আসারিয়া মতবাদ : ইবনে খালদুনের ব্যবহারে এ শব্দটি বিশেষ পরিচিত হয়ে উঠে। এ শব্দকে ভিত্তি করে তিনি ইতিহাসের ব্যাখ্যা করেছেন এবং রাষ্ট্র সম্বন্ধে মতবাদ প্রদান করেছেন। তাঁর মতে, আসারিয়া রক্ত সম্পর্কের বা অন্য কোনো চিন্তার মাধ্যমে গঠিত হয় যা দ্বারা কোনো জনগোষ্ঠী নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার এবং রাজবংশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়। তার মতে কোনো চেতনা ব্যতীত সংগ্রাম করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
১. রক্ত সম্পর্ক : রক্তের সম্পর্কের প্রতি সম্মান প্রদর্শন খুবই স্বাভাবিক। মানুষ তার পরিজন ও রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় স্বজনকে ভালোবাসে। তারা কামনা করে যে, তারা যে কোনো ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। আত্মী-স্বজনের প্রতি অবিচার করা হলে বা আক্রমণ করলে মানুষ লজ্জা পায়। যা রাষ্ট্র সৃষ্টির বা ঐক্যবদ্ধতাকে উৎসাহিত করে।
২. প্রতিরক্ষা বাহিনী : খালদুন বলেন, প্রতিরক্ষা বাহিনী যদি একই বংশের লোক দ্বারা গঠিত হয় তখন সে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাফল্য মন্ডিত হয়। যাদের নিজ বংশের লোক নেই তাঁদের সহচরদের জন্য বিশেষ দয়া থাকে না। যুদ্ধের সময় তারা বিপদ থেকে পালিয়ে যায় অথবা মনযোগ ও অধ্যবসায় দিয়ে যুদ্ধ করে না।
৩. সাম্রাজ্য গঠন : ধর্মের ভিত্তিতে উপজাতীয় সদস্যরা শাসন ক্ষমতার সমান ভাগিদারি করলেও তিনি সে দাবি অগ্রাহ্য করেননি । তিনি সংহতিবোধ বা আসারিয়াতের উপর নির্ভর না করে তার ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য একটি ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র গঠন করেছেন।
৪. মৌলিক নীতি : তিনি বলেন, রাষ্ট্র দুটি মৌলিক নীতির উপর নির্ভরশীল; যথা-সংহতি ও ধর্ম। ধর্মের মাধ্যমে আসারিয়া তৈরি হয়। আর সামাবিয়া থেকে রাষ্ট্রের তৈরি হয় বা সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। রাষ্ট্রের পূর্বে আসারিয়া গোত্রগত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে। তার মতে, আসারিয়া যত শক্তিশালী হয় রাষ্ট্র ততো বিস্তৃতি লাভ করে। তবে আসারিয়া ধর্ম এ নিরপেক্ষ কোনো উৎস হতে গঠিত হতে পারে না।
৫. ধর্ম প্রতিষ্ঠার কৌম চেতনা : ইবনে খালদুনের মতে, কৌম চেতনা ব্যতীত ধর্মীয় প্রচারণা সাফল্য লাভ করে না। তিনি একটি হাদিস তুলে ধরেন, "নিজস্ব লোকজনের কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভ করেননি এমন কোনো লোককে আরে প্রেরিত পুরুষ হিসেবে পাঠাননি। জনসাধারণের মধ্যে যারা বিপ্লবী বা সংস্কার সাধনে অগ্রসর হয়েছিলেন তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
৬. রাজকীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা : রাজকীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তিনি আসাবিয়কে গুরত্ব দেন। তার ধারণা “আসারিয়া ও অর্থ' এ দুটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কর্তৃত্ব চালায়। আসারিয়াকে ইবনে খালদুন যাযাবর গোষ্ঠির মধ্যে বেশি লক্ষ্য করেছেন। তার মতে, প্রত্যেক রাজনৈতিক পরিকল্পনার মধ্যে আসারিয়া বিদ্যমান। তিনি পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ইউসুফ (আঃ) এর ঘটনাতে আসারিয়ার সমর্থন লক্ষ্য করেন। ইউসুফের নির্বাসনকে তার ভ্রাতারা কৌমহীনতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তার মতে, কৌম চেতনাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তিকে নষ্ট করা যায় না। কৌম চেতনার কারণেই যাযাবর বা মরুভূমিতে বাস করতে পারে। আর ধর্ম নিরপেক্ষ নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আসারিয়া ধর্মের মাধ্যমে আরো শক্তিশালী হয়।
৭. বিস্তৃত তত্ত্ব ও প্রামাণিক ধারণা : ইবনে খালদুনের আসারিয়া তত্ত্ব বিস্তৃত ও প্রামানিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠত আসারিয়ার ক্ষেত্রে ইবনে খালদুনের স্বকীয়তা ও সৃজনশীলতা লক্ষ্য করা যায়। সমাজ, সভ্যতা, রাষ্ট্র ও বিভিন্ন সামাজিক নীতিকে ইবনে খালদুন কৌম চেতনার ফলাফল হিসেবে মনে করেন। তবে তিনি নেতিবাচক দিকে এর প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন। অনেক সময় এটাকে ইসলামের দৃষ্টিতে বিরোধী মনে হলেও মূলত কৌম চেতনা কুরআন হাদীসেরই নীতির কারণ । তবে এটা অবশ্যই সংকীর্ণ গোত্র বা স্বার্থগত ধারণা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ হবে না।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের বা সভ্যতার উন্মেষে আসারিয়া মতবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ । এই মতবাদে শাসক শ্রেণির উত্থান-পতন কালে ইবনে খালদুন বর্ণিত শর্তাবলির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।