ভূমিকা : মানব সভ্যতার ইতিহাসে সিন্ধু সভ্যতার অবদান অপরিসীম। মিশর ব্যাবিলনিয়া প্রভৃতি সভ্যতার সমসাময়িক এক ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা প্রায় হাজার বছর পূর্বে ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল । বৈদিক সভ্যতাকেই ভারতবর্ষের সর্বপ্রাচীন সভ্যতা বলে যে ধারণা প্রতিদিন চলে আসছিল নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়। সিন্ধু নদের তীরে গড়ে উঠেছিল বলে এ সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতা বলা হয় ।
সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য : নিম্নে সিন্ধু সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো-
১. সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল : মাটির অভ্যন্তরে ধ্বংসস্তূপের স্তরবিন্যাস লক্ষ্য করলে যে কালপর্ব নির্ণয় করা হয়েছে তাতে অনুমান করা হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ২৫০০ অব্দের মধ্যে এ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সিন্ধু সভ্যতা ছিল মূলত নগর সভ্যতা।
২. সিন্ধু সভ্যতার জাতি : সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মানুষ একত্রে মিলিত হয়ে। অনি ভূমধ্যসাগরীয়, মঙ্গোলীয় ও আলপাইন জাতির মানুষ এখানে বাস করতো। তাদের মধ্যে দ্রাবিড় ও সুমেরীয় জাতিগোষ্ঠি বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট ।
৩. নগর পরিকল্পনা : মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা নগরগুলো ইটের ভিত্তিভূমির উপর নির্মিত হয়েছিল। দুটি নগরই দিন সুবিন্যস্ত পর্বগুলো ছিল সমান্তরাল। স্নানাগার, বিশাল শস্যাগার, ব্যাপক কোষাগার ইত্যাদি পরিকল্পিতভাবে তৈরি হয়েছিল।
৪. প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা : প্রথমদিকের খনন কার্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে হায়াত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে যুগের প্রমাণ পাওয়া যায়। ভূ-স্থল থেকে ৫০ ফুট উঁচু হরপ্পার পশ্চিম দিকে উবির ওপর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়।
৫. পয়ঃপ্রণালির ব্যবস্থা : সিন্ধু সভ্যতার যুগে পয়ঃপ্রণালির ব্যবস্থা ছিল উন্নত এবং আধুনিক ধরনের পাকা রাস্তার নিচ দিয়েছিল আচ্ছাদিত নৰ্দমা।
৬. উন্নত রাস্তাঘাট : সিন্ধু সভ্যতার যুগে রাস্তাগুলো ছিল পাকা, সোজা ও চওড়া। মহেঞ্জোদারোতে ৯ ফুট হতে ফুট পর্যন্ত রাস্তা আবিষ্কার হয়েছে।
৭. সমাজজীবন : সিন্ধু নগরে সমাজ জীবনের যে সমস্ত ব্যবহারযোগ্য দ্রব্যের নিদর্শন পাওয়া যায় তা থেকে সিন্ধুবাসীদের সমাজব্যবস্থার মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। অভিজাত শ্রেণি ও নিম্নশ্রেণি দুই ধরনের লোক সমাজে বিদ্যমান ছিল।
৮. রাজনৈতিক জীবন : সিন্ধু সভ্যতার রাজনৈতিক জীবন ও শাসনপ্রণালি সম্বন্ধে ধারণা করা কঠিন। কিন্তু নগরগুলোর শক্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করতো প্রশাসনের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের উপর।
৯. অর্থনৈতিক জীবন : সিন্ধু সভ্যতার লোকজন কৃষি ও শিল্প বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। সিন্ধুর শহরগুলোর বাইরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষিকাজ চলত। কৃষি জমিতে ব্যাপক ফসল উৎপাদিত হতো। যা তাদের অর্থনীতিক জীবন স্বয়ংসম্পূর্ণতা আনতে সহায়তা করে।
১০. ধর্মীয় বিশ্বাস : সিন্ধু সভ্যতার লোকজন প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা করত। তাদের মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার বহুল প্রচলন ছিল। হরপ্পায় শিব লিঙ্গের অনুরূপ কৃষ্ণ প্রস্তরের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। সাপ, গাছপালা ইত্যাদি পূজার প্রচলন ছিল।
১১. পরিবহন ব্যবস্থা : স্থলপথে কাঠের গাড়ি এবং নৌপথে নৌকা ছিল সিন্ধু অধিবাসীদের প্রধান পরিবহন মাধ্যম। এতে মালপত্র আনা নেওয়া হতো। উট ও গাধা ছিল স্থলপথের অন্য দুটি বাহন।
১২. খাদ্য সামগ্রী : গম ও বার্লির দানা, মাছ ধরার বর্ণি, মাছ ও জীবজন্তুর হাড় ও খোসা কাটা প্রভৃতি পাওয়া যায়। তারা শুকর, গরু, ভেড়া, ঘড়িয়াল, কচ্ছপ প্রভৃতির মাংস খেত। এছাড়া শাক সবজি ধান ও দুধ তারা খেত বলে মনে করা হয়।
১৩. ভাস্কর্য শিল্প : সিন্ধু যুগের অসংখ্য পাথর ও ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। তারা মানুষ, গরু, বিভিন্ন জীবজন্তর ভাস্কর্য তাদের চিত্র মাটির পাত্রে আঁকত।
১৪. ব্যবসা-বাণিজ্য : সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা কৃষিকাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য করত। সুমেরীয় শিল্পজাত ও বিলাস দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে সিন্ধুজাতি ব্যবসা করতো। বিনিময় প্রথা অনুসারে তারা ব্যবসায়-বাণিজ্য করত কারণ তখনও মুদ্রার প্রচলন আরম্ভ হয়নি।
১৫. স্থাপত্য শিল্প : মহেঞ্জোদারোর সুরম্য দালান ও পয়ঃপ্রণালি নির্মাণ কৌশল থেকে তাদের স্থাপত্য বিদ্যার পারদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রস্তর নির্মিত জীবজন্তুর মূর্তি, প্রস্তর ও হস্তীদঙ্কের ওপর সীলমোহর পারে অস্তিত জীবজন্তুর প্রতিকৃতি দেখে তাদের মুখ্য সৌন্দর্যবোধ, উন্নত রুচি ও শিল্পমনের উৎকৃষ্টতার জীবন্ত পরিচয় পাওয়া যায়।
১৬. সিলমোহর : সিন্ধু সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন হলো সিলমোহর। প্রায় ২০০০ সিলমোহর এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে, যাদের অধিকাংশের গায়ে ছোট ছোট লিপি খোদাই করা।
১৭. সিন্ধু সভ্যতার পতন : সিন্ধু সভ্যতা হলো ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা। এ সভ্যতার ধ্বংস বা পতন কিভাবে হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যেখানে মাটির নিচে কঙ্কালের সাথে অস্ত্র পাওয়া গিয়াছে। অনেকেই মনে করে, বৈদেশিক আক্রমণে এ সভ্যতার ধ্বংস হয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য বা বিভিন্ন দিক এ সভ্যতাকে স্বতন্ত্র সভ্যতা হিসেবে। বিশ্বে পরিচিত করে তুলেছে। ধারণা করা হতো যে, ভারতবর্ষে আর্য সভ্যতা প্রাচীনতম সভ্যতা। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ার পর সেই ধারণার পরিবর্তন হয়।