ফরাসি বিপ্লবের গতিপ্রকৃতি আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

ইউরোপসহ বিশ্বের যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। এ বিপ্লবের গতি সঞ্চারিত হয় মূলত বিভিন্ন গোষ্ঠী বা শ্রেণির অভিযোগ ও অসন্তোষ থেকে। এ বিপ্লবের ফলে সমগ্র বিশ্বে জাতীয়তাবাদ ও সাম্যের সুর বেজে উঠেছিল।


ফরাসি বিপ্লবের গতিপ্রকৃতি আলোচনা কর।

ফরাসি বিপ্লবের গতিপ্রকৃতি :

বহুদিনের পুঞ্জীভূত নানাবিধ অভিযোগ ফরাসি বিপ্লবে রূপ লাভ করেছিল। এর গতি কোনো একটি ধারায় সীমাবদ্ধ ছিল না, প্লাবনের ন্যায় এটি এক দুর্জয় শক্তি নিয়ে গতানুগতিকতার সীমারেখা লঙ্ঘন করে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের গতি মূলত চারটি সম্প্রদায় নিয়ন্ত্রণ করেছিল। যথা : অভিজাত সম্প্রদায়, বুর্জোয়া শ্রেণি, শহর অঞ্চলের জনগণ ও কৃষক শ্রেণি।


অভিজাত সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ:

ফরাসি বিপ্লব সর্বপ্রথম অভিজাত ও ধনি সম্প্রদায় শুরু করে। তাদের বিদ্রোহের কারণ নিচে আলোচনা করা হলো :


১. অভিজাতদের স্বার্থ রক্ষা : অভিজাতদের শ্রেণিগত স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে থাকলে তারা তখন নিজেদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার তৎপরতা হিসেবে বিপ্লবের সূচনা করে। যুগ যুগ ধরে অভিজাত শ্রেণি নিজেদের স্বার্থের জন্য রাজাকে সাহায্য করে। আসছিল, কিন্তু অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অভিজাতরা তীব্র আর্থিক সংকটে পতিত হয়। ফলে তারা ঐতিহ্যগত সুযোগ সুবিধাগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়াসী হয়।


২. অভিজাতদের উপর করারোপ : ষোড়শ লুই সিংহাসনে আরোহণ করার পর তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হন। তার মন্ত্রী তুর্গোর খাদ্যশস্য রপ্তানি ও অবাধ বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং গিল্ট ব্যবস্থার উচ্ছেদ ও কৃষকদের উপর বিশেষ করারোপ করেন। কিন্তু অভিজাতদের উপর করারোপের চেষ্টা করলে তারা আন্দোলন শুরু করে। পরে ক্যালোন অর্থমন্ত্রী হয়ে রাজার ব্যবস্থায় উন্নতির জন্য প্রস্তাব পেশ করেন। এতে অভিজাতরা বিদ্রোহ করেণ।


৩. স্টেটস জেনারেলের আহ্বান : ষোড়শ লুই ১৭৮৯ সালের মে মাসে জাতীয় সভার অধিবেশন আহ্বান করেন। তার এ সিদ্ধান্তে প্রাদেশিক পরিষদে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। পরে লুই ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রাদেশিক সভা পার্লামেন্টের অধিকার ফিরিয়ে দেন। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ১ মে মন্ত্রী ব্রিয়াস্টেট জেনারেল ডাকার প্রতিশ্রুতি দেন। এদিন থেকে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়।


বুর্জোয়া বিদ্রোহ ও বিপ্লবের গতি :

অভিজাতদের বিদ্রোহের সময় বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণিও তাদের প্রতি অর্থন ব্যক্ত করেছিল। রাজকীয় স্বৈরতন্ত্র ও বৈষম্যমূলক করের বিরুদ্ধে এ শ্রেণির আপত্তি মোটেও কম ছিল না। নিম্নে বিদ্রোহের কারণ ও গতিশীলতা দেওয়া হলো :


১. মধ্যবিত্তদের ক্ষোভ : বুর্জোয়া শ্রেণি অভিজাতদের বিশেষ সুযোগ সুবিধার বিরুদ্ধে সবসময়ই ছিল। জাতীয় সভার অধিবেশনের সাথে সাথে বুর্জোয়া শ্রেণিও একাত্ম রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। জাতীয় সড়া আহত হলে সেখানে তাদের এটি ছিল একটি। এখানে তারা দুই সম্প্রদায়ের সাথে পারত না।


২. টেনিস কোটের শপথ : জাতীয় সভার একটি ভোটের বিপরীতে ৬১২ জনের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য তারা নাবি তোলে। এতে সংসদে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এতে রাজা অন্য উপায় গ্রহণের জন্য সভার মূল দরজা বন্ধ করে দেয়। পরের দিন মধ্যবিত্তের জনপ্রতিনিধিরা এসে দরজা বন্ধ দেখে রাজার টেনিস খেলার কোটে তাদের দাবি আদায়ের জন্য শপথ গ্রহণ করে।


৩. ত্রিশজনের সমিতি : এসময়ে বুর্জোয়া শ্রেণি জাতীয় সভায় নিজেদের সংগঠিত করার জন্য প্যাট্রিয়ট পার্টি গঠন করে। এর ভিতর ত্রিশজনের সমিতি বেশ প্রভাবশালী ছিল। এরাই প্যাট্রিয়ট পার্টিকে পরিচালনা করত। ত্রিশের সমিতির ভিতরে ছিল লিয়ানকুত, ল্যাফায়েৎ, বাদরসেং, ট্যালিয়্যান্ট এবং অ্যাবেসিয়েস প্রভৃতি।


শহরাঞ্চলে বিপ্লব :

যে সময় জাতীয় পরিষদে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও অভিজাতদের মধ্যে সমানাধিকার নিয়ে প্রচণ্ড বাগবিতণ্ডা চলছিল। সে সময় প্রশাসনিক অযোগ্যতা ও আর্থিক সংকটের ফলে প্যারিস নগরীতে এক অভূতপূর্ব অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার লোক প্যারিস আসতে থাকলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :


১. প্যারিসে গোলযোগ : ১৭৮৯ সালের এপ্রিল মাসে বুভুক্ষা নরনারী প্যারিসের রুটির দোকান ও কারখানাগুলো বিধ্বস্ত করে। দরিদ্র জনগণ আশা করেছিল জেনারেল মঞ্জুরির হার বৃদ্ধি এবং দ্রব্যের মূল্য হ্রাস করবে। কিন্তু তা না করায় জনগণ হতাশ হয়। এর মধ্যে রাজা জার্মান, লুইস প্রভৃতি দেশ থেকে সৈন্য আমদানি করলে প্যারিসবাদি অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। প্যারিসের পৌর শাসন ভেঙে পড়ে। ১৭৮৯ সালের ১১ জুলাই রানির প্রয়োচনায় ষোড়শ লুই নেকারকে পদচ্যুত প্রায় করলে অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে।


২. বান্ডিলের পতন ও এর গুরুত্ব : প্যারিসের শ্রমিক, কারিগর এবং গ্রাম ও শহরের দরিদ্র মানুষ খাদ্যের দাবিতে এর প্রবল দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু করে। এতে কৃষক শ্রেণি যোগ দেওয়া হতে বিরত থাকে। প্যারিসের সর্বত্র বিক্ষোভ মিছিল বৃদ্ধি ন পায়। তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য মিছিলের উপর অশ্বারোহী বাহিনী চালিয়ে দেওয়া হয়। সামরিক অধিনায়ক সসৈন্যে ভাব দাঁড়িয়ে থাকলে জনগণ কুঠার, পিস্তল, পাথর দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে। উন্মুক্ত জনতা অস্ত্রের দোকান ও সামরিক অস্ত্রাগার লুট করে। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই জনগণ অত্যাচারী শাসনের প্রতীক বাস্তিলের দুর্গ ধূলিসাৎ করে। জনগণ বন্দিদের মুক্ত করে শাসনকর্তা দ্যুলনকে হত্যা করে। এভাবে বিপ্লব বিদ্রোহে রূপ নেয়। বাস্তিলের পতনের গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারী সমর্থক সেনাবাহিনীর পতনের ফলে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয় এবং স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।


কৃষক শ্রেণির বিপ্লব : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে বুর্জোয়া বিপ্লবের সাফল্যের সাথে সাথে এক প্রবল কৃষক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। কয়েক বছরের খরার ফলে কৃষি উৎপাদন বিশেষভাবে ক্ষুণ্ণ হয় এবং গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে খাদ্যশস্যের অভাব আগে দেখা দেয়। আর্থিক সংকটের ফলে কৃষক অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। ভিক্ষুক ও ভবঘুরের সংখ্যা ভয়াবহ আকারে বৃদ্ধি পায়। লুটেরাদের ভয়, অভিজাত ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা, অর্থনৈতিক সংকটে পীড়িত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি ও গ্রামাঞ্চলে নিরাপত্তার অভাব মিলে কৃষক অসন্তোষকে অগ্নিগর্ভ করে তোলে। এমন সময় গ্রামাঞ্চলে সর্বহারা লুটেরাদের ধ্ব কৃষকদের মনে ভীষণ ত্রাসের সৃষ্টি করে। নিজেদের রক্ষার জন্য কৃষকগণ অস্ত্র নিজের হাতে তুলে নেয় এবং সামন্ত প্রভুর উপর আক্রমণ করে। এছাড়া তারা বুর্জোয়াদের উপরও আক্রমণ করে। তারা সামন্তপ্রভুদের ম্যানরের ক্ষেতখামারের অধিকার সংক্রান্ত দলিলপত্র পুড়িয়ে দেয়।


উপসংহার:

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, ফ্রান্সের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতির মুখে ষোড়শ লুই সুদীর্ঘ ১৭৫ বছর পর ১৭৮৯ সালের ৫ মে রাজসভায় স্টেটস জেনারেল নামক জাতীয় সভায় অধিবেশন ডাকেন। কিন্তু একেই কেন্দ্র করে তৃতীয় সম্প্রদায় বিপ্লবের ডাক দেয়। তবে আস্তে আস্তে এটি সব শ্রেণির মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিপ্লব ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে নেপোলিয়নের উদ্ভব ঘটায়। ফরাসি বিপ্লব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তি লাভের প্রতিকৃত হয়ে আছে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!