ভূমিকা : মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে আছে সামস্ত প্রথা। সামন্ত প্রথা ছিল। মূলতঃ ভূমিকেন্দ্রীক অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা। প্রায় পাঁচ শতক থেকে প্রায় আঠারো শতক পর্যন্ত ইউরোপে সামস্ত প্রথা বিস্তার লাভ করেছিল। মূলতঃ নবম শতক থেকে পরবর্তী ১০০০ বছর সামন্ত প্রথা শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এ সময়ে এশিয়াসহ আফ্রিকাতেও এ প্রথার বিস্তার ঘটে। মূলতঃ সামস্ত যুগে সামন্ত প্রথা ইতিবাচক দৃষ্টির থেকে নেতিবাচক ভাবেই বেশি সমালোচনা করা হয়। তবুও সামন্ত প্রথার কিছু ইতিবাচক দিক বা সুফল রয়েছে।
সামস্ত প্রথার সুফল : মধ্যযুগে ভূমিকেন্দ্রীক সামন্ত প্রথার সুফল ছিল না তা নয়। বরং সামন্ত প্রথার সুফল ছিল বিস্তরভাবে। নিম্নে মধ্যযুগের ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক সমাজে সামস্ত প্রথার সুফল গুলো আলোচনা করা হলো -
১. সভ্যতার সুরক্ষা : সামন্ত প্রথাকে ইউরোপীয় সভ্যতার বিশেষ করে রোমান সভ্যতার রক্ষক বলা যেতে পারে অর্থাৎ বর্বরদের হাত থেকে সভ্যতাকে রক্ষা করাই ছিল সামন্ত প্রথার একটি সাফল্য রাজা যখন নিজের জনগণকে ব আক্রমণ হতে রক্ষা ও নিরাপত্তা দানে ব্যর্থ হন, জনগণ সেই চরম দুর্দিনে সামস্ত প্রথা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চি করেছিল। সাধারণ জনগণ শক্তিশালী সামন্ত প্রভুদের নিকট হতে প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তা পেত। বিনিময়ে দুর্বলের বা সাফা থেকে সামন্ত প্রভুর সেবা পেত। মধ্যযুগীয় সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো।
২. সামাজিক দায়িত্ব বোধ সৃষ্টি : সামন্ত প্রথা সামাজিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। সামন্ত সমাজে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই তার অবস্থান ও দায়িত্ব বোধের চেতনা গড়ে ওঠেছিল। সবাই সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী। বার বার দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের নিমিত্তে অধিকার ভোগ করত। পারস্পরিক দায়িত্ববোধ ও আনুগত্য ও সেবার মাধ্যমে সমাজ পরিচালিত হতো। সামন্ত প্রভুরা যেমন ছিল ভ্যাসালের উপর নির্ভরশীল তেমনি ভ্যাসাল ছিল সামন্ত প্রভুর উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতপক্ষে সামন্ত সমাজে সমাজ ছিল যেন একটি পারস্পরিক নির্ভরতাপূর্ণ সমাজ।
৩. অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান : সামন্ত প্রথার সবচেয়ে বড় সুফল ছিল এই যে, রোমান সমাজ্যের পতনের যুগে রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে যে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল সামন্ত প্রথা সে অনিশ্চয়তা দূর করে বিশেষ করে কৃষি উৎপাদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিত্য প্রয়োজনীয় গণ্য দ্রব্য উৎপাদন করে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এনেছিল। ম্যানর ও গ্রাম গুলো ছিল অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেখানে খাদ্যশস্য শাক-সবজি, ফলমুলসহ, সমাজে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন হতো।
৪. সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন : জার্মান বর্বরদের উপর্যুপরি আক্রমণে মানুষের জীবন সম্পদ যখন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছিল তখন কেন্দ্রীয় শাসন ও প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল। একই সাথে রাজা যখন শাসন ও জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল তখন সামন্ত প্রথা এক ধরনের প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলে সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ জনগণের আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান করেছিল। একজন রাজা যেভাবে শাসন করতেন একজন সামন্ত প্রভুও ঠিক ঐভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। ফলে এক বিশেষ ধরনের সরকার ব্যবস্থার উদ্ভব হয় সামস্ত প্রথার মাধ্যমে।
৫. খ্রিস্ট ধর্মের প্রসার : বর্বর আক্রমণ প্রতিরোধে খ্রিস্ট ধর্ম ও ধর্মের যাজকরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। তাই জনগণের মধ্যে এ ধর্ম দ্রুত প্রসার লাভ করেছিল। পরবর্তী সময়ে প্রতিটি ম্যানরই গড়ে উঠেছিল চার্চকে কেন্দ্র করে। ক্রমে চার্চ ও খ্রিস্ট ধর্মের নীতি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং জনগণকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দান করার বিনিময়ে অর্জিত সম্পদে চার্চ নিজেও সামন্ত প্রভুতে পরিণত হতো।
৬. স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গঠন : স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সামন্ত প্রথার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ম্যানর কিংবা নির্দিষ্ট সামন্ত প্রভুতে অবস্থান করে লর্ড ও রাজারা অনেকটা স্বাধীনভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতে পারতেন। যার ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নিজস্ব এলাকার লর্ডরা ভ্যাসালদের উপর কর আরোপ। নিজস্ব আদালতে বিচার, যুদ্ধ ঘোষণা, চুক্তি স্বাক্ষর, সামরিক সাহায্য প্রদানের জন্য ভ্যাসালদের নির্দেশ দান ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করতেন।
৭. ব্যক্তিগত প্রশাসন কাঠামো : সামন্ততন্ত্রের অন্যতম সুফল হলো ব্যক্তিগত প্রশাসন কাঠামোর বিস্তার। এতে বিভিন্ন এলাকা থেকে এক এক সামন্ত প্রভুর ক্ষমতাকে পৃথক করে দেওয়া হয়। ফলে একজন সামন্ত প্রভুরা নিজে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। একই সাথে জনগণ তাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তার জন্য সামন্ত প্রভুর নিকট নিজেকে সমর্পন করলে তারা আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
৮. পারস্পরিক দায়-দায়িত্ব পালন : সামন্ত প্রথা মধ্যযুগে পরস্পরের প্রতি দায়-দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। এই সমাজে ভ্যাসাল যেমন সামন্ত প্রভুর দায়িত্ব পালন করতেন তেমন সামন্ত প্রভুরাও সাধারণ কাটার থেকে শুরু করে সকলে নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতেন। এছাড়াও সামন্ত প্রভুরা রাজাকেও অনেকভাবে সাহায্য করলেন।
৯. ব্যক্তিগত অধীনতা : সামন্ত সমাজে অন্যতম সুফল হলো ব্যক্তিগত অধীনতা। রাজ্যের সমস্ত জমির মালিক হলো রাজা। তিনি লর্ডদেরকে জমি বিতরণ করতেন। লর্ড থেকে নির্দিষ্ট আনুগত্য ও কর্তব্য পালনের অঙ্গিকারে জমি পেতেন অ্যাসাল। এরা জমি খন্ডে খন্ডে কৃষকের কাছে বিতরণ করতেন। এতে জমিতে ব্যক্তিগত অধীনতা তৈরি হয়।
১০. রাজস্ব আদায় : রাজ্য পরিচালনার জন্য অবশ্যই অর্থের প্রয়োজন। এটা সামন্ত যুগেও অক্ষুন্ন ছিল। কাজেই সামন্ত প্রভুরা বিশেষ নিয়মে সুষ্ঠভাবে কৃষকদের থেকে অর্থ বা কর আদায় করে প্রশাসন পরিচালনা করতেন। এতে প্রশাসন ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হতো। এর মাধ্যমে চলমান বিশৃঙ্খলা দূরকরা সম্ভব হয় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, নানাবিধ অসুবিধা, কুফল, দুর্নাম, থাকা সত্ত্বেও সামন্ত সমাজে কিছু সফলতা ছিল। একই সাথে সমাজের প্রেক্ষাপটে সামন্ত প্রথার প্রয়োজন ছিলো সুষ্ঠভাবে প্রশাসন পরিচালনা, জনগণের নিরাপত্তা দানে এই প্রথা কার্যকরি ভূমিকা রাখে। প্রাথমিক পর্যায়ে সামন্ত প্রথা অনেক বেশি সংবেদনশীল ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে কিছুটা অস্তির হয়ে ওঠে। এরও অবশ্য কারণ ছিল। এতোদাসত্ত্বেও এর সফলতা ছিল না তা একেবারেই বলা যায় না।