কারা : বুর্জোয়া বলতে সাধারণত পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক শ্রেণিকে বুঝায়। কিন্তু ফরাসি বুর্জোয়াদের সবাই পুঁজিবাদী ছিল না। মধ্যযুগে যারা Bury বা শহরের উপকণ্ঠে বাস করে ব্যবসায় বাণিজ্য, শিল্প, কারিগরি - দ্বারা জীবিকা অর্জন করত তাদের বলা হতো Burges বা বার্গের অধিবাসী। এ Burges রাই বর্তমান যুগে বুর্জোয়া নামে পরিচিত। শহরের ধনি বণিক, সাধারণ দোকানদার, কারিগর, বুদ্ধিজীবী, চাকরিজীবী সবাই বুর্জোয়া শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।


২. বুর্জোয়াদের শ্রেণিবিভাগ ও তাদের ভূমিকা : বুর্জোয়াদের মধ্যে স্তরভেদ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। বুর্জোয়াদের আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেও তাদের বংশকৌলিন্য ছিল না।


ক. বুর্জোয়াদের বিভিন্ন স্তরে ছিল পাতি বুর্জোয়া। এদের মধ্যে একটি অংশ চাকরিজীবী, আইনজীবী, চিকিৎসক, অধ্যাপক প্রভৃতি পেশা গ্রহণ করে। এদেরকে বুদ্ধিজীবী বুর্জোয়া বলা হয়। এরা ছিল বুদ্ধিমান, সাহসী ও সমাজ সচেতন। দার্শনিকদের আলোকিত ভাবধারা এ শ্রেণির মধ্যে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এ শ্রেণির লোকেরাই অভিজাতদের জন্ম কৌলীন্য ও বিশেষ অধিকারে আক্রমণ করে।


খ. বুর্জোয়াদের অপরাংশ ব্যবসায় বাণিজ্য দ্বারা প্রভূত অর্থ উপার্জন করে। এদের হাতে প্রচুর অর্থ থাকলেও বংশকৌলীন্যের অভাবে এরা অভিজাতদের সমান মর্যাদা পেত না। এদের ধনি বুর্জোয়া বলা যায়। ধ্বনি বুর্জোয়ারা। সরকারকে প্রচুর অর্থ ঋণ দিত। বুরবো সরকার বণিকদের শিল্প বাণিজ্যের উপর নানাবিধ বিধিনিষেধ জারি করায় এবং মালের ওপর শুল্ক চাপানোর জন্য সরকারের উপর ঘোর অসন্তুষ্ট ছিল। এর ধারাবাহিকতায় এ শ্রেণি ফরাসি বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


গ. মূলধনি বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল ব্যাংকের মালিক, বড় বড় শিল্পের মালিক। এদের হুর্তে বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি শ্রেণি বলা হতো। এরা ছিল অর্থবান, এরা বাণিজ্যে মূলধন লগ্নি করত। সরকারকে এরা সুদের বিনিময়ে ঋণ দিত।


উপরিউক্ত শ্রেণিগুলোর মধ্যে পাতি বুর্জোয়ারা ছাড়া অন্য সব বুর্জোয়া ছিল সম্পদশালী। তবে বংশকৌলীন্য ন থাকায় সরকারের কাছে মর্যাদা বা সম্মান পেত না। এ কারণে বুর্জোয়ারা অভিজাতদের ঈর্ষা করত। পাতি বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল দার্শনিক চিন্তাধারায় উদ্দীপিত এবং পুরাতন তন্ত্রের তীব্র সমালোচক। তাই তারা নিজেদের প্রাধান্য পেতে সঙ্গম হওয়ার জন্য বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।


কৃষক শ্রেণী : কৃষক সম্প্রদায় ছিল তৃতীয় শ্রেণির অন্যতম বৃহৎ অংশ। নিম্নে ফরাসি বিপ্লবে কৃষক শ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করা হলো :


কৃষকদের প্রকারভেদ :

কৃষকদের মধ্যে কয়েকটি ভাগ লক্ষ করা যায় ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে। যথা -


স্বাধীন কৃষক : স্বাধীন কৃষক নিজের জমি চাষ করত। ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ইংরেজ পর্যটক আর্থার ইয়ং ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে ঘুরেছিলেন। তার রচনা থেকে জানা যায় যে, ফ্রান্সে প্রতি চারজন কথকের মধ্যে একজন ছিল নিজের জমির মালিক। এ শ্রেণী ফ্রান্সে একের তিন অংশ কৃষিজমির মালিক ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ স্বাধীন কৃষক পরিবারগুলোর জমির পরিমাণ এতই কম ছিল যে, তার আয়ে দিন চলত না। রাজকীয় ও সামন্ত করের চাপে কৃষকরা নিষ্পেষিত হয় এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জনিসের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের প্রতি তাদের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।


২. কিছু চাষি ছিল ভাগী চাষি বা বর্গাচাষি। এরা জমিদারদের জমি চাষ করত। সকল প্রকার কর প্রদানের এদের হাতে মাত্র বিশ শতাংশ ফসল থাকত ।


৩. বর্গাচাষি ছিল খাজনা চাষি বা Rentier, এরা সামন্তপ্রভু ও জমিদারদের জমি খাজনার বিনিময়ে চাষ করত। জমিতে এদের কোনো স্বত্ব ছিল না।


৪. যেসব কৃষকের নিজের সামান্য জমি, নিজের লাঙল ও বলদ ছিল এদের বলা হতো প্রান্তিক স্বাধীন কৃষক। দক্ষিণ ফ্রান্সে এদের সংখ্যা বেশি ছিল। এরা স্বম্পূর্ণ সচ্ছল কৃষক ছিল না।


৫. এদের নিচে ছিল ভূমিহীন, ক্ষেতমজুর বা সুপরিবাসী ক্ষেতমজুর বা কোটাগার। এরা ফসল রোপণ বা ফসল তোলার সময় ক্ষেতে মজুরের কাজ করত। কৃষকদের মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগ ছিল ভূমিহীন দিনমজুর।


৬. সবার নিচে ছিল ভূমিদাস। প্রতি বিশ জনের একজন ছিল ভূমিদাস। কৃষক শ্রেণির মধ্যে এদের অবস্থা ছিল সর্বাপেক্ষা শোচনীয়

উক্ত শ্রেণিগুলো রাজ্য ও গির্জাকে ফসলের ভাগ দিত। অনেক সময় তাদের খাজনা প্রদান করতে হতো। যদিও এ শ্রেণি ছিল সম্পদ উৎপাদনকারী কিন্তু অভিজাতরা এ শ্রেণিকে নিচু মনে করত। অভিজাতরা মনে করত তাদের খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষকরা জন্মেছে। রাজকোষে রাজস্ব প্রদান, সামন্ত প্রভুদের কর ও রসদ জোগান ও শহরের লোকদের খাদ্য সরবরাহ করতে কৃষকরা বাধ্য ছিল বলে মনে করা হতো। এ শোষিত কৃষক শ্রেণি অভিজাতদের শোষণ হতে রক্ষার জন্য একজোট হয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। কৃষক শ্রেণির সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাই ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন।


সাকুলেৎ শ্রেণি : তৃতীয় শ্রেণির সর্বনিম্ন স্তরে ছিল সাঁকুলেৎ শ্রেণি। নিম্নে ফরাসি বিপ্লবে এ শ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করা হলো -


সাঁকুলেৎ কারা : তৃতীয় শ্রেণিতে ছিল কৃষক ছাড়া নগরবাসী, প্রলেটারিয়েট বা শ্রমজীবী, চালচুলোহীন ভাসমান লোক, ফ্রান্সে এদের বলা হতো সাকুলেৎ। এদের নিজের বাসযোগ্য ও চাষের কোনো জমি ছিল না। অন্যের জমিতে দিন মঞ্জুর খাটাই ছিল তাদের পেশা। শহরে তারা বিভিন্ন কারখানায় কাজ করত এবং ঘরের চাকরের কাজ করত।


১. সামাজিক অবস্থা : সাকুলেৎ শ্রেণি ছিল সমাজের সর্বাপেক্ষা নিষ্পেষিত শ্রেণি । তারা ছিল মোট জনসংখ্যার একের পাঁচ ভাগ। তাদের ভিতর কোনো একতা ছিল না।


২. অর্থনৈতিক অবস্থা : বিপ্লবের প্রাক্কালে সাকুলেৎ শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। এদের সন্তানসন্ততি অনেক বেশি ছিল। এদের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার পার্থক্য ছিল। তারা মনে করত কোনো একদিন তারা কিছু সম্পত্তির মালিক হবে। তাদের মনে কখনো ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ও সমাজতন্ত্রের ধ্যানধারণা দ বাধেনি। জিনিসপত্রের উচ্চ মূল্যের তুলনায় তাদের মজুরি ছিল অনেক কম। বিপ্লবের প্রাক্কালে খাদ্যশস্যের দাম বাড়ে (৬০-৬৫%) কিন্তু মজুরি বাড়ে মাত্র ২২ শতাংশ।


ফরাসি বিপ্লবে এদের ভূমিকা :

তৎকালীন ফ্রান্সে সাকুলেৎদের অবস্থা ছিল নিম্নশ্রেণির এবং তাদের মধ্যে কোনো প্রকার একতা ছিল না। ফরাসি বিপ্লবের সময় এদের মজুরির হার হ্রাস ও পর পর দুই বছর অনাবৃষ্টি তাদের দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে তোলে। এদের এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের ব্যবহার করে। তাদেরই অংশগ্ৰহণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বুর্জোয়া নেতাদের বিজয় সূচিত হয় এবং বুর্জোয়া নেতাদের ৪ আগস্ট ঘোষণার মাধ্যমে পুরোতন্ত্রের পতন ঘটতে বাধ্য হয়।


উপসংহার :

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায় যে, ফরাসি বিপ্লব আনয়নে তৃতীয় জনগোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল বহুল আলোচিত। অনেকে মনে করেন তাদের ভূমিকা না থাকলে হয়ত ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হতো না। ফ্রান্সের এ বিপ্লব আকস্মিক কারণে ঘটেনি, দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সের রাজনীতি, সামজ ও অর্থনীতির যে ব্যবস্থা চলে আসছিল। তার সাথে ফ্রান্সের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ যুক্ত ছিল না। শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের সাধারণ লোক বুর্জোয়া প্রেম, কৃষক শ্রেণি ও পাকলেও শ্রেণির নেতৃত্বে পুরাতন ব্যবস্থা ভেঙে নতুন ব্যবস্থা গঠনে তৎপর হয়।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!