ফরাসি বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল কারা? তাদের ভূমিকা আলোচা কর।

admin

ভূমিকা :

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ফ্রান্সে গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসি জনগণ এ বিপ্লবের সূচনা করেছিল। ১৭৮৯ সালে এ ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়, ইউরোপ তথা সমগ্রবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পিছনে কতিপয় নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তারা এ বিপ্লবকে বলিষ্ঠভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল।


ফরাসি বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল কারা? তাদের ভূমিকা আলোচা কর।

বিপ্লবের নেতৃবৃন্দ :

এ বিপ্লব ছিল স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের বিপ্লব। এ সাধারণ মানুষকে নেতৃত্বের মাধ্যমে বিদ্রোহের আকারে প্রকাশ করার পিছনে যেসব নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে তাদের মধ্যে কাউন্ট মিরাবো, দাতো, রোবসপিয়ায়, ল্যাফায়েৎ ছিলেন অন্যতম। এছাড়া জেকেবিন ক্লাব ও গিরভিস্ট দলও এ বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


কাউন্ট মিরাবো : ফরাসি বিপ্লবের পিছনে যেসব নেতৃবৃন্দের অবদান আছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও বক্তা কাউন্ট মিরাবো। তিনি একজন অভিজাত বংশীয় সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তার জীবন ছিল অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল। কুৎসিত চেহারার অধিকারী হলেও তার ছিল অসাধারণ বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। যেসব অভিজাত ব্যক্তিবর্গ জ্ঞাননীতির প্রভাবে আলোড়িত ছিলেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। ফরাসি বিপ্লবের সময় যেসব রাজনীতিবিদ ও বক্তার উদ্ভব হয়েছিল মিরাবো ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। বিপ্লবের প্রথম দিকে যখন জাতীয় সভা ফ্রান্সের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত ছিল তখন মিরাবো এতে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করেছিলেন। অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসেবেই তিনি ফ্রান্সের জাতীয় সভা স্টেটস জেনারেল (১৭৮৯)-এর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফরাসি বিপ্লবে তার অবদান নিচে আলোচনা করা হলো :


১. জাতীয় সভায় প্রভাব বিস্তার : বিপ্লবের প্রাক্কালে তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের “টেনিস কোটের শপথ’ গ্রহণের পর রাজা ষোড়। লুই জাতীয় সভা আহ্বান করে। প্রতিনিধিকে যখন ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় হিসেবে পৃথকভাবে জাতীয় সভায় অংশগ্রহণ করতে বললেন এবং অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করলেন তখনই মূলত সংকটময় মূহূর্তে সৃষ্টি হলো বিপ্লবের যখন রাজা তার বক্তব্য শেষ করলেন তখন আইনসভার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী সদস্যগণকে সভাকক্ষ ত্যাগ করতে বললেন। এ সময় তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা যদি বলপূর্বক তাদের অধিকার গ্রহণ না করতেন, তাহলে “টেনিস কোটের শপথ” বিফল হতো। সে সময় মিরাবো বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, আমরা জনসাধারণের প্রতিনিধি, একমাত্র বলপূর্বক আমাদিগকে এখান হতে বের করতে পারবে নতুবা নয়। তিনি জাতীয় সভাকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রতিনিধিগণের ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না-এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন।


২. অরাজকতা ও স্বৈরাচার বিরোধী : মিরাবো উদারপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু উদারতার আতিশয্য তিনি পছন্দ করতেন না। ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্রে তার ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। তার চেষ্টা ও দূরদর্শিতার ফলে বিপ্লব প্রথমে শাসনতান্ত্রিক পথে চালিত হয়েছিল। মিরাবো উগ্র চরমপন্থি বা উগ্র দক্ষিণপন্থি ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন উপযুক্ত সংস্কারের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের ত্রুটি দূর করতে। স্বৈরাচার ও অরাজকতাকে তিনি চরমভাবে ঘৃণা করতেন। শাসনব্যবস্থা কার্যকরী রাখতে হলে কার্যনির্বাহ বিভাগের উপযুক্ত ড্রামতা থাকা প্রয়োজন-এ কথা তিনি স্বীকার করতেন।


৩. রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি : মিরাবো রাজাকে ভোটে ক্ষমতা দানের পক্ষপাতী ছিলেন। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল মন্ত্রী পদ লাভ করা। কিন্তু সংবিধান সভার কোনো সদস্যই নতুন আইনসভার সভ্য হতে পারবেন না-এরূপ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে তার আশা ভেঙে গেল। তিনি একজন বিপ্লবী নেতা ল্যাফায়েৎ-এর সাথে যুগ্মভাবে ফরাসি শাসনব্যবস্থাকে সুদূঢ় ও কার্যকরী রাখতে এবং রাজার ক্ষমতা যেন হ্রাস করতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে চাইলেন।


৪. উপদেষ্টা নিযুক্ত : এ অবস্থায় তিনি গোপনে ষোড়শ লুইয়ের উপদেষ্টা নিযুক্ত হলেন। তিনি ষোড়শ লুইকে যেসব সদুপদেশ দিতেন তা থেকে তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ অবস্থার উন্নতিকল্পে নানাবিধ সুপরামর্শ রাজা ও তার মন্ত্রীদের দিয়েছিলেন এবং ফ্রান্সের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ষোড়শ লুইকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ১৭৯১ সালে মিরাবো মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার মৃত্যু পরবর্তীকালে ফরাসি রাজতন্ত্রকে রক্ষার জন্য আর কোনো দূরদর্শী রাজনৈতিক বিপ্লবী নেতা অবশিষ্ট রইল না।


ম্যাক্সিমিলিয়েন ফ্রাসোয়া রোবসপিয়ার :

রোবসপিয়ার ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি জেকোবিন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। প্রথম জীবনে তিনি ফ্রান্সের এক প্রাদেশিক বিচারালয়ে আইন ব্যবসায় করতেন আইনজীবী হিসেবে তিনি যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। তবে ১৭৮৯ সালে জাতীয় সভায় প্রতিনিধি নির্বাচিত হলে বাসে তার নাম জনসম্মুখে উঠে আসে। নিম্নে তার ভূমিকা আলোচনা করা হলো :


১. চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য : রোবসপিয়ারের চরিত্রে সংকীর্ণতা, একদেশদর্শিতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার চরম প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়েছিল। কিন্তু তার সততা ও নৈতিকতা ছিল সমসাময়িক বিপ্লবী নেতাদের প্রায় সকলেরই উর্ধ্বে। জীবনে কতকগুলো  মৌলিক নীতি অনুসরণ করে চলাই ছিল তার বৈশিষ্ট্য। এসব নীতির অতি সামান্য পরিবর্তনও তিনি সহ্য করতে পারতেন না তার সংযম, একনিষ্ঠ দেশপ্রেম তার চরিত্রের ত্রুটি বহু পরিমাণে দূর করেছিল।



২. রোবসপিয়ারের আদর্শ : রুশোর দার্শনিক মতবাদে প্রভাবিত চরম গণতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী রোবসপিয়ার ছিলেন কোবিন দলের নেতৃবর্গের অন্যতম। জেকোবিন ক্লাবের মাধ্যমে তিনি চরম উদারনৈতিক মতবাদ প্রচার করে এটিকে | এক শক্তিশালী প্রভাবে পরিণত করেছিলেন। তিনি বিপ্লব বিরোধী শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য ক্রোধ ও হিংসাকে প্রকাশ্যে • প্ররোচনা দেন। তিনি গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এছাড়া তিনি প্যারিসের বিপ্লবী জনতার সাহায্যে ভীতি প্রদর্শন করে জাতীয় সভাকে জেকোবিনদের মতামত মানতে বাধ্য করেন। তার মতে, জনতা ছিল প্রকৃত ক্ষমতার উৎস।


৩. সন্ত্রাসের রাজত্ব : দাতো এবং হোর্বাটের পতনের পর স্বভাবতই তিনি জেকোবিন দলের সর্বেসর্বা হন। ষোড়শ তুই পলায়নের সময় ধরা পড়লে প্যারিসবাসী যখন দুটি পরস্পর বিরোধী মতবাদে সমার্থক হয়ে পড়ল পাতোঁর সাহায্য নিয়ে তিনি রাজতন্ত্রের অবসান ঘটাতে সমর্থ হয়েছিলেন। ঐ সময় অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিল তিনি দেশরক্ষার জন্য জননিরাপত্তা কমিটি ও ট্রাইবুনাল গঠন এবং পরে সন্ত্রাসের রাজত্বকাল স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এর মাধ্যমে দেশ সংকট হতে রক্ষা পায়।


৪. ধর্মবিশ্বাস : রোবসপিয়ার ছিলেন ধর্মভীরু; ভগবানে বিশ্বাসী। তিনি রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের চেষ্টাও করেছিলেন। তিনি ধর্মপ্রচারকের গোঁড়ামি নিয়ে সংস্কার সাধন করলে সাধারণ জনগণের আস্থা হারান। তবে রোধসপিয়ারের ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না।


৫. সার্বিক মূল্যায়ন ও পতন : স্বৈরাচারী ক্ষমতা ভোগ করে শেষ পর্যন্ত তার একক প্রাধান্য অপ্রতিহত হয়ে উঠল। সন্ত্রাসের রাজত্বকাল একদিকে যেমন ভয়ংকর ছিল, তেমনি এর মাধ্যমেই তিনি ফরাসি রাষ্ট্রের বিপ্লবকে রক্ষা করতে সমর্থ হন। দীর্ঘদিন গ্রেফতার ও মৃত্যুভয়ে ভীত হওয়ার ফলে তার অনেক অনুগামীরাই তাকে হত্যা করতে সংঘবদ্ধ হন। সন্ত্রাসের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়েছে তা তিনি উপলব্ধি করেননি। এ প্রতিক্রিয়া রোবসপিয়ারের পতন ঘটায়। কয়েক মাস অপ্রতিহত, ক্ষমতা ভোগ করার পর তিনি কনভেনশন কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মৃত্যুর সাথে সাথে এ শাসনব্যবস্থায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।


দঁতোঁ :

দঁতো ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম নেতা। তিনি জ্যাকোবিন দলের নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি ছিলেন । একজন স্বনামধন্য আইনজীবী। বিদ্বান হিসেবেও তার যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। তার রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল গভীর। নিচে ফরাসি বিপ্লবে তার ভূমিকা দেওয়া হলো :


১. দেশপ্রেমিক দঁতো : অস্ট্রিয়া ও এশিয়ার যুগ্ম বাহিনী যখন ফ্রান্স আক্রমণ করে পর পর কয়েকটি শহর দখল করে নিয়েছিল তখনই দতো দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ইতিহাসে বিখ্যাত বক্তৃতার মধ্যে অন্যতম বক্তৃতায় ফ্রান্সের অধিবাসীদের বলেছিলেন, যে ব্যক্তি দেশ রক্ষার কাজে ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণে অস্বীকৃত হবে অথবা অস্ত্র দিতে অস্বীকার করবে তাকে শাস্তি হিসেবে প্রাণদণ্ড ভোগ করতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, জয়লাভ করতে হলে আমাদের সাহসের সাথে অগ্রসর হতে হবে। আবার তত দিন সাহস দেখাতে হবে যত দিন না ফ্রান্স বিদেশি শত্রুর হাত থেকে রক্ষ পায়। তিনি তার এ বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণকে মুগ্ধ করে প্রশংসা অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।


২. ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সহায়তা : তিনি ফরাসি বিপ্লবের সময় বিভিন্ন প্রজাতান্ত্রিক দলগুলোকে একতাবদ্ধ করার মাধ্যমে দেশের কল্যাণার্থে কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বিপ্লব রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিপ্লবী নেতা। সর্বস্ব ত্যাগ করতে দ্বিধা বোধ করেননি। যার দরুন তার মতের মিল না হওয়া সত্ত্বেও সে মাথা রিভিস্ট এবং রাজ্য সকলের সাথে একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু অন্যরা তার প্রতি শত্রু ভাবাপন ছিল।


৩. রাজনৈতিক আদর্শ : তো ছিলেন একজন গভীর রাজনৈতিক গুণের অধিকারী ব্যক্তি। তার রাজনৈ দূরদর্শিতার ফলে ফরাসি বিপ্লবকে সার্থক করে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। তিনি একতা ও সুদঢ় প্রয়োজনের উপর গুরুত্বারোপ করে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি রাজনৈতিক সংযম এবং অন্যের প্রতি পরম সহিষুতা প্রদর্শনের প্রয়োজন বলে মনে করতেন। তিনি কোনো উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না, বরং মধ্যপন্থি রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।


৪. দাতোর মৃত্যুদন্ড : দাতো যখনই মানুষের প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হন তখনই তিনি স্বার্থপর ও ঘুষখোর হয়ে উঠেন। কিন্তু তার অন্তরে পর বিদ্বেষ, হিংসা পরায়ণতা ও পরশ্রীকাতরতা মোটেও স্থান পায়নি। তিনি ছিলেন উদাসীন সহজ প্রকৃতির লোক। ডোমোরিজের রাজতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন সন্দেহে তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।


মার্চুইম ডি. ল্যাফায়েৎ :

ল্যাফায়েৎ ছিলেন ফ্রান্সের এক অভিজাত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। আমেরিকার বিপ্লবীদের সাথে তিনি সমানভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। এ কারণে ওয়াশিংটনের সাথে সৌহার্দ্য জন্মেছিল। ফরাসি বিপ্লবে তার অবদান নিচে আলোচনা করা হলো।


১. রাজনৈতিক আদর্শ : ওয়াশিংটন ও ফ্রাঙ্কলিনের কাছ থেকে অন্যায়মূলক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়ার শিক্ষা তিনি লাভ করেছিলেন। প্রত্যেক শাসনব্যবস্থার মূল আদর্শ ব্যক্তিস্বাধীনতা দান করা এবং জনস্বার্থ বৃদ্ধি করাে এ ধারণা ঐ সময় তার মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। তিনি এ উদারনৈতিক শিক্ষা ও বিপ্লবের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরে এসেই ফরাসি জনগণের উপর অন্যায়মূলক করারোপের বিরুদ্ধে পণ্ডায়মান হলেন।


২. ল্যাফায়েৎ-এর ভূমিকা : বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন করা হলে তাকে এ বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া হয় । তিনি কার্যনির্বাহ বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষপাতী ছিলেন না। তার প্রস্তাব অনুসারে ১৭৯১ সালে আইনসভার সদস্যদের মস্তিত্ব লাভের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি ১৯৭২ সালের ১০ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সময় রাজার সাহায্যার্থে অগ্রসর হন। কিন্তু রাজাকে রক্ষা করতে পারেননি। মিরাক্কো ও ল্যাফায়েৎ-এর যুগ্ম প্রচেষ্টায় ফরাসি রাজতন্ত্র হয়ত রক্ষা পেত, কিন্তু তার আত্মগম্ভীরতা তাকে মিরাবোর সাথে কাজ করতে বাধা দিল। তবে তিনি বৃদ্ধাবস্থায় ১৮৩০ সালে জুলাই বিপ্লবের সময় বিপ্লবীদেরকে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ হতে রক্ষা করেছিলেন। তার চেষ্টায় লুই ফিলিপ সিংহাসনে বসতে সক্ষম হয়েছিলেন।


ফরাসি বিপ্লবের স্রষ্টা : ফরাসি বিপ্লবের নেতৃত্ব শুধুমাত্র যে কয়েকজন ব্যক্তি নিয়েছিলেন তা নয়, এ বিপ্লব আনয়নে বুর্জোয়া ও কৃষক শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।


বুর্জোয়া শ্রেণি : ফরাসি বিপ্লবে তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ শ্রেণির মধ্যে অধ্যাপক, চিকিৎসক, ব্যাংকার, আইনজীবী ও ব্যবসায় বাণিজ্যকারী বণিক সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সম্প্রদায় অন্যান্য সম্প্রদায় অপেক্ষা বুদ্ধি, জাতীয়তাবোধ ও বিদ্যায় অনেক ঊর্ধ্বে ছিল। এদের অনেকের সম্পদ অভিজাত সম্প্রদায়ের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বুর্জোয়া সম্প্রদায় অভিজাত শ্রেণির রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশেষ সুযোগ সুবিধা ও কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারেনি। তাদের বিদ্যা, বুদ্ধি ও অর্থসম্পদ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও সামাজিক কোনো মর্যাদা ছিল না। তথাপি সরকার তাদের উপর ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব চাপিয়ে দিত। এ বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানোর জন্য বুর্জোয়া শ্রেণি ফরাসি বিপ্লব ঘটাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল ।


কৃষক শ্রেণি : ফ্রান্সের অধিবাসীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল কৃষক। তবে এ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের দুঃখদুর্দশার সীমা ছিল না। তাদের উপর দুঃসহ কর আরোপ ফরাসি বিপ্লবে তাদেরকে সম্পৃক্ত করতে সাহায্য করে। তাই অনেকের মতে, ফ্রান্সের নির্যাতিত কৃষক শ্রেণিই ছিল ফরসি বিপ্লবের স্রষ্টা। ফ্রান্সের জাতীয় সভার অধিবেশন আহ্বানের পর প্যারিসের বিদ্রোহ ও বাস্তিল দুর্গের পতনের খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামাঞ্চলের কৃষকরা বিপ্লবের পথে পা বাড়ায়। তাই সামগ্রিকভাবে বলা যায়, মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল ফরাসি বিপ্লবের স্রষ্টা, আর কৃষক শ্রেণি ছিল এ বিপ্লবের সফল রূপকার।


উপসংহার :

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে ছিল সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক ও সামাজিক শোষণের ইতিহাস। যেকোনো বিপ্লবকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন। উক্ত নেতৃবৃন্দ বিপ্লবকে সামগ্রিকতা দান করলেন। যদিও তারা সমালোচিত হয়েছিলেন, তবে সামগ্রিক বিচারে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!