ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ দাও ।

admin

ভূমিকা :

১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিপ্লব সংগঠন পরিবেশ শুধু তার নিজস্ব স্থান থেকে তৈরি হয় না। এটি পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকেও প্রভাবিত হয়ে থাকে।তৎকালিন ইউরোপের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ইউরোপে এমনভাবে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল যে ফ্রান্সে তা একটি বিপ্লবের সৃষ্টি করেছিল। নিম্নে ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ দেওয়া হলো ।


, ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ দাও ।


রাজনৈতিক অবস্থা :

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে সমগ্র ইউরোপে এক দূর্বিষহ পীড়াদায়ক রাজনৈতিক পরিিষ্টিতি বিদ্যমান ছিল। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :


১. আমলাতন্ত্র : ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপের সরকারগুলো আমলাতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করতো। সরকার ও প্রশাসন বিভাগ ছিল মুষ্ঠিমেয় কয়েকজনের হাতে কুক্ষিগত।
জনগণের অধিকার বা স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদৌ ছিল না। রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক প্রতিনিধি সভা ছিল বটে, কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ছিল রাজা কর্তৃক মনোনীত। স্বাধীনভাবে কাজ করার কোনো ক্ষমতা তাদের ছিল না।


২. স্বেচ্ছাতন্ত্র : মধ্যযুগের ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহে প্রকট স্বেচ্ছাচারিতার বিকাশ ঘটে। সর্বপ্রকার মানবাধিকারের মুলে কুঠারাঘাত করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্বৈরাচারী শাসন, তৎকালীন রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না। রাজাই ছিল সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। এ প্রসঙ্গে চতুর্দশ লুই বলেন, 'আমিই রাষ্ট্র' আর ষোড়শ লুই বলেন, 'আমি যা তাই আইন তৎকালীন রাষ্ট্রে স্বেচ্ছাতন্ত্র সর্বশিখরে পৌঁছেছিল।


৩. স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র : অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ছিল রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল রাজবংশোদ্ভূত কোনো বিশিষ্ট ভাগ্যবান ব্যক্তির সম্পত্তি। তাই স্বীয় সম্পত্তি রক্ষার্থে রাজা ছিলেন চরম স্বেচ্ছাচারী। একনায়কতন্ত্র বা একাধিপত্য ছিল রাজার মূলমন্ত্র।


৪. সামন্ততন্ত্র : ফরাসি বিপ্লব পূর্ব যুগে ইউরোপে সামন্ততন্ত্র বিরাজমান ছিল। ভূস্বামীগণ শাসন ও শোষণকার্য পরিচালনা করতেন। কৃষক ও ক্রীতদাসদের উপর সামন্ত শ্রেণিরা অত্যাচার চালাতো।


৫. ঈশ্বর প্রদত্ত রাজতন্ত্র : মধ্যযুগীয় সনাতন শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্র পরিচালনায় “ঈশ্বর প্রদত্ত” অধিকার” দাবি করতো। তারা ভারত জনগণকে শাসন করার জন্য ঈশ্বর তাদের নিয়োগ করেছে। তাই নির্যাতন, নিপীড়ন, উপীড়ন এসবই যেমন নিয়তি সুনির্দিষ্ট করে লিখে রেখেছিল জনসাধারণের ললাটে। রাজার অবৈধ কার্যকলাপের সমালোচনা করার কল্পনাও জনসাধারণ করতে পারতো না।


৬. রাজার দায়িত্বহীনতা : ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের রাজারা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও দায়িত্বহীতার কারণে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করতো। অবশ্য অনেক রাজাই ব্যতিক্রম ছিল। যেমন- চতুর্দশ লুই স্বৈরাচারী হলেও জনগণের কল্যাণসাধনের চেষ্টা করতেন। অন্যান্য রাজারা বেশিরভাগ ছিল দুর্বল, বিলাসী ও অকর্মণ্য।


৭. ক্ষমতার অসমতা : ফরাসি বিপ্লব যুগে আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক রাজা ও ভূস্বামীদের মধ্যে ক্ষমতার সমতা ছিল না। তারা যথেচ্ছাভাবে ক্ষমতার চর্চা করতেন। দুর্বল রাজ্যগুলোকে সবল রাজ্য গ্রাস করতো।


৮. দুর্নীতিপরায়ণ শাসনব্যবস্থা : ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপে বিশেষ করে ফ্রান্সে প্রায় ৪০টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত অঞ্চল ছিল। এসব বিভক্ত অঞ্চলে যেসব উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিল তারা নিজেদের ইচ্ছামতো শাসনকার্য পরিচালনা করতো। এমনকি তারা রাজাদের এড়িয়ে চলতো। তৎকালীন শাসনব্যবস্থায় কোনো নিয়মনীতি না থাকায় রাজ্যের সর্বস্তরের শাসনব্যবস্থা দুর্নীতিতে ভরে গিয়েছিল।


৯. বিচারব্যবস্থা : ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে একমাত্র ইংল্যান্ড ছাড়া ইউরোপীয় আর কোনো দেশে সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থার প্রচলন ছিল না। বিচারকগণ রাজা কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। রাজবংশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় এরূপ রায় দেওয়ার ক্ষমতা তাদের ছিল না। অনেকক্ষেত্রে বিচারালয়গুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট বিচার ক্ষমতা থাকতো না। এমনকি আইনকানুনগুলোও সংকলন বা  সংরক্ষণ করা হতো না।


১০. ইনটেনডেন্টগণের অত্যাচার : তৎকালীন ফ্রান্সের আমলারা রাজানের দুর্বলতার সুযোগে বীর স্বার্থের জন্য উনা হয়ে উঠে। এসব আমলা কর্তৃক নিযুক্ত ইনটেনডেন্টগণ দেশে শাসনের নামে শোষণ করতে থাকে। তাদের চরম উচ্ছ্বলতায় সর্বস্তরের জনগণের জীবন একেবারে দুর্বিষহ হয়ে উঠে। এসব ইনটেনডেন্টগণ দেশ ও জাতির কোনোরূপ কল্যাণ না করে স্বীয় ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক তৎপর ছিল।


অর্থনৈতিক অবস্থা :

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিশেষ করে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করে। নিম্নে বিপ্লবের প্রাক্কালে ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা আলোচনা করা হলো :


১. কৃষি ব্যবস্থা : ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষি ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সমাজে মর্যাদা লাভ করতে হলে জমির মালিক হওয়া ছিল আবশ্যক। এ সম্মান অর্জন করার জন্য সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষ তাদের আয়ের মোটা অংশ দিয়ে জমির মালিকানা আদায় করতো।

লেফেভারের মতে, কৃষি ব্যবস্থার অগ্রাধিকার থাকলেও একথা সত্য যে ফ্রান্সের কৃষি ব্যবস্থা বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর ছিল। প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় ঘটলে কৃষকদের দুঃখকষ্টের কোনো সীমা থাকতো না।


২. অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চরম বৈষম্য : তৎকালীন ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চরম বৈষম্য ছিল। সমাজের নিম্নস্তরের জনগণের এমনিতেই কোনো আয়ের পথ ছিল না। তারপরও তাদের কর প্রদান করতে হতো। শুধু তাই নয় তারা চরম লাঞ্ছনার ও অপমানের মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করতো।


৩. কৃষির উন্নতিতে বাধা : অর্থনৈতিক সফলতার মূল চাবিকাঠি ছিল কৃষি ব্যবস্থা। কিন্তু এর উন্নতির জন্য তেমন কোনো চেষ্টা করা হতো না এবং উন্নতির পথে বিভিন্ন বাধাবিপত্তি ছিল। খাদ্যশস্য রপ্তানি এবং অবাধ বাণিজ্য নিষিদ্ধ ছিল। দেশের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রয় করে ন্যায্য মূল্য পেত না। সরকার মনে করতেন সে দেশের খাদ্য যদি বাইরে চালান দেওয়া হয় তাহলে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। এসব বিভিন্ন কারণে কৃষির উন্নতি সম্ভব হতো না।


৪. লবণ ও স্থানীয় কর : ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লবের পূর্বে সরকার কর্তৃক সেখানকার লবণ কর ছিল সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যবস্থা। সরকার নিজে লবণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতো এবং জনগণকে সর্বনিম্ন সাত পাউন্ড লবণ ক্রয়ে বাধ্য করতো। ফ্রান্সের সরকার কর্তৃক লবণ কর ছাড়াও স্থানীয় অনেক কর ছিল। স্থানীয় করগুলো আরোপ করে জনগণকে চরমভাবে অতিষ্ঠ করা হতো।


৫. অভিজাত শ্রেণির বিলাসব্যসন: তৎকালীন সমাজের বিলাসবান ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাত্রা নির্বাহের অধিকার ছিল এককভাবে অভিজাত শ্রেণির। তারা ভোগবিলাসিতার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতো। যার ফলে রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে যায়। আর এ অর্থসংকটে ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে সাহায্য গ্রহণ করতে থাকে। তবে ফ্রান্স ছিল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত । কারণ ইংল্যান্ডে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের ব্যবস্থা প্রচলিত থাকায় সেখানে অর্থসংকট দেখা দিতে পারেনি।”


৬. বাণিজ্য ব্যবস্থা : ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাণিজ্যিক ব্যবস্থা একটি অন্যতম দিক। এ সময় ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কেন্টাইলবাদকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। আর এজন্য শিল্প দ্রব্যের আমদানি পণ্যের ওপর শুদ্ধ বৃদ্ধি করে দেশকে বৈদেশিক প্রতিবন্ধকতার হাত থেকে রক্ষা করা হতো। এ ব্যবস্থা প্রচলন থাকায় স্বাভাবিকভাবে কর দেশের সাথে অন্য দেশের বাণিজ্য ব্যাহত হতো।


সামাজিক অবস্থা :

১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের সামাজিক অবস্থা বিভিন্ন কুসংস্কারে জর্জরিত ছিল। এসময় ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থা বৈষম্য ও দুর্নীতির শত বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। ফরাসি বিপ্লবের কারণ হিসেবে ধারণা করা হয় ফ্রান্সের দুর্নীতি ও শোষণের সমাজব্যবস্থাকে। নিম্নে বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপের সমাজব্যবস্থা আলোচনা করা হলো ।


১. সমাজব্যবস্থা : ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থা ছিল তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। যেমন প্রথম গাজ শ্রেণি, দ্বিতীয় অভিজাত শ্রেণি এবং তৃতীয় সাধারণ শ্রেণি। প্রতিটি শ্রেণিকে থার্ড স্টেট বলা হতো।


২. যাজক শ্রেণি : সাধারণ যাজক শ্রেণির লোকেরা ছিল সমাজের চাবিকাঠি। তারা ছিল প্রভাবশালী। যাজকদের উপর অর্পিত হতো বিভিন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্ব। যাজক শ্রেণি আবার দুই রকমের ছিল। প্রথম যাজক শ্রেণি ছিল সুবিধাভোগী এবং উচ্চতর বংশীয়। দ্বিতীয় যাজক শ্রেণি ছিল নিম্নবংশীয়। এদের অবস্থা ছিল অনেকটা সাধারণ শ্রেণির মতো।


৩. অভিজাত শ্রেণি : ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের তথা ইউরোপের সমাজব্যবস্থা অভিজাত শ্রেণি ছিল সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান। মধ্যযুগের সমাজতন্ত্রের উদ্ভবের ফলে ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থায় অভিজাত শ্রেণির উদ্ভব হয়। এ অভিজাতদের প্রধান অধিকার ছিল বংশকৌলিন্য।


৪. যাজক শ্রেণির সুযোগ সুবিধা : তৎকালীন ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থায় যাজক শ্রেণি প্রচুর সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো। যেমন- যাজক শ্রেণি ভূমি মালিকানাসহ নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো। মৃত্যু কর, প্রার্থনা কর, বিবাহ নথিবদ্ধ করার করাসহ প্রভৃতি কর যাজক শ্রেণি ভোগ করতো এবং গির্জায় জমিদারি আয় ভোগ করতো। উল্লেখ্য যে, এগুলো ভোগ করতো উচ্চ বংশীয় যাজক শ্রেণি।


৫. অভিজাত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য : ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থার সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল অভিজাত শ্রেণি। ঐ অভিজ্ঞাত শ্রেণির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন- অভিজাত শ্রেণি তাদের বংশমর্যাদাকে বিশেষভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করতো। অভিজাত শ্রেণির আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তারা এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের বিবাহ দিতো না। ভ বংশের জমিদারি যাতে সন্তানদের মধ্যে বিভক্ত না হয়ে যায় এজন্য তারা "Law of Primogemiture" বা উত্তরাধিকারী আইন দ্বারা একমাত্র জ্যেষ্ঠ পুত্রকে পিতার জমিদারীতে উত্তরাধিকারি দিতো।


৬. অভিজাতদের সুযোগ সুবিধা : অভিজাত শ্রেণি ছিল সবেচেয়ে বেশি সুযোগসুবিধা ভোগকারী শ্রেণি। এ শ্রেণি ভূমি ও কৃষকদের উপর বহু সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো। খামার প্রথার ফলে অভিজাতরা প্রচুর অর্থ পেত। এছাড়া অভিজাত শ্রেণি নানা প্রকার সামন্ত কর ভোগ করতো। রাজার সভাসদ সেনাপতি এবং রাজ্যের বিভিন্ন উচ্চ কর্মচারী পদে অভিজ্ঞাত শ্রেণির ছিল একচেটিয়া আধিপত্য।


৭. অভিজাতদের অহংকার : অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় রাষ্ট্রের বিশেষ করে ফ্রান্সের অভিজাত শ্রেণি ছিল সর্বাধিক প্রতিপত্তি ও সুবিধাভোগী শ্রেণি। তারা সাধারণ শ্রেণির লোকদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতো। এমনকি সাধারণ লোকদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কসহ নানাপ্রকার সমাাজিক বন্ধন, কাজকর্মে লিপ্ত হতে তারা অত্যন্ত ঘৃণাবোধ করতো। অভিজাতরা বিশ্বাস করতো যে, মেহনতি মানুষের শ্রমভিত্তিক জীবন ঈশ্বরই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।


৮. তৃতীয় সাধারণ শ্রেণি : ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ইউরোপীয় বিশেষ করে ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থার সাধারণ শ্রেণি বলতে বা Third Estate বলতে সাধারণত অভিজাত ও যাজক শ্রেণি ছাড়া বাকি সকলকে বুঝায়। অবশ্য সাধারণ শ্রেণির মাঝেও ধনী শ্রেণি ছিল উল্লেখযোগ্য। যেমন- ফরাসি দেশে ধনী বুর্জোয়ারা ছিল সাধারণ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এবং সাধারণ শ্রেণি সবেচেয়ে বেশি ছিল কৃষকরা।


৯. বঞ্চিত সর্বহারা : ফরাসি বিপ্লবে প্রাক্কালে ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণি ছিল সবচেয়ে বঞ্চিত ও নিগৃহীত। - মাঠে, কলকারখানায় এবং সর্বত্রই তাদের কাজের যোগান দিতে হতো। কিন্তু সবকিছুর ভোঙা ছিল অভিজ্ঞাত শ্রেণি। সর্বপ্রকার অত্যাচার ও নিষ্পেষণের শিকার ছিল এ সর্বহারা দল।


১০. সাধারণ শ্রেণি অধিকারহীন : তৎকালীন ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থায় সাধারণ শ্রেণির বেশি অংশ ছিল স্বীয় দেশের যাবতীয় অধিকার হতে বঞ্চিত। তারা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ছিল অধিকারচ্যুত। অপমান, লাঞ্ছনা আর দুর্দশা ছিল তাদের নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার।


১১. ভূমি ক্রীতদাসের প্রচলন: ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থার ভূমি ক্রীতদাসের প্রচলন ছিল। এ প্রথার ফলে, ভূমির সাথে তাদের জীবন সম্পৃক্ত থাকায় তাদের চরম ভাগ্যবিড়ম্বনা ঘটতো মাঝে মাঝে কারণ যখন কোনো ভূমি বিক্রি করা হতো তখন তারাও বিক্রি হয়ে যেতো। যাজক ও অভিজাতদের প্রদত্ত সীমাহীন নির্যাতন ভোগ করে তাদেরকে বেঁচে থাকতে হতো।


ধর্মীয় অবস্থা :

ফরাসি বিপ্লবপূর্ব যুগে ধর্মীয় ক্ষেত্রেও অনেক অনাচার পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে এ সম্পরে আলোচনা করা হলো


১. দুই শ্রেণির গির্জা : ইউরোপের খ্রিষ্টানরা দুই শ্রেণির গির্জার অধীনে বিভক্ত ছিল। যথা : ক্যাথলিক গির্জা ও প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জা। ধর্মীয় ক্ষেত্রে রোমান ক্যাথলিক গির্জার সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল মার্টিন লুথারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ধর্মসংস্কার আন্দোলন। ফলে রোমান ক্যাথলিক গির্জার ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান ও ক্যাথলিক সম্প্রদায়ে মধ্যে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ হয়েছিল।


২. যাজকদের দায়িত্ব ও ভোগবিলাস : যাজকদের ওপর মানুষের ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনের উন্নতির দায়িত্ব অর্পিত ছিল। কিন্তু তারা ধর্মের নামে বলপূর্বক কর আদায় করতেন। অধিকন্তু তারা সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন এবং সুরম্য অট্টালিকায় রাজকীয় জীবনযাপন করতেন। ব্যক্তিগত জীবনেও তারা ছিলেন দুর্নীতিবাজ এবং ভোগবিলাসী। গির্জার অভ্যন্তরে ব্যভিচারে লিপ্ত হতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করতেন না। তাদের প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই তারা আর একটি শক্তিশালী ধর্মীয় রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন।


৩. দু শ্রেণিতে যাজকের আবির্ভাব : খ্রিষ্টানদের ধর্মপ্রচারের জন্য তখন দু শ্রেণির যাজকের আবির্ভাব ঘটে। যথা : ঊর্ধ্বতন যাজক ও অধস্তন যাজক। ঊর্ধ্বতন যাজকগণ ছিল অভিজাত বংশের। তারা স্বয়ং রাজা কর্তৃক নিযুক্ত হতো। তারা বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক ছিল। তাই বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন করতো। অপরদিকে অধস্তন যাজকগণ ছিল দুর্দশাগ্রস্ত।  তারা ঊর্ধ্বতন যাজকদের আজ্ঞাবহ ছিল। তারা বেঁচে থাকার জন্য কোনো পারিশ্রমিক পেত না।


উপসংহার:

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, প্রাক ফরাসি বিপ্লব ইউরোপের রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র এবং আমলাতন্ত্র শাসন, শোষণ ও নির্যাতন ইউরোপের জনগণকে রাজতন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। সামাজ ব্যবস্থায় শ্রেণি বৈষম্য যাজক শ্রেণি ও অভিজাত শ্রেণি ছাড়া অন্য সবাইকে বিশুদ্ধ করেছিল। এসবের ঢেউ এসে যখন ফ্রন্সে লাগে তখন বিপ্লবের সৃষ্টি হয়েছিল।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!