ভূমিকা : টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস অর্থাৎ দজলা ও ফোরাত নদীদ্বয়ের মধ্যভাগে অবস্থিত ভূখণ্ডে সেমেটিক জাতির একটি শাখা স্থায়ীভাবে বসবাস করেছিল। সুমেরীয়দের কাছে গৃহ নির্মাণ, জলসেচ, লিখনপদ্ধতি প্রভৃতি সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান লাভ করে। পরবর্তী সময়ে সেমেটিক জাতির জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় অসমেটিক জনগোষ্ঠী মিলে যে সভ্যতা গড়ে তোলে তাকে ব্যাবিলনীয় সভ্যতা নামে অভিহিত করা হয়।
ব্যাবিলনীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যসমূহ :
নদীতীরবর্তী সভ্যতাগুলোর মধ্যে ব্যাবিলনীয় সভ্যতা অন্যতম। নিম্নে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার বৈশিষ্টগুলো তুলে ধরা হলো-
১. আইন : সম্রাট হাম্বুরাবির রাজত্বকালের শেষের দিকে নির্দেশিত বিধানমালা প্রস্তরখণ্ডে খোদাই করে রাখা হয়। পরবর্তীতে তা হাম্বুরাবি আইন নামে পরিচিতি লাভ করে। হাম্বুরাবি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি একটি সুর মানবাধিকারসম্পন্ন বৈষম্যহীন সত্যনিষ্ঠার উপর আইনকে প্রতিষ্ঠা করেন। দুইশত বিরাশিটি আইন ব্যাবিলনীয় ভাষায় খোদাই করা হয়। এই আইন মূলত নানা রকম আইনভঙ্গ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিবাহ, পরিবার, সম্পত্তি, বৃত্তিধারী লোকদের পারিশ্রমিক ও দায়িত্ব, কৃষি বিষয়ক আইনগত সমস্যা এবং ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি সংক্রান্ত সুযোগ্য রাজা হাম্বুরাবি প্রতিষ্ঠিত এ ন্যায় আইন সংহিতা।
২. কৃষিকাজ : ব্যাবিলনীয়রা কৃষিকাজে দক্ষ ছিল। কৃষিকাজ জমি চাষ করার ক্ষেত্রে বলদ ব্যবহৃত হতো। অধিকাংশ জমির মালিক ছিল মন্দির বা পুরোহিত। খাল কেটে বন্যার পানি কৃষিকাজে লাগানো হতো। কৃষি ভূমিতে ব্যাপক ফসল ফলতো। প্রধান কৃষিদ্রব্যের মধ্যে গম, যব এবং ধান উল্লেখযোগ্য। জমিতে হাল, হালের বলদ প্রভৃতি দ্বারা তারা চাষ করে ফসল বুনাত ।
৩. সামাজিক ব্যবস্থা : বিশ্ব সভ্যতা ব্যাবিলনীয় সমাজব্যবস্থা ছিল অভিন্ন এক নতুন সংযোজন। ব্যাবিলনীয় সমাজব্যবস্থা ছিল তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা - উচ্চশ্রেণি, মধ্যমশ্রেণি ও নিম্নশ্রেণি। উচ্চশ্রেণির মধ্যে ছিল রাজা, পরিত এবং পুরোহিত এবং অন্যরা এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, মধ্যম শ্রেণির মধ্যে বড় বড় শিল্পপতি ও স্বাধীন ব্যবসায়ীগণ এবং কৃষক সাধারণ শ্রমিক এবং যুদ্ধবন্দি তথা দাসদাসীগণ এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
৩. ব্যবসা-বাণিজ্য : ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রাচীন ব্যাবিলনীয়রা স্বচ্ছতার পরিচয় বহন করতো। মন্দির ছিল ব্যবসা- বাণিজ্য ও লেনদেনের কেন্দ্র। ব্যবসায় বাণিজ্য ও সম্পত্তির বিলি বণ্টন নিয়ে ব্যাবিলনের মানুষ সদা ব্যস্ত ছিল। বর্তমান যুগের মত তারা ত্রুটিমুক্ত হিসাব পদ্ধতির প্রচলনে এগিয়ে আসে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল সকল প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ব্যাংক ইত্যাদি ।
৫. লেখন পদ্ধতি : বালিনীয়রা লেখনের কাজে তাদের প্রবর্তিত “কিউনিফর্ম লিপি' ব্যবহার করত। পণ্ডিতদের মতে, কিউনিফর্ম লিপিতে অনূন্য ৫০০ অক্ষর স্থান পেয়েছে।
৬. জ্যোতির্বিদ্যা : জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যাবিলনীয়রা ব্যাপক অবদান রাখে। ব্যাবিলনীয়রা সূর্য, দড়ি, জলঘড়ি এসবের ব্যবহার চালু করে। তারা মাস, বছর, দিন ইত্যাদির ক্ষেত্রে সময় নিরুপণ ও বণ্টণের প্রথা চালু রেখে চন্দ্র গ্রহণ, সূর্য গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে তারা সঠিক ধারণা পেয়েছিল । .
৭. পরিবার ব্যবস্থা : হাম্বুরাবির সংহিতার পরিবারের অধিকার ও দায়িত্বের চেয়ে ব্যক্তির অধিকারও দায়িত্বকে গুরুত্ব দিয়েছিল। স্বামী ছিল পরিবার প্রধান। স্ত্রীর নিজস্ব জমি ছিল এবং সম্পত্তির জন্য তার যথেষ্ট আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতা ছিল।
৮. সাহিত্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা : প্রাচীন ব্যবিলনীয় শিক্ষা ও সাহিত্যে বেশ এগিয়ে গিয়েছিল, ব্যাবিলনীয়রা সুমেরীয়দের অমর সাহিত্য গিলগামেশ উপাখ্যান অধ্যয়ন করে মুগ্ধ হয়। সাহিত্য কর্মে ব্যাবিলনীয়রা গদ্যরীতি ও পদ্যরীতিতে সাহিত্যকর্ম সম্পাদন করেছেন। তাদের লেখনীতে পৌরানিক কাহিনী অপূর্ব সাহিত্য রসে সুসমৃদ্ধ হয়ে উঠে। মান, বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারা অবদান রাখে ।
১২. অর্থনীতি : ব্যাবিলনীয় সমাজব্যবস্থায় পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু ছিল। সবকিছু নির্দিষ্ট বিধি মোতাবেক পরিচালিত হতো। কৃষি ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি। শ্রমিকদের মজুরি নির্দিষ্ট ছিল তাই নির্ধারিত মজুরি তাদের দিয়ে দেওয়া হতো।
১৩. বিবাহ প্রথা : ব্যাবিলনীয় বিবাহ ছিল চুক্তিভিত্তিক। ছেলের বিয়ে পিতামাতাকে ঠিক করতে হতো। ছেলের বাবা কনের বাবাকে যৌতুক দিত। কনে পক্ষ বর বা স্বামীপক্ষকে পরিত্যাগ এই বিষয়ে চুক্তিপত্র থাকত। ক্রীতদাসী ও উপপত্নীর মর্যাদা বিবাহিত স্ত্রীর চেয়ে কম ছিল।
১৪. সুমেরীয় নারী : সুমেরীয় নারীদের উচ্চ মর্যাদা ছিল। মেয়েরা স্বাধীন ব্যবসায় করার, ক্রীতদাস রাখার, জমির মালিক হওয়ার, স্বনামে সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় করার, পুত্র ও কন্যা দত্তক নেওয়া প্রভৃতির ।
১৫. ধর্মীয় ব্যবস্থা : বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী ব্যাবিলনীয় সভ্যতার জনগণ। একেক নগরের একেক দেবতাকে কেন্দ্র করে মন্দির গড়ে উঠেছিল। ব্যাবিলনীয়রা মৃত্যু পরবর্তী কোনো জীবন সম্পর্কে তারা চিন্তা করতো না। তারা ইহ জগতের ভোগবিলাসী ছিল। তাদের কাছে ছিল ইহজগতের প্রাধান্য। পরকাল সম্পর্কে তারা বিশ্বাস করত না।
১৬. চিত্র ও অলংকার বিদ্যা : নিত্য ব্যবহার্য মৃৎপাত্র ও প্রস্তর নির্মিত পাত্রের গায়ে নানা প্রকার অলংকার একে কারুশিল্পের দক্ষতা দেখিয়েছে। অশরীরী প্রেতাত্মার ভয়-ভীতি হতে দূরে থাকতে কোনো কিছু হতে রক্ষা পাবার আশায় তারা কবচ ব্যবহার করত। যেসব কবচ অলংকার মোহর ইত্যাদিতেও তারা শৈল্পিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে।
১৭. শিক্ষাব্যবস্থা : জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যাবিলনীয়রা প্রশংসনীয় ছিল। শিশুদের শিক্ষা দানের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল । ব্যাবিলনীয়রা গুণ, ভাগ, বীজগণিতের সরল সমীকরণ, পরিধি ও ব্যাসের প্রভৃতির ক্ষেত্রে তারা বিশেষ অধিকার ভোগ করত।
১৮. চিকিৎসাবিদ্যা: ব্যাবিলনীয়রা চিকিৎসাবিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে আসে। ব্যাবিলনীয়রা দাঁতের ব্যথা নিরাময়ে সূর্যমুখী ফুলের বীজ ব্যবহার করত, পেটের পীড়ায় ব্যবহার করত দুধ। কেশহীন মাথায় তেলের স্যাম্পু আর মদ ব্যবহার করত।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, শিক্ষা ধর্ম, শিল্পকলা, বিবাহ ব্যবস্থা, সামাজিক স্তরবিন্যাস সভ্যতা বিকাশের সকল উপাদানের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল ব্যাবিলনে। পরবর্তীতে নানা বিবর্তনবাদ ও ব্যাপ্তিবাদের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করে।