ফরাসি বিপ্লবের প্রধান প্রধান কারণগুলো আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

মানবসভ্যতার ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লব একটি যুগান্তকারী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৭৮৯ সালের এ বিপ্লব যেমন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে মূখ্য ভূমিকা পালন করে তেমনি বিশ্ব রাজনীতির নব মূল্যায়নে এ বিপ্লব এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাই পূর্ববর্তী বিপ্লবের চেয়ে ফরাসি বিপ্লব ছিল স্বতন্ত্র ও সর্বস্পর্শী। শতাব্দীর সঞ্চিত কুসংস্কার, আনাচার ও বীভৎসতার বিরুদ্ধে এটি ছিল প্লাবনের ন্যায় এক দুর্দান্ত শক্তি। ফ্রান্সের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায়ের ক্ষোভ, ব্যথা, বেদনা আর বিদ্রোহের চূড়ান্ত রূপ হলো ফরাসি বিপ্লব।


ফরাসি বিপ্লবের প্রধান প্রধান কারণগুলো আলোচনা কর।


ফরাসি বিপ্লবের কারণ :

ইতিহাসের অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনার মতো ফরাসি বিপ্লবের অভ্যুত্থান ঘটে নানাবিধ শক্তির সম্মিলিত চাপের ফলে। ছোট ছোট অনেক স্রোতধারা যেমন একযোগে মহাপ্লাবনের সৃষ্টি করে তেমনি ফরাসি অনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত দুঃখ, লাঞ্ছনা ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে কারণ হিসেবে কাজ করে এবং প্লাবনের মতোই এ বিপ্লব এক দুর্জয় শক্তি নিয়ে গতানুগতিক সীমারেখা ভেদ করে এক মহাপ্লাবনের সৃষ্টি করে। দীর্ঘ যুগব্যাপী ফরাসি জনগণ যে নাটকীয় প্রক্রিয়ায় তাদের অতীত গ্লানি থেকে পরিত্রাণ লাভের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল ফরাসি বিপ্লব ছিল সে নাটকেরই আকস্মিক ভয়াবহ ও চূড়ান্ত অক্ষ মাত্রা।


রাজনৈতিক কারণ :

ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে রাজনৈতিক কারণকে উল্লেখ করে ঐতিহাসিক ফিশার বলেন, "The revolution came because the French monarchy failed to solve the question of privilege." তৎকালীন ফ্রান্সের রাজারা Divine Power of Monarchy বা স্বর্গীয় ক্ষমতা নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতো। দ্বারা কোনো জবাবদিহিতা করতো না। এখানে রাজা নিজেকে সর্বাত্মক শাসক, বিচারক ও আইন প্রণেতা মনে করতেন যা যথাসি বিপ্লবের পশ্চাতে অন্যতম কারণ ছিল। নিম্নে ফরাসি বিপ্লবের পিছনে রাজনৈতিক কারণগুলো আলোচনা করা হলো -


ফরাসি রাজারা নিজেদের খোদার প্রতিনিধি বলে মনে করতো। তারা মনে করতো যে তাদের যে কোনো কারো ঈশ্ব ছাড়া কারও কাছে জবাবদিহিতা নেই। তাই তারা নিজ মর্জিমাফিক শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকে। রাজাদের এরূপ মূলনীতির কারণে জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দেয়।


১. দায়িত্ব ও কর্তন্যে রাজার অবহেলা : তৎকালীন সময়ে ফ্রাসের রাজার সর্বময ক্ষমতার অধিকারী হয়েও দায়িত্বহীনতার কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার করতো। জনগণের প্রতি রাজার যে দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল তার প্রতি তাদের কোনোরূপ ভ্রুক্ষেপ ছিল না। জনগণের প্রতি রাজার এ অবহেলার কারণে জনগণের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। যার ফলে ফ্যাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়।


২. ক্ষমতার অসমতা : ফ্যাসি বিপ্লবের পূর্বে ক্ষমতার পূর্বে সমতা ছিল না। রাজা ও ভূ-স্বামীদের মাঝে ক্ষমতার চরম অসমতা ছিল। প্রত্যেকে স্বীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে সচেতন ছিল। সর্বদা সকল কর্তৃক দুর্বলকে গ্রাস করা হতো। যার জন্য জনগণ তাদের সামানের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হতো।


৩. ইনটেনডেন্টগণের অত্যচার : তৎকালীন ফ্রান্সের আমলারা রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে স্বীয় স্বার্থের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠে এবং এসব আমলা কর্তৃক নিযুক্ত ইনটেনডেন্টগণ দেশে শাসনের নামে শোষণ করতে থাকে। তাদের চরম উচ্ছৃঙ্খলতায় সর্বস্তরের জনগণের জীবন একেবারে মুবির্ষহ হয়ে উঠে। এরা দেশ ও জাতির কোনোরূপ কল্যাণ না করে স্বীয ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক তৎপর ছিল। এসব কারণে জনগণের মাঝে অসন্তোষের ছাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। যা এক সময় বিপ্লবের রূপ নেয়।


৪. স্বৈরাচারী নীতি : চতুর্দশ লুই এর শাসনামলে ফরাসি রাজতন্ত্রের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা জন্য নিলেও এর পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের স্বৈরাচারী শাসনের জালে জর্জরিত হয়ে সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। শাসকদের এ স্বৈরাচারী নীতি এক পর্যায়ে অত্যাচারে রূপ নিলে জনসাধারণের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে তা বিপ্লবে রূপ নেয়।


৫. রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিলুপ্ত:  শাসকদের স্বৈরতন্ত্র এত অধিক মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল যে জনসাধারণের কোনোরূপ রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না। এছাড়া রাজা কর্তৃক সভাসমিতি ও সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করে। জনগণের স্বাধীনতা নষ্ট হলে তারা তাদের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সজাগ হল বিপ্লব অনিবাহী হয়ে পড়ে।


৩. অভিজাতদের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগ : সাধারণ শ্রেণির রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে অভিজাত শ্রেনী তাদের স্বার্থের জন্য রাজসভাকে তাদের লীলাভূমিতে পরিণত করে। অভিজাত শ্রেণি ও রাজকর্মচারীদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও তাদের অত্যাচারে জনজীবনে ভীষণ প্রভাব ফেলে এবং জনজীবন একেবারে বিপন্ন হয়ে পড়ে।


৭. পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা : সমগ্র অষ্টাদশ শতাব্দী ধরে ফরাসি রাজতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয়  দেয়। পঞ্চাদশ লুই অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ এবং সপ্তবর্ষের যুদ্ধে পরাজিত হন। আমেরিকা ও অন্যান্য উপনিবেশ ফরাসি হস্তচ্যুত হলে ব্যবসাবাণিজ্যের চরম ক্ষতি হয়। এজন্য ফরাসি দেশে বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকে।


৮. দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন ও বিচারব্যবস্থা : সমসাময়িক সময়ে ফ্রান্সের আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ ছিল চরম দুর্নীতিগ্রস্ত একেক অঞ্চলে একেক ধরনের আইন প্রচলিত ছিল। সাধারণ কোনো অপরাধ এর জন্য মৃত্যুদণ্ড ছিল সাধারণ নৈমিত্তিক ব্যাপার। এ ধরনের বৈষম্য থাকায় সাধারণ শ্রেণির মানুষ বিপ্লবের ডাক দেয়।


৯. ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ: তৎকালীন রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসক যদি কোনো ব্যক্তিকে শত্রু বলে মনে করতো তাহলে তার বিরুদ্ধে বিনা কারণে অভিযোগ এনে কারারুদ্ধ করা হতো। সেখানে যে কাউকে আটকে রাখা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বাস্তিল দুর্গ এরূপ নিরপরাধ ব্যক্তিদের এক কারাগারে পরিণত হয়েছিল। সুতরাং দেখা যায় যে, দুর্নীতিপরায়ণ ও স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের জনমতে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। আর এই কারণে জনগণ বিপ্লবের ডাক দেয়।


সামাজিক কারণ :

ঐতিহাসিকরা বলেন, "The revolution of 1789 was much less a rebiliion against despotism than a rebelion against inequality", সামাজিক বৈষম্য ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কারণ। অসাম্যের ওপর গড়ে উঠা ফরাসি সমাজব্যবস্থা ফরাসি বিপ্লবকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে সামাজিক কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল -


১. বিভক্ত সমাজব্যবস্থা : ফ্রান্সের বিভক্ত সমাজব্যবস্থাই দায়ী ছিল ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে। সমাজব্যবস্থা দু শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যেমন- ১, সুবিধাভোগী শ্রেণি ২. সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণি। সুবিধাভোগী শ্রেণি তাদের সুযোগ সুবিধা আদায় করার জন্য সমাজে বঞ্চিত মানুষের ওপর নির্যাতন করতো। সুবিধাভোগীদের এ ধরনের কার্যকলাপের জন্য ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়।



২. অভিজাত শ্রেণির সুবিধা : ফ্রান্সের সুবিধাবাদী শ্রেণির মধ্যে ছিল অভিজাত শ্রেণি। প্রথমে এ অভিজাত শ্রেণি বিভিন্ন প্রকার সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো। তারা কোনো । সমাজিক ক্ষেত্রেও তারা মর্য ছিল। এ অবস্থার সুফল ছিল বিধায় চতুর্দশ সুইরের আমলে অভিজ্ঞাতনের সুযোগ সুবিধার ওপর দৃষ্টি দেওয়া হলে পরবর্তীতে ষোড়শ দুইয়ের শাসনামলে অভিজাত শ্রেণিরা তাদের পূর্বের মর্যাদা পুনরুদ্বারে আরাণ চেষ্টা করে। তারা জনসাধারণের চোখে চরম ঘৃণার পাত্রগুপে পরিচিত হতে থাকে। ফলে সমাজের অভ্যন্তরে বিভিন্ন উপদলের সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে বিপ্লবে রূপ নিতে সাহায্য করে।


৩. যাজক শ্রেণির সুবিধা: ফ্রান্সের তৎকালীন সাধারণ ছিল তার দুই কোটি পঞ্চাশ লক্ষ। এর ভিতরে যাজকরা ছিল প্রায় ১ লক্ষ ত্রিশ হাজার। এর ভিতর আবার যাজক শ্রেণিরা দুই দলে বিভক্ত ছিল। যথা- ১। ঊর্ধ্বর্তন যাজক ও ২। অধস্তন যাজক । ঊর্ধ্বর্তন যাজক শ্রেণি কর্তৃক সর্বনা অধস্তন যাজক শ্রেণির মানুষের লাঞ্ছিত হতো এবং যাজক শ্রেণির মধ্যে এ ধরনের বিভক্তরা এবং বিশ্বের ফ্রান্সেকে বিপ্লবের দিকে ঠেলে দেয়।


৪. মধ্যবিত্ত শ্রেণি : তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল জাতীয়তাবোধে অন্যান্য শ্রেণি থেকে তারা ছিল ভিন্ন। এ সম্প্রদায়ের অনেক ব্যক্তির অর্থ বা সম্পন্ন অভিচার ও স্বাক শ্রেণির চেয়ে বেশি ছিল বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করতেন। অভিজাত ও যাজকরা সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেও কারা রাজস্বের অন্য কোনো রূপ কর দিতেন না। যাবতীয় রাজস্ব দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তৃতীয় শ্রেণির ওপর। আর তাই বুর্জোয়া শ্রেণি নিজেদের মর্যাদা আদায়ের জন্য বিপ্লবের সপক্ষে মত দেন।


৫. শ্রমজীবী শ্রেণির পরিস্থিতি : ফরাসি বিপ্লবকালে ফ্রান্সের জনগণ বলতে কৃষক ও শহরের শ্রমিকদের বুজানো হতো। শহরে শ্রমজীবী মানুষ বলতে কেবল শহরের কলকারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকদের বুঝায়। আর তাদের সংখ্যাও তেমন বেশি ছিল না। তবে শহরের শ্রমিকরা বিভিন্ন করখানায় কাজ করতো। শহরে শ্রমিকদের যাবতীয় ধর্মঘট, মিছিল নিষিদ্ধ ছিল বটে কিন্তু শ্রমিকদের ওপর অকথ্য নির্যাতন ও ব্যাপক বিভেদ থাকায় এক পর্যায়ে শ্রমিকরা অধৈর্য হয়ে পড়ে এবং বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ বা অপেক্ষা করতে থাকে।


৬. কৃষক শ্রেণির পরিস্থিতি : ফ্রান্সের মোট ভূ-খণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ ছিল কৃষক এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশ ছিল যাজক। ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থায় গায়ক ও অভিভাবনা তাদের জমি কৃষকদের মধ্যে ভাগ করে নিত এবং জমির কিছু অংশ নিজ তত্ত্বাবধানে চাষ করতো। কৃষকরা চাষের মূল্য বৃদ্ধি ও করের চাপে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছিল। এছাড়া অনাবৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হওয়ায় কৃষকরা কর দিতে অস্বীকার করলে রাজ্যের রাজকোষ শূন্য হতে থাকে ফলে সমাজে এক বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যার জন্য বিপ্লবের কোনো বিকল্প ছিল না।


৭. সামাজিক বৈষম্য : সমকালীন ফরাসি সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য ছিল বিপ্লবের অন্যতম কারণ। কারণ সমসাময়িক কালে সমাজে অভিজাত ও যাজক শ্রেণির সুযোগ সুবিধা ছিল অনেক বেশি। ঐতিহাসিক লেফেল্ডার বলেন "The French revolution was stated and led to victory in its tirst phase by the aristocracy. সামাজিকভাবে অভিজাতরা ছিল সকল শোষিক ও নির্যাতনকারী এবং বৈষম্য সৃষ্টিকারী। মূলত সামাজিক বৈষম্যের কারণেই ফরাসি বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে। ঐতিহাসিক রাইকার বলেন ফরাসি বিপ্লব মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সামাজিক সমতা লাভের আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল। ম্যালেট দ্য প্যানের ভাষায়- "King despotism and constitution have become only secondary questions. Now it is war between the third estate and the other two orders.


দার্শনিকদের প্রভাব :

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে একদল দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে। তাদের লেখনীর প্রভাবে ফ্রান্সের চিন্তা জগতে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এসব মনীষীর মধ্যে মন্টেস্কু, ভলতেয়ার, রুশোর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর ফ্রান্সের রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের অসামাজিক অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করে জনগণের মনে বিপ্লবাত্মক ভাব জাগিয়ে তোলে। মন্টেস্কু তাঁর "Spirit of law" গ্রন্থে বাজার সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতার তরে সমালোচনা করেন। যুক্তিবাদী ভলতেয়ার চার্চের দুর্নীতি এবং যাজক ও অভিজাত শ্রেণির সুযোগ সুবিধার অর্থৌক্তিকতা সম্পর্কে যৌক্তিক সমালোচনা জনসম্মুখে তুলে ধরেন। এছাড়াও ভিড়েরচ ও ডি এল স্বরাষ্ট্র বিশ্বকোষ রচনা করে চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যকার দুর্নীতির কাঠোর সমালোচনা করেন। রুশোর The Social Contract ফরাসি বিপ্লব সৃষ্টিতে বিশাল ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেছেন মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু সর্বনা সে শৃঙ্খলিত। এ সময় অ্যাডাম স্মিথসহ অর্থনীতিবিদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতার মতবাদ প্রচার করেন। ফ্রান্সের শিক্ষিত মানুষরা স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রবিরোধী এ মতবাদ গড়ে তোলে।


ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় বিপ্লবের কারণ:

১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব এবং ১৭৭৬ খ্রিষ্টাে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইংরেজি লেখক জন লকের মতানুর ফ্রান্সের দার্শনিকরা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার পুনর্গঠনে সচেষ্ট হন। লাফায়েত নামে জনৈক ব্যক্তি আমেরিকার স্বাধীনত সময় আমেরিকাতে ছিলেন। তিনি সেখানে থেকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন এবং দেশে ফিরে এসে স্বদেশবানীতে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। তিনি ফরাসি বিপ্লব প্রাক্কালে "National Guard' নামে দেশের সাধারণ ম একটি বেসামরিক বাহিনী গঠন করেন যারা ফরাসি বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এভাবে বিভিন্ন কারণে ফরাসি বি সংঘটিত হয়। এ বিপ্লবের দুটি ধারা লক্ষ করা যায়। প্রথমটি হলো বুর্জোয়া বিপ্লব। প্রথম পর্যায়ে ১৭৮৯ এ State "General এর পরিবর্তে 'National Assembly' সংঘটিত হয় এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৭৯৫ সালে 'monarchy. পরিবর্তে 'Republic' সংযোজিত হয়।


ফরাসি বিপ্লবের কারণের সমালোচনা :

ফরাসি বিপ্লবের বিভিন্ন কারণগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা। নন। কেউ কেউ বলেছেন "The condition of the peasant's was undoubtly a prime cause of the French revolution." আবার কেউ বলেছেন, "It was happened which made the revolution." নেপোলিয়ন বলেছেন, “আত্মগরিমা অর্থাৎ যাজক এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের সমপর্যায়ভুক্ত হওয়ার ইচ্ছা ফরাসি বিপ্লবের প্রধান কারণ দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার জন্য ভিন্ন মত প্রকাশিত হয়েছে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ লুইয়ের বিলাসপ্রিয়তার ফলে সরকারের ঋে পরিমাণ অত্যধিক বেড়ে গিয়েছিল। এ সময়ে মোট আয়ের ৭৫% প্রতিরক্ষা ও ঋণ খাতে ব্যয় করা হতো। শু বলেছেন, বিশাল পরিমাণ ঋণের বোঝা লাঘব করার জন্য অসম্ভব করের বোঝা জনগণের ওপর চাপানো হয়। এ অর্থনৈতিক কারণই বিপ্লবের পিছনে মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেহেতু অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায় কর প্রদান করতো না। এবং তৃতীয় শ্রেণিরও অধিক পরিমাণ কর দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তাই রাজকোষ পূর্ণ করার একমাত্র উপায় ছিল করনীতি পুর্নবিন্যাস। এ উদ্দেশ্যে ষোড়শ লুইয়ের রাজস্ব মন্ত্রী নেকার বিশেষ শ্রেণির আর্থিক সুযোগ সুবিধা, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অমিতব্যায়িতা নিয়ন্ত্রণ করে সব শ্রেণির ওপর কর আরোপ করলে অভিজাত শ্রেণি নেকারের পদচ্যুতি ঘটান। তাছাড়া সমকালীন মুদ্রানীতির ফলে মুদ্রাস্ফীতির ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে। করেন যে “ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে মুদ্রাস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং পণ্যসামগ্রীর মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি। পায়। কিন্তু সে অনুপাতে আয় বৃদ্ধি পায়নি। তাছাড়াও ঐ সময়ে ব্যাপক ফসলহানির ফলে অর্থনৈতিক সংকট তাঁর। হয়ে দেখা দেয়। সুতরাং অর্থনৈতিক সংকট ও বৈষম্যই ফরাসি বিপ্লবের পিছনে অন্যতম ইন্ধন শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই।


ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল :

ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফরাসি সমাজে যে আমূল পরিবর্তন হয় তা নিম্নরূপ :

১. ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফরাসি সমাজের পুরানো অবকাঠামো ভেঙে পড়ে এবং নতুন চিন্তাধারার ভিত্তিতে প্রগতিশীল এক সমাজব্যবস্থার পত্তন হতে থাকে।

২. রাজতন্ত্রের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদী প্রজাতান্ত্রিক ধারণার বিকাশ ঘটে। আইনের চোখে সবাই সমান এ নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আনুগত্য বৃদ্ধি পায়।

৩. এ বিপ্লবের ফলে শুধু ফ্রান্সেই নয় সারা ইউরোপেই ধর্মকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রীয় চেতনার উদ্ভব ঘটে।

৪. এ বিপ্লবের ফলে স্বৈরতন্ত্রের পরিবর্তে অংশগ্রহণকারী মূল গণতন্ত্রের ভিত্তিতে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার স্লোগানে জনচেতনা উজ্জীবিত হয়।

৫. গির্জার প্রভাব ক্ষুণ্ণ করে ফরাসি বিপ্লব রাজনীতিকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলে।

৬. ব্যক্তস্বাতন্ত্র্য্য ও ব্যক্তি মর্যাদার ভিত্তিতে এ বিপ্লব ফরাসি জনমনের ধ্যান ধারণাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। প্রগতিশীল করে তোলে।

৭। এ বিপ্লবের ফলে বিচারব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসে এবং সবাই বিচার ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধা সমপরিমাণে লাভ করে।

৮. ফরাসি বিপ্লব অভিজাত ও সামস্ত প্রভুদের নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়ে বুর্জোয়াদেরকে নেতৃত্বের আসনে বসায়। 

৯. এ বিপ্লবের ফলেই ফরাসি সমাজে সামন্তবাদের গণ্ডি পেরিয়ে পুঁজিবাদে উত্তরণ ঘটে।

১০. সামন্ত প্রথার অবসান হয়ে বাক স্বাধীনতা ও ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়

১১. এ বিপ্লবের ফলে সমাজের প্রত্যন্ত শ্রেণির লোকও মানবিক মর্যাদার অধিকারী হয়। অর্থাৎ সামাজিক বৈষম্যর অবসান ঘটে।

১২. ফরাসি বিপ্লবের ফলেই বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটে।


উপসংহার:

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, হঠাৎ করে যেমন একটি পেড়তে পাে পিছনে থাকে নানাবিধ কারণ। ঠিক তেমনি ফরাসি বিপ্লব ও একটি মাত্র র পিছনে রয়েছে না ও পরোক্ষ কারণ। বহু বছর ধরে ফ্রান্সে সে দুহি অবস্থা বিরাজ করছিল ফরাসি বিপ্লব ছিল তারই অব কেবল ফ্রাশেই নয় বরং সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে এ বিপ্লব ভাবে বিস্তার করেছিল।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!