নগর বিপ্লব কাকে বলে? নগর বিপ্লবের পটভূমি পর্যালোচনা কর।

admin

ভূমিকা : মানব সভ্যতার ধারাবাহিকতার এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ হলো কৃষি বিপ্লব। কৃষি আবিষ্কারকে বলা হয় মানব সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম বিপ্লব। একে নবোপলীয় বিপ্লবও বলা হয়। এ বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহকারী মানুষ খাদ্য উৎপাদনকারী মানুষে পরিণত হয়। এ সময় মানুষ যাযাবর জীবন ত্যাগ করে ক্রমেই ছোট ছোট গ্রামে বিভক্ত হয়ে গৃহে বসবাস করে। আর এই যুগ থেকে সভ্যতার সামনের দিকে এগিয়ে চলা। নব্য প্রস্তর যুগ পেরিয়ে নীলনদ ও গঙ্গা নদীর মধ্যবর্তী শুষ্ক স্থানে নগর সভ্যতার প্রথম সূচনা হয়।


নগর বিপ্লব কাকে বলে? নগর বিপ্লবের পটভূমি পর্যালোচনা কর।


নগর বিপ্লবের সংজ্ঞা :

নগর বিপ্লব বা Urban Revolution শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন অস্ট্রেলীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ডি. গর্ডন চাইন্ড। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত এই মতটি পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি তার ম্যান মেকস হিমসেক গ্রন্থে নগর বিপ্লবের পটভূমি, আকার, প্রকৃতি এবং আরবান রেভুলেশন প্রবন্ধে নগর বিপ্লবের উপাদানও বিচার্যমান ও প্রভাব বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি স্বীকার করেন নগর বিপ্লবের সংজ্ঞা দেওয়া সহজ নয়। নবোপলীয় যুগের শেষ দিকে মানুষ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অগ্রগতির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে এবং এই অগ্রগতির পরিপেক্ষিতে মানুষের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয় তাই নগর বিপ্লব। তিনি আরো বলেন, "সমাজ সংগঠন অর্থনৈতিক কাঠামো আবিষ্কারের প্রক্রিয়াকে নগর বিপ্লব বলে।


সামাজিক ইতিহাসের গুরুত্ব আলোচনা কর


নগর বিপ্লবের পটভূমি :

খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ অব্দের পূর্বেই নগর বিপ্লবের সূচনা হয়। অবশ্য সব জায়গায় একই কারণে একই সময়ে নগর বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। নিম্নে 'নগর বিপ্লবের' পটভূমি আলোচনা করা হলো।


১. নতুন নতুন আবিষ্কার : খ্রিস্টপূর্ব ৬,০০০ থেকে ৩,০০০ অব্দে মানুষ ষাঁড় ও বাতাসের গতিকে কাজে লাগাতে শিখে। লাঙ্গল, চাকাওয়ালা গাড়ি, পালতোলা নৌকা, তামার আকরিক থেকে নিষ্কাশনের জন্য প্রযুক্তি রাসায়নিক প্রক্রিয়া। ও ধাতুগুলোর ভৌত ধর্ম আবিষ্কার করে। আর এ সময় হতে মানুষ একটি সফল বর্ষপঞ্জি আবিষ্কার করে । এভাবে মানুষ একজন প্রকৃত নাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে শেখে। ফলে নতুন নতুন আবিষ্কার সভ্যতার প্রথম নগর বিপ্লবের সূচনা করে।


২. সেচ ব্যবস্থা ও উন্নত উৎপাদন পদ্ধতি ঃ সভ্যতার অধিকাংশ মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। কারণ এখান থেকে সহজেই খাদ্য সংগ্রহসহ খাদ্য উৎপাদন করা সহজ ছিল। নবোপলীয় বিপ্লবের ফলে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে সিরিয়া, ইরাকের মধ্য দিয়ে ইরান মালভূমি ও সিন্ধু উপত্যকার উপরে সম্পূর্ণ এলাকা ছড়িয়ে পড়ে। এ অঞ্চলে শিকারি, জেলে, কামার, কুমার, যাযাবর, উদ্যান পালক, যাযাবর মেষ পালক সকলেই বসবাস করত। এ সময় মিসরে প্রথম নীলনদে বাঁধ দিয়ে বন্যার পানিকে সেচ কাজে ব্যবহারের সূচনা হয়। একই সাথে তারা জঙ্গল কেটে পতিত উপর জমিগুলোতে উন্নত কৃষি কাজে ব্যবহার করে এ কাজ অবশ্য একা সম্ভব ছিল না। তাই তারা দলবদ্ধভাবে সেচ কাজে বাধ ও ফসল ফলাত।


৩. নতুন নতুন কৃষি পণ্য : চাষ ও উন্নত সেচ ব্যবস্থা আবিষ্কারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় নতুন নতুন কৃষি পণ্য চাষে মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়। তাই গম ও বার্লির সাথে তারা নতুনভাবে খেজুর, ডুমুর, জলপাই, ধান, রাই ও অন্যান্য খাদ্য চাষ করে। এ ধরনের ফলগুলো যেমন ছিল পুষ্টিকর তেমনি তা সংরক্ষণ ও চালান দেওয়াও ছিল সহজ। প্রথমে বনজঙ্গল থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হলেও তা পরে চাষে পরিণত করা হয়।


৪. উন্নত আবাসন ও দালান নির্মাণ : নবোপলীয় যুগে মানুষ যখন যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগল তখন থেকেই তারা নিজ বাসস্থান নির্মাণে আগ্রহী হয়। প্রথমদিকে তারা কাদামাটি দিয়ে ও কাঠ, ছন, বাঁশ দিয়ে ঘড়-বাড়ি নির্মাণ করলেও ক্রমেই তার উন্নতি হয়। রাজবংশের সূচনার যুগে রাজা তার রাজ দরবারের সুরক্ষার জন্য পোড়া মাটি দিয়ে (ইট) সুড়ঙ্গ তৈরি করতো। তবে দালান নির্মাণের জন্য আরো সময় অতিবাহিত হয়। এজন্য একার নয় বরং দলবদ্ধতার সূত্রপাত হয়।


৫. লেনদেন ব্যবস্থা ঃ নবোপলীয় যুগে কৃষক, কামার, কুমার, শিকারি, জেলে কারিগরের মধ্যে লেনদেনের ব্যবস্থা ছিল বিনিময়। এ সময় কৃষকের হাতে উদ্বৃত্ত ফসল থাকায় ও প্রয়োজনীয় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় লেনদেন হিসেবে বিনিময় ব্যবস্থার যাত্রা হয় । বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমে যার যা প্রয়োজন ছিল তা অন্যের সাথে বিনিময় করার মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করা হতো। কিন্তু নগর বিপ্লবের বহু পরে মানুষ তামা, রূপা, দস্তা ও ব্রোঞ্জের তৈরি মুদ্রা প্রচলন করে। যার মাধ্যমে বিনিময়ের জায়গায় ক্রয়-বিক্রয় চালু হয়।


৬. তামার আবিষ্কার ঃ মানুষের নগর বিপ্লবের সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো ধাতুর আবিষ্কার ও ব্যবহার। ধাতুর কাজের সাথে দু'ধরনের আবিষ্কারের বিষয় জড়িত। (১) তামা গরম করে ইচ্ছেমতো আকারে ঢালাই করা যায়। কিন্তু ঠাণ্ডা হলে তা পাথরের ফলার মতো ধারালো হয়ে ওঠে। কোনো কোনো পাথর বা মৃত্তিকাকে কাঠকয়লার সংস্পর্শে রেখে গরম করলে কঠিন, লালচে তীক্ষ্ণ ধাতু উৎপন্ন করা যায়। এছাড়াও ধাতু হিসেবে তামার সাথে টিনও পাওয়া যেত। যাতে তামা ও টিন একত্রে গলিয়ে সংকর ধাতু পাওয়া যেত। যার মাধ্যমে শক্ত ও কঠিন ধারালো হাতিয়ার বানানো যেত।


৭. যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি ঃ নব্য প্রস্তর যুগের একটি বড় আবিষ্কারের কৃর্তি হলো চাকা। প্রথমদিকে চাকাবিহীন শ্লেজ গাড়ির প্রচলন হলেও ঢাকা আবিষ্কার মানুষের যোগাযোগে নতুন গতি সঞ্চার করে। শুধু এক স্থান থেকে অন্যত্র যাওয়ায় নয় পণ্য আনা-নেওয়া ও পরিবহনেও চাকা দ্বারা তৈরি গাড়ি ব্যবহার হতো। সুমেরীয় অঞ্চলে ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ঢাকাওয়ালা গাড়ির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। ক্রীট ও মাইনর চাকাওয়ালা গাড়ির নিদর্শন পাওয়া যায় আরো আগে ।


৮. দিগ্বিজয় ঃ নগর বিপ্লবের সূচনার আগে মানুষের আবিষ্কারের ফলে সভ্যতার যেমন বিস্তার ঘটে তেমনি কিছুকাল ধরে যুদ্ধ ও হানাহানিও চলতে থাকে। গোষ্ঠির সাথে গোষ্ঠির আপোস যেসব সময় সহজে হয় তা নয়। অনেকের মতে, অস্ত্রের আবিষ্কার পশু শিকারের জন্য নাকি যুদ্ধের জন্য তৈরি তার জন্য সন্দেহ রয়েছে। এ সময় যুদ্ধ পরিচালনা ও এলাকা দখলের জন্য তারা বিভিন্ন এলাকা আবিষ্কার করে। যেসব জায়গায় পরবর্তী সময়ে নগর গড়ে ওঠে।


৯. দাস প্রথা ঃ প্রচলিত ধারণা মতে, দাসপ্রথার পিছনে কারণ হলো যুদ্ধ। যুদ্ধ একটি বিরাট আবিষ্কারে সাহায্য করে তা হলো জীবজন্তুর ন্যায় মানুষকেও পোষ মানানো যায়। পরাজিত শত্রুকে হত্যা না করে তাকে দাস বানানো যায়। এতে একদিকে যেমন তাদের উপর কর্তৃত্ব করা যাবে অন্যদিকে তাদের দ্বারা করা যাবে উৎপাদন। তবে দাস ব্যবস্থার জন্য শুধু যুদ্ধ দায়ী ছিল না। খাদ্যের জন্য অনেকে ধনী এলাকায় যেয়ে পেটে-ভাতে কাজ করত।


১০. রাজা ও রাজতন্ত্রের উদ্ভব : নগর বিপ্লবের আগেই দাসত্বের সঙ্গে প্রভুত্বের সূত্রপাত। এ সময় সুবিধাভোগী শ্রেণি হিসেবে শাসক রাজার উপস্থিতি লক্ষণীয়। মূলত মিসরের প্রথম যারা ও মেনেসের নেতৃত্বে সমগ্র মিসরে রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে রাজা ও রাজবংশ যুদ্ধ, যাদুক্রিয়া অর্থনৈতিক সাফল্যের দ্বারা তারা দাস ও অন্যান্যদের উপর কর্তৃত্ব করতো। এসব রাজ-রাজারা বহু দেব-দেবতায় বিশ্বাসী ছিলো। যাদুবিদ্যার আমলে কু-সংস্কারই ছিল রাজবংশের ভিত্তি।


উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, নগর বিপ্লবের সূচনা হতে দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয়। নানান আবিষ্কার ও ব্যবহারের মাধ্যমে যখন মানুষের জীবন সহজ হয়েছে তখন মানুষ যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে গিয়ে তাদের মধ্যে বাসস্থানের চাহিদা হয়। যার ফলে ধীরে ধীরে ঘর-বাড়ি থেকে শুরু করে সব কিছুর আবিষ্কার বেড়ে যায়। যা নগর বিপ্লবে সাহায্য করে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!