নগর বিপ্লবের ফলাফল পর্যালোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

প্রাগৈতিহাসিক যুগের শেষ ধাপ নব্য প্রস্তর যুগ নামে পরিচিত। এ যুগেই প্রথম কৃষি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এ সময় কৃষির সাথে মানুষ উন্নত হাতিয়ার তৈরিতেও সক্ষম হয়। কারণ এ যুগের শেষেই উন্নত সব ধাতুর আবিষ্কার ও ব্যবহার শুরু হয়। এ যুগে এসে মানুষ খাদ্য সংগ্রহকারীর জায়গায় খাদ্য উৎপাদনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এর থেকে সভ্যতার পদযাত্রা শুরু, বিস্তার ও বিকাশ নগরের ফলে। নগরের ফল শুধুমাত্র দুই-একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর ফলাফল ছিল বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী।


নগর বিপ্লবের ফলাফল পর্যালোচনা কর।


নগর বিপ্লবের ফলাফল :

নিম্নে নগর বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করা হলো :


১. রাজনৈতিক ফলাফল : গ্রাম পরিবেষ্টিত ও গ্রামীণ অর্থনীতি দ্বারা সমর্পিত নগর প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্রের আকার ধারণ করে। নগর রাষ্ট্র সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতিক জীবনে নতুন গতিধারা সৃষ্টি করে । এ নগর রাষ্ট্র কখনো কখনো ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। এছাড়াও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন ছিল নগর বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল। প্রাথমিকভাবে নগর রাষ্ট্র ছিলো ধর্মীয় প্রভাবাধীন। কিন্তু কালক্রমে একে কেন্দ্র করে রাজা ও রাজতন্ত্রের উৎপত্তি হয়। যারা প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে ।


২. সামরিক ফলাফল : নগর সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে নতুন গ্রামগুলো নগরের আওতায় আসতে থাকে। কাঁচামাল আমদানি ও নতুন এলাকাকে নগরে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পেশিশক্তির প্রয়োজন পড়ে। এর থেকে বিকাশ ঘটে। সামরিকবাদী চিন্তা। নগর বিপ্লবের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হলো আগুন ও চাকা। চাকাওয়ালা পরিবহন, ধাতু, আগুন, কৃষি, উদ্বৃত্ত, কারিগরি জ্ঞান সামরিকবাদকে তরান্বিত করে। দিগ্বিজয়ের নেশায় শক্তিশালী নগর রাষ্ট্রগুলো দুর্বলের উপর আক্রমণ করে। এতে প্রধান শক্তি ছিল সামরিক শক্তি।



৩. সামাজিক ফলাফল : নগর বিপ্লবের ফলে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক সংগঠনের ক্ষেত্রে নতুন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল যাকে সামাজিক বিপ্লব বলা যায়। এতে নবোপলীয় যুগের চিন্তা-চেতনার অবলুপ্তি ঘটে। এর জায়গায় নতুন সামাজিক চেতনা গড়ে ওঠে। এর ফলে সমাজে নতুন শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। সমাজে মানুষের কাজের যোগ্যতা ও দক্ষতার মাধ্যমে শ্রেণিবিভাজন তৈরি হয়। প্রথম শ্রেণি ভুক্ত ছিল রাজা, পুরোহিত। দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত হলো নাবিক, পণ্য বাহক, সৈনিক। তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত হয় কামার, কুমার, জেলে ও কৃষক।


৪. সাংস্কৃতিক ফলাফল : নগর বিপ্লবের ফলে মানুষের সামাজিক জীবনে যেমন নতুন ধারা সৃষ্টি হয়। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে। এর ফলে মানুষের সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটে। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাচেতনার চর্চ উৎকর্ষতা সাধনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এর ফলে লিখন পদ্ধতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধিত হয়। নগর বিপ্লবের আবিষ্কার লিখন ও লিপির আবিষ্কার। এর ফলে ভাষার আবিষ্কার ও তা ছড়িয়ে পড়তে কোনো সময় লাগেনি।


৫. অর্থনৈতিক ফলাফল : নগর বিপ্লবের তাৎক্ষণিক ফল ছিল প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত ফলাফল। এতে নগরে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর ফলে যে সভ্যতা যত বেশি উদ্বৃত্ত করতে পেরেছে তারাই তত বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে। উন্ন চাষাবাদ ও সেচব্যবস্থা, কৃষি উপকরণ উদ্ভাবন সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে, যেমন কৃষি প্রসারে ভূমিকা রাখে তেমন শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। মূলত নব্য প্রস্তর যুগের স্বনির্ভর অর্থনীতি পরিত্যাগ করে একটি সামগ্রিক অর্থনীতি গড়ে ওঠে।


৬. ধর্মীয় ফলাফল : নগর বিপ্লবের ধর্মীয় ফলাফল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত সম্পত্তির জন্ম আগে নাকি ধর্মের জন্ম আগে তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতভেদ আছে। অনেকে মনে করেন, ধর্মের প্রাথমিক স্তর হলো যাদুবিদ্যা। প্রাচীন সমাজে অবশ্য এ দুটি সমান তালে চলতো। কিন্তু নব্য প্রস্তর পরবর্তী নগর বিপ্লবের ফলে ধর্মের বিকাশ ঘটে। এ সময় ধর্ম চর্চা ও রক্ষার নামে পুরোহিত শ্রেণির উন্মেষ ঘটে। যাদের অর্থনীতির উৎস ছিল প্রদেয় খাজনা। এ সময় থেকে ধর্ম মানুষের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়। এ সময় ধর্মের প্রধান বিষয় ছিল বিভিন্ন দেব-দেবিতে বিশ্বাস স্থাপন। যেমন মিসরীয় ফারাও ছিলেন সূর্যের দেবতা (আমন রে)।


৭. লোহার আবিষ্কার : নগর সভ্যতায় মানুষের প্রাচুর্য যেমন বেড়েছে তেমনিভাবে কারিগরি দক্ষতাও বেড়েছে। লোহার আবিষ্কার কখন কিভাবে তা বলা কঠিন। ধারণা করা হয়, নগর বিপ্লব শুরুর যুগে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ অব্দে প্রথম লোহার আবিষ্কার হয়। লোহা আবিষ্কার ও ব্যবহারে হিটাইট বেশি পারদর্শী ছিল। তবে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে সুমেরীয়দের লোহার আবিষ্কার অজানা ছিল। এই লোহা কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাণসহ অস্ত্র-শস্ত্র নির্মাণে প্রাচীন সভ্যতাগুলো সামরিক শক্তিতে বলিয়ান হয় ।


৮. মন্দিরের বিকাশ : নগর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেমন ধর্ম বিকাশ লাভ করে। তেমন ধর্ম চর্চার জন্য গড়ে ওঠে মন্দির। জিগুরাট ছিল সুমেরীয়দের নগর দেবতার মন্দির। এটি মূলত একটি কৃত্রিম পাহাড়। মাটি থেকে ৩৫ ফুট উঁচু। তাদের ধারণা দেবতা স্বর্গ থেকে মন্দিরে নেমে আসে। মন্দির কেন্দ্রিক ধর্ম পালন শুরু হয়।


৯. আয়তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি : নগর বিপ্লবের ফলাফল হলো এর আয়তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি । এ সময়ে পূর্বে একটি গ্রামে অনধিক ২০০-৪০০ জন মানুষ বসবাস করত। কিন্তু নগর বিপ্লবের সাথে সাথে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। একটি বড় নগরে জনসংখ্যা ছিল ৫০০০ জন। সর্বনিম্ন ছিল ২০০০/৩০০০ জন। এভাবে জনসংখ্যা বাড়ার ফলে নগরের আয়তন ক্রমাগত বাড়তে থাকে।


১০. রাজতন্ত্র ও রাজ্য : নগর বিপ্লবের ফলে নগরকে শাসনের জন্য রাজা ও রাজতন্ত্রের উৎপত্তি ঘটে। এ সময় মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় প্রায় বিশিষ্ট ১৫-২০টি নগর ছিল। একই নদীর পানি, জীবনযাপন, ধর্ম পালন ছাড়াও ভাষা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ ছিল। প্রশাসনিক দিক দিয়ে রাজা ও রাজতন্ত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল।


পরিশেষে বলা যায় যে, নগর বিপ্লবের ফল শুধুমাত্র একটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি সামাজিক জীবনে যেমন প্রভাব ফেলে। তেমনিভাবে, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনেও প্রভাব পড়ে। কৃষক থেকে শুরু করে সকলের জীবনধারা পাল্টে যায় নগর বিপ্লবের ফলে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!