ভূমিকা : মানব সভ্যতার ইতিহাসে রেঁনেসা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। ১৩৫০-১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে মধ্যযুগের অনেক লেখকের লেখনিতে রেঁনেসা শব্দটি ব্যবহার শুরু হয়। রেঁনেসার পূর্ব যুগ ছিলো অন্ধকারে আচ্ছন্ন। মনে করা হয়, ইউরোপীয় গীতি কবিতার দেবী এ সময় বর্বর অজভদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। কিন্তু অলৌকিকভাবে দেবী ইউরোপীয়দের মাঝে ফিরে আসেন। এবং ইতালীয়রা তাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে তার সহযোগী হয়ে ইতালিতে শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতিতে প্রতিভার জোয়ার ছড়িয়ে দেয় ।
রেঁনেসা : রেঁনেসাকে অনেক ঐতিহাসিক অনেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কারো মতে রেঁনেসা বলতে নবজাগরণ ও অভ্যুদয়। কারো মতে রেঁনেসা হলো ঊষর মরুভূমিতে জেগে ওঠা ফোটা ফুল। আবার কারো মতে রেঁনেসা মানব ব্যক্তিদের মানব ব্যক্তিত্বের মুক্তি।
কিভাবে সুইপার সোশ্যাল ( Swiper social) যুক্ত হয়ে টাকা ইনকাম করবেন?
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন ইতিহাসবিদ, দার্শনিক রেঁনেসার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। মিশেলের মতে, রেঁনেসা হলো মানুষ ও প্রকৃতির আবিষ্কারক। বুকারের মতে, রেঁনেসা হচ্ছে মানুষ এবং বিশ্বের আবিষ্কারক। রেঁনেসা হলো একটি প্রবহমান গতি, এটা হঠাৎ করেই কোনকিছু সৃষ্টি করে না। রেঁনেসা একটা প্রবাহ ধারা যা মানুষের জীবন বাহনে, ব্যক্তিত্বে, মানসিকতায়, পারিপার্শ্বিকতায় এক গতিময়তা সৃষ্টি করে। সুতরাং রেঁনেসা হলো পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণ। তবে Robert Ergang রেঁনেসাকে দুটি অর্থে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পান।
(ক) সংকীর্ণ অর্থে, রেঁনেসা হচ্ছে শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, সংস্কৃতিতে পরিবর্তন যা বর্তমান সময়কে পূর্ববর্তী সময় থেকে পৃথক করেছে।
(খ) ব্যাপক অর্থে, রেঁনেসা হচ্ছে সামগ্রিক পরিবর্তন সূচিত হওয়া। রেঁনেসা হচ্ছে মানব অস্তিত্ব সূচিত করা ও ক্রমান্বয় সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা।
রেঁনেসার উদ্ভব ও বিকাশে মানবতাবাদীদের অবদান :
রেঁনেসা বিকাশে সবচেয়ে বেশি যাদের ভূমিকা তারা হলেন মানবতাবাদী গোষ্ঠি। নিম্নে তাদের অবদান তুলে ধরা হলো -
১. ধ্রুপদী সাহিত্য চর্চা : মানবতাবাদীরা ধ্রুপদী সাহিত্য চর্চা করতেন। ধর্মনিরপেক্ষতা, মানব মূল্যবোধ নির্ধারণ, মানব প্রকৃতির সংজ্ঞা নির্ধারণ, ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি ছিলো ধ্রুপদী সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। ধ্রুপদী সাহিত্য চর্চা মধ্যযুগেও ছিলো। ক্রিস্টেলার একে তিনটি ধারায় ব্যাখা করেছেন।
(১) মধ্যযুগের চিঠিপত্র, দলিল, বক্তৃতা, ইত্যাদি ।
(২) গ্রীক সাহিত্য চর্চা, যেমন পেত্রার্কীয়, বাস্তববাদি ধারণা।
(৩) 'নিউ প্লোটোনিজম' যার সূতিকা গৃহ ফ্লোরেন্সে প্লোটোনিক একাডেমী ।
২. মানব প্রকৃতি নিরূপণ : উক্ত ধারণাগুলোর মূল বিষয় ছিলো মানব প্রকৃতির সংজ্ঞা নিরূপণ করা। কিন্তু পূর্ণ মানব প্রকৃতি পরিকল্পনার পথে প্রধান বাঁধা ছিল মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে মানবতাবাদীদের অবজ্ঞা। সমাজ গঠন ও গতি প্রকৃতি মানব মনকে কিভাবে গড়ে তোলে সে বিষয়ে তাদের অনীহা ছিলো এবং প্রকৃতি ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে তাদের উৎসুকহীনতা দেখা যেত।
৩. লৌকিক ও মানব ধর্ম সাহিত্য : এ মানবতাবাদীরা নিরস ধর্মশাস্ত্র শিক্ষার পরিবর্তে লৌকিক ও মানবধর্মী সাহিত্যে সেবাই নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন। ইতালির মানবতাবাদীদের মধ্যে Francesco Petrarch সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। তিনি ১৩০৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সনেট নামে যে কবিতা রচনা করেন তা কবিতার রাজ্যে কবিতার সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া তিনি আইন শাস্ত্রেও দক্ষতা অর্জন করে।
8. Manuel Chrysolones -এর অবদান : তিনি ছিলেন গ্রীক পণ্ডিত। তিনি কনস্টান্টিনোপল হতে ফ্লোরেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দান করেন। ফলে সেখানে গ্রিক ভাষা শিক্ষার এক উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। গ্রিকভাষা শিক্ষার ফলে প্রাচীন গ্রীক সাহিত্য ও শিল্পের অর্থ বোঝায় ইতালিদের মধ্যে রেঁনেসার উন্মাদনা আরো বেড়ে যায়। দীর্ঘ ৪ বছর এই গ্রীক পণ্ডিত ধ্রুপদী শিক্ষাও দান করেন।
৫. Boccaccio-এর অবদান : সাহিত্যে বোকাসিরও নাম ছিল পৃথিবী খ্যাত। ১৩১৩ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার রচিত শিল্প সাহিত্য প্রীতির মোহ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি কবিতা লিখতেন। তার প্রথম বইটির নাম Fiammetta। কিন্তু যে বইটির জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন বইটির নাম "Decameron"। তিনি এ গদ্যরীতি প্রণয়ন করেন। তার আগে কেউ গদ্যরীতি প্রণয়ন করেনি।
৬. Erasmas -এর অবদান : Erasmas ছিলেন ষোড়শ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ Humanist। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান। তাকে সর্বপ্রথম মঠে রাখা হয়েছিল। তবে মঠে তার মন বসেনি। তার পর তিনি চলে যান ফ্রান্সে লেখা- পড়ার উদ্দেশ্যে। সেখানে ১৫০৩ সালে তিনি একটা বই লেখেন। ১৫১৪ সালে তিনি চলে যান ক্যামব্রিজে। সেখানে তিনি পড়াশুনা করেন। তিনি তার বিখ্যাত বই Fraise of Fally তে সন্যাস জীবনের অজ্ঞতা ও দীনতাকে নির্মমভাবে আঘাত করেন এবং জনসাধারণের মধ্যে নতুন অনুসন্ধিৎসা ও সমালোচনার স্পৃহা জাগ্রত করেন।
৭. Rudolph Agricolo -এর ভূমিকা : তিনি ছিলেন জার্মান মানবতাবাদী। তিনি ১৪৪৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্রীক, ল্যাটিন, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রাচীন জ্ঞানের পুনরুদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী মানবতাবাদী। তিনি ছিলেন একজন ব্যক্তি যার মাধ্যমে রেঁনেসা ইতালি থেকে জার্মান অবধি পৌঁছে।
৮. Johhann Rechalin : তিনি ১৪৫৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ইতালিতে লেখা-পড়া করেন। তিনি ল্যাটিন ও গ্রীক ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। এজন্য তার পক্ষে প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য পাঠ রেঁনেসা বিশেষ অবদান রাখেতে সক্ষম হয়।
৯. বিজ্ঞানে অবদান : রেঁনেসাকে বিজ্ঞানের দিক দিয়ে যারা সামনের দিকে নিয়ে যান তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো কপার নিকাস, গ্যালিলিও, ব্রুনো প্রমুখ বিজ্ঞানী। এ সমস্ত বিজ্ঞানী প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্তে বাস্ত ববাদী ধারণা প্রদান করেন। যা রেঁনেসা সৃষ্টিতে অবদান রাখে।
১০. রাজনীতিতে অবদান : মানুষ মাত্রই যে রাজনৈতিক জীব এ ধারণা প্রবর্তনে যাদের অবদান তাদের মধ্যে মেকিয়া ভেলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অবতারণা করেন। মানুষ তার অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাধ্যমে জ্ঞানের চর্চা করতে শেখে।
এছাড়াও সাহিত্যে ইয়ামুর, টমাস মুর, মেলিনি, চসার। শিল্পে বাটসেলি, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো, টিটিয়ান প্রমুখ রেঁনেসা জাগরণে অবদান রাখেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রেঁনেসা একক কোনো ব্যক্তির অবদান নয়, বা হঠাৎ করেই এর উদ্ভব হয়। যুগে যুগ যে সমস্ত মানবতাবাদীদের আগমন ঘটেছিল তাদের অবদানে রেঁনেসার সূত্রপাত হয়েছে। মানবতাবাদিদের মত ব্যক্তি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ না করলে পৃথিবী অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। রেঁনেসা প্রথম মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার উন্মেষ ঘটায়। 1