ভূমিকা : সিন্ধুনদের অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ থেকে ১৯০০ অব্দের মধ্যে এ সভ্যতার পূর্ণ পরিণতি সূচিত হয়েছিল। সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ছিল অসাধারণ ও অভাবনীয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে | প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে সিন্ধু সভ্যতা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এ সভ্যতা প্রাচীন মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতার সমকালীন বলে স্বীকৃত।
সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা : নিম্নে সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করা হলঃ
১. নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা : হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে এক নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যা আজকের নগর সভ্যতার মতোই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাক্ষ্য বহন করে। মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা, লোথাল ও কালিবঙ্গান ছিল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। প্রত্যেকটি বাড়িতে বারান্দা, দরজা, জানালা, কূপ, নর্দমা ও গোসলখানার অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল।
২. উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা : সিন্ধু সভ্যতার শহরের রাস্তাগুলোর দিকে দৃষ্টি করলে সভ্যতার সঠিক পরিচয় বুঝা যায়। সোজা উত্তর হতে দক্ষিণ দিকে বা পূর্ব-পশ্চিমে রাস্তাগুলো বিস্তৃত। বড় রাস্তাগুলো ৯ থেকে ৩৪ ফুট চওড়া, যা গাড়ি চলাচলের উপযোগী।
৩. দুর্গ নগরী : হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নগরীতে একটি দুর্গ নির্মিত হয়েছিল এবং চারদিকে দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত । ছিল। নগরীর নীচু অংশে ছিল উপনগরী। দালানগুলো দুর্গের ভেতর নির্মিত হতো। মহেঞ্জোদারো দুর্গটির দৈর্ঘ্য ছিল ১২০০ ফুট এবং প্রস্থ ৬০০ ফুট। দুর্গের দেয়াল ছিল ৪০ ফুট উঁচু।
৫. গৃহনির্মাণ পরিকল্পনা : বাড়ির বেশির ভাগ বাড়ি পোড়া ইট দিয়ে নির্মিত ছিল বাড়িগুলো সাধারণত দু'কক্ষ বিশিষ্ট হলেও এর চেয়ে বেশি কক্ষ বিশিষ্ট বাড়িও আবিষ্কৃত হয়েছে। হরপ্পা নগরীতে মাঝারি ধরনের বাড়িঘরের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সিন্ধু সভ্যতার মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল বেশি। বেশি কক্ষবিশিষ্ট বাড়িগুলো ধনী লোকের বাসগৃহ ছিল।
৬. রাস্তা : সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো ও কালিবঙ্গানের রাস্তাগুলো ছিল সোজা, উত্তর হতে দক্ষিণে বা পূর্ব হতে | পশ্চিমে বিস্তৃত। প্রধান রাস্তাগুলো ৯ ফুট হতে ৩৪ ফুট চওড়া। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করা হয়েছিল ।
৭. বৃহৎ স্নানাগার : সিন্ধু সভ্যতার বৃহৎ স্নানাগারের ব্যবস্থা ছিল। এর আয়তন ছিল ১৮০ ফুট × ১০৮ ফুট। স্নান করার জলাধারটি ছিল ৩৯ ×২৩ ফুট গভীরতা ছিল ৮ ফুট। পাশে বসার জন্য মঞ্চ এবং পাশে বারান্দা ও ছোট ছোট কক্ষ। পূজারীরা স্নান করে ছোট কক্ষে পোশাক বদল করত। পাঁচ হাজার বছরেরও আগে নির্মিত স্নানাগারটি বর্তমানেও টিকে আছে।
৮. নগরীর পূর্ব পরিকল্পনা : হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ হতে বুঝা যায়, উভয় শহরই বিশ ফুট উঁচু কাঁচা ইট দ্বারা প্রস্তুত ভিত্তির উপর নির্মাণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় শতকের বৌদ্ধ স্তূপ থেকে মহেঞ্জোদারো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।
৯. পয়ঃপ্রণালি : সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলোর পয়ঃপ্রণালি ছিল উন্নতমানের। প্রত্যক বাড়িতে বারান্দা, একটি বাসকে ও গোসলখানা ছিল। পানি নিষ্কাশনের জন্য রাস্তার নিচে ভূ-গর্ভস্থ ড্রেন ছিল। রাস্তার ড্রেনে ছিল আধুনিককালের ম ম্যানহোল । অন্য সভ্যতার স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এমন বিজ্ঞানসম্মত বন্দোবস্ত দেখা যায় না।
১০. উন্নত নাগরিক সংস্কৃতি : সিন্ধু সভ্যতার জনগণ সচেতন ছিল। নগরের স্বাস্থ্য সম্পর্কে নাগরিকগণ যথে সচেতন ছিল। তাছাড়া রাস্তাঘাট, নর্দমা, কূপ, দালান সবকিছুই পোড়া ইট দ্বারা নির্মিত ছিল। শহরের অবকাঠামোগত অবস্থা দেখে বুঝা যায় নাগরিক জীবন যাপন উন্নত ছিল ।
১১. বৃহৎ হল : মহেঞ্জোদারোতে বৃহৎ হল আবিষ্কৃত হয়েছে। যার আয়তন ৮০ ফুট। হল ঘরের ভেতরে সারি সারি বসার জাগয়া এবং সামনে প্লাটফর্ম ছিল। মহেঞ্জোদারোর সভাগৃহ হিসেবে অনেকেই এটাকে বিবেচনা করে।
১২. পানি সরবরাহ : হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর পানি সরবরাহের চমৎকার ব্যবস্থা ছিল। অনেক বাড়িতে পারি সরবরাহের জন্য কূপ ছিল। বেশিরভাগ কূপ হতে পানি সরবরাহ করা হতো। তবে মহেঞ্জোদারোর তুলনায় হরপ্পাতে পানির কূপ বেশি ছিল।
১৩. শস্যাগার : মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার দুর্গের ভেতর বিশাল শস্যাগার ব্যবস্থা ছিল। মহেঞ্জোদারোর শস্যগোলার দৈর্ঘ্য ৪৫.৭১ মিটার এবং প্রস্থ ১৩.২৩ মিটার। হরপ্পা দুর্গের ৬টি শস্যাগার নদীর কাছাকাছি অবস্থিত। খাদ্যশস্যগুলো সহজে নদীপথে পরিবহনের সুবিধার জন্য বর্তমানকালের মতো শস্যাগারগুলো নদীর কাছাকাছি নির্মিত ছিল। উৎপাদিত খাদ্যশস্য শস্যাগারে জমা রাখা হতো। যখন প্রয়োজন হতো তখন শস্য মানুষের জন্য ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হতো।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সভ্যতার ইতিহাসে সিন্ধু সভ্যতা ঐতিহাসিক ও সুপরিচিত সভ্যতা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সিন্ধু সভ্যতাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনাগুলো সুন্দর সুশৃঙ্খল হওয়ায় এ সভ্যতার আরও এক ধাপ অগ্রগতি সাধিত হয় ।