কোন সময়কে প্রস্তরযুগ বলা হয়? পুরানো প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।

admin

ভূমিকা : মানব সমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ চিহ্নিত করার জন্য ঐতিহাসিকরা ইতিহাসের সময়কালকে শ্রেণিবিভাগ করেছেন। মানুষের উৎপত্তি, বিকাশ ও সময়ের পদচিহ্নে ঐতিহাসিকরা সভ্যতার কালকে প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা— প্রাক-ইতিহাস, ইতিহাস, প্রায় ইতিহাসের যুগ। মানব সমাজের যে সময়কালের কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না তাকে প্রাক-ইতিহাস বলে । একেই মূলত বলা হয় প্রস্তরপূর্ব যুগ ।


কোন সময়কে প্রস্তরযুগ বলা হয়? পুরানো প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।

প্রস্তরপূর্ব যুগ : পুরানো প্রস্তর যুগের পূর্বে কোনো কোনো ভূবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক আরো একটি যুগের কথা উল্লেখ করেন। যা পূর্ব প্রস্তর যুগ নামে পরিচিত। প্রস্তর পূর্ব যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও এ যুগ ছিল পাথর ব্যবহারের সুচনার যুগ। ঐ সময় স্বাভাবিক অবস্থায় বা অমার্জিতভাবে ভাঙ্গা পাথর ব্যবহার করা হতো। যদিও প্রস্তর পূর্বযুগ সম্পর্কে প্রমাণ দেবার মতো কোনো ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। এছাড়া কৃষিকাজ, পশুপালন, ধর্ম, সমাজ সংগঠনের কোনো অস্তিত্বও তখন ছিল না। এ যুগের সূচনা প্রায় ১০ লক্ষ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এবং এর সমাপ্তি ঘটে প্রায় ৩ লক্ষ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। এ যুগের মধ্যে পিকিং ও জাভা মানুষ উল্লেখযোগ্য।


পুরানো প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য :

নিম্নে সভ্যতার বিশেষ অংশ হিসেবে পুরানো প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল -


১. খাদ্য : পুরানো প্রস্তর যুগের মানুষ নিজে যেমন খাদ্য উৎপাদন করতে পারতো না। তাই, তারা প্রকৃতির উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল। তারা ছিল মূলত খাদ্য সংগ্রহকারী। শিকার করে ও আহরণ করে খাদ্য সংগ্রহ ছিল তাদের প্রধান পেশা। তারা ফলমূল ও সবজি ভোজী ছিল। তারা বড়- ছোট বন্য কিংবা বর্তমানের গৃহপালিত সব ধরনের পশু শিকার করতো। তাদের ব্যবহৃত হাতিয়ার ও তাদের কংকাল দেখে অনুমান করা হয় তারা দক্ষ শিকারি ছিল। তারা সাধারণে দলবদ্ধভাবে শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ করতো।


২. বাসস্থান : পুরানো প্রস্তর যুগের মানুষ ছিল যাযাবর। তাই বিভিন্ন স্থানে বসবাসের সময় বিভিন্ন আশ্রয়স্থল তৈরি করেছে। এ সময় তারা সহজে খাদ্য পেতে তৃণভূমি, নদী, সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতো বেশি। খাদ্য ও পশু শিকারের জন্য তাদেরকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যেতে হতো। তাদের কোনো স্থানী আশ্রয়কেন্দ্র ছিল না। যেখানে যেত সেখানেই অস্থায়ী আবাসস্থল গড়ে তুলতো। প্রথমদিকে তারা খোলা আকাশের নিচে থাকলেও কোথায় পাহাড় বা গুহা দেখলে সেখানে বসবাস করত। তাদের নির্মিত ঘরগুলো ছিল কুঁড়ে বা তাঁবুর মতো। ঘরগুলো তৈরিতে তারা চুনাপাথর ও কাদা ব্যবহার করতো। তবে কখনোই তারা এক স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করতো না।


৩. বস্ত্র : বনমানুষ বস্ত্রহীন উলঙ্গ থাকলেও পুরানো প্রস্তর যুগের শেষ দিকে মানুষ বিশেষ করে নিয়ভাধাল মানুষ শীত থেকে বাঁচার জন্য চামড়া ও গাছের বাকল দিয়ে গা ঢাকতে অভ্যস্ত ছিল। তবে বরাবরই তারা পশুর চামড়া, গাছের ছাল-বাকল দিয়ে লজ্জা নিবারণ করতো। পরে অবশ্য আস্ত একটি পশুর চামড়া তারা গায়ে জড়িয়ে রাখতে শেখে। এর পরে তারা চামড়াকে গায়ের মাপে সেলাই করে নিতো। সেলাইয়ের জন্য ব্যবহার করত হাঁড়ের তৈরি সূচ ও শক্ত গাছের বাকল দিয়ে সুতার কাজ করতো।


৪. হাতিয়ার : পুরানো প্রস্তর যুগের প্রথম থেকেই মানুষ শিকারের জন্য বিভিন্ন হাতিয়ার বেছে নিয়েছে। গোড়ার দিকের হাতিয়ার সম্পর্কে কোনো কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদ সন্দেহ পোষণ করেন। তাদের ধারণা, এগুলো নিতান্তই পাথরের টুকরা। তবে অন্যান্য প্রত্নতত্ত্ববিদের ধারণা, তারা হিম যুগ শুরুর আগেই হাতিয়ারের ব্যবহার শিখে নিয়েছিল। পিকিং এবং জাভা মানুষের ধারণা থেকে জানা যায় তারা হাতিয়ারের ব্যবহার জানতো ।

প্রথমদিকে তারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে চকমকে পাথর। একখণ্ড পাথর ভেঙ্গে তারা হাতিয়ার তৈরি করত। পরবর্তীতে তারা হাতিয়ার তৈরিতে হাড়ও ব্যবহার করতো।


৫. হাতিয়ার প্রাপ্তি স্থান : পুরানো প্রস্তর যুগে ব্যবহৃত হাতিয়ারগুলো পাওয়ার গিয়েছে হিম যুগের ইউরোপ ও ইউরেশিয়ার উত্তরাঞ্চলে আল্পস, বলকান, বাকেশাস, হিন্দুকুশ ও হিমালয় পর্বতকে যদি একটা রেখা করা হয় তবে তার উত্তর দিকের অঞ্চল মূল পাথরের হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে আফ্রিকার সমস্ত অঞ্চল, পশ্চিম ইউরোপও ভারতবর্ষে। তাছাড়াও চীন, উত্তর চীন, উত্তর ভারতের মোহান উপত্যক ও মালয় উপদ্বীপ থেকে তৃতীয় আরেক ধরনের হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে যা পাথর বা মূল পাথরের তৈরি নয়, নুড়ি পাথরের তৈরি।


৬. হাতিয়ার তৈরি কৌশল : মানুষের ইতিহাসের পাঁচ লক্ষ বছরের মধ্যে সাড়ে চার লক্ষ বছরই হাতিয়ার বলতে গে ছিল হাত কুড়াল। আঘাতের পর আঘাত দিয়ে হাত কুড়ালগুলোর উপরিভাগ রুচিকর, সূক্ষ্মতা দান করে ছোট ছোট এস কাঠের টুকরার সাথে সেগুলো বেঁধে ব্যবহার করা হতো। কালক্রমে ফলক পাথরের হাতিয়ার বানানোর জন্য শুধু চকমকি পাথরের ব্যবহার শুরু হয়। এতে হাত কুড়ালের সাথে পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার শুরু হয়।


৭. আগুন আবিষ্কার : পুরানো প্রস্তর যুগের মানুষের প্রধান আবিষ্কার হলো আগুন। তবে ঠিক কোন সময় থেকে আগুনের আবিষ্কার হয় তা জানা যায় না। তবে পিকিং মানুষেরা যে আগুনের ব্যবহার জানত তা তাদের নির্মিত থেকে বোঝা যায়। আফ্রিকার কোনো কোনো অঞ্চলেও আগুন আবিষ্কারের চিহ্ন পাওয়া যায়। মানুষ আদিম অ আগুন আবিষ্কার জানতো না। তবে অনেক পরে হিম যুগে তারা চকমকি পাথর ঢুকে বা কাঠে কাঠে ঘষে আগুন তৈরি কৌশল শিখেছিল। যা ছিল ঐ সময়ের বৈপ্লবিক আবিষ্কার।


৮. সমাজ : সংগঠন বাঁচার তাগিদে পুরানো প্রস্তর যুগের মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাস ও শিকারের কাজ করতো। মর্গানের মতে, মানুষ জোট বেঁধেছে জাতি সম্পর্কের ভিত্তিতে একই পূর্ব-পুরুষ থেকে যাদের জন্ম। তিনি একে জেনা বলেন, কোনো কোনো নৃ-বিজ্ঞানী বলেছেন ক্ল্যান। তবে বড় শিকারি পাল ধরতে তাদের বড় সংগঠন হলো ট্রাই অনেকগুলো ক্ল্যান নিয়ে একটি ট্রাইব গঠিত হতো। পরে শিকারি পশু ভাগাভাগি হতো ক্ল্যানের মধ্যে। অর্থাৎ, শিকারের চেতনা থেকে পুরানো প্রস্তর যুগে সমাজ সংগঠন গড়ে ওঠে।


৯. ধর্ম বিশ্বাস : আদি প্রাচীন প্রস্তর যুগের পূর্ববর্তী পর্যায়ে মানুষের মনে ধর্ম সম্বন্ধে ধারণার উৎপত্তি হয় বলে কারে কারো মত রয়েছে। যদি বর্তমান যে ধর্ম তার উদ্ভবও অনেক পরে হয়েছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখলে একে তার দেবতা মনে করতো। তারা অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাস করতো। তারা যাদু বিশ্বাস ও অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসী ছিল। মানুষের মধ্যে আত্মার অমরত্ব সম্বন্ধে ধারণা জন্মে।


১০. শিল্পকলা : পুরানো প্রস্তর যুগে মানুষ শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় যেমন চিত্রকলা, ভাস্কর্য, খোদাই কর্মে পারদর্শ ছিল। এ সময় চিত্রকলা সবচেয়ে এগিয়ে ছিল। কারণ চিত্র ছিল তাদের ভাষার মাধ্যম। বিশেষ করে তারা গুহা চিত্রে বেশি পারদর্শী ছিল। এর মধ্যে আলতানিরা গুহা অন্যতম। শুধু ফ্রান্স ও স্পেনেই পাওয়া গিয়েছে প্রায় ৭০টি চিত্রের গুহা। এছাড়া তারা পুতির মালা, শিরাবরণ, বালা, গলার হার, বাজুবন্ধ, কোমরবন্ধ, ঝুমকা ইত্যাদি ব্যবহার করতো।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মানব সভ্যতার ইতিহাস এক দিনের নয়। লক্ষ বছর অতিক্রম করে আজকের এই আধুনিক সভ্যতার বিকাশ। পুরানো প্রস্তর যুগ থেকে সভ্যতার উন্নতি শুরু হয়। কারণ এ সময় আগুনে আবিষ্কার ছিল। তাদের প্রধান কৃতি। তাই উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো পুরানো প্রস্তর যুগে পাওয়ার মাধ্যমে সভ্যতা সম্পর্কে জানা ঐতিহাসিক ও নৃ-বিজ্ঞানীদের সহজ হয়েছে।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!