নব্য প্রস্তর যুগের উৎপাদন পদ্ধতি বিশ্লেষণ কর।

admin

 

ভূমিকা : মানুষ যে দিন থেকে পাথরের মাধ্যমে অস্ত্র ও হাতিয়ার বানাতে শেখে সেদিন থেকে শুরু হয় পাথরের যুগ। পাথরের যুগের সবচেয়ে উন্নত পর্যায় হলো নব্য প্রস্তর যুগ বা নবো পলীয় যুগ। পুরনো প্রস্তর যুগে সকল প্রকার খাদ্য গ্রহণ করা হতো খাদ্য সংগ্রহের মাধ্যমে, এজন্য তারা দলবদ্ধভাবে বের হতো। পশু শিকার ছাড়াও বনের ফলমূলও তারা সংগ্রহ করতো। কিন্তু নব্য প্রস্তর যুগে এসে মানুষ খাদ্য সংগ্রহকারী থেকে খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়।

নব্য প্রস্তর যুগের উৎপাদন পদ্ধতি বিশ্লেষণ কর।


 নব্য প্রস্তর যুগের উৎপাদন পদ্ধতি : নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ শিকারি পশুর উপর নির্ভরশীলতা কমে গিয়ে এক নতুন প্রগতি সাধিত হয়। এ সময় শিকার ও সংগ্রহের জায়গায় উৎপাদনমুখী প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ যুগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হলো কৃষি। বলা যায় কৃষিই একটি বিপ্লব। এ যুগে মানুষ খাদ্য সংগ্রহের পাশাপাশি বীজ বপন, গাছপালা লাগানো তা থেকে খাদ্য সরবরাহ, ফসল কাটা, পশুপালন, কাপড় বুননসহ বিভিন্ন বিষয়ে তারা পরাদর্শিতা অর্জন করে। নিম্নে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ


১. উৎপাদনের উপকরণ : যেকোনো উৎপাদনের জন্য যন্ত্র সহায়ক ও উপায় প্রয়োজন যার মাধ্যমে দ্রব্য উৎপাদন করা যায়। নব্য প্রস্তর যুগে উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হিসেবে নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ আবিষ্কার করে কুড়াল, ছুরি, কাস্তে, জাতি, নিড়ানি, মাটি গর্ত করার জন্য লাঠি। এ সময় কৃষির উন্নয়নের সর্বশেষ সংযোজন হলো কোদাল ও লাঙ্গল। এ সমস্ত যন্ত্রপাতি অধিকাংশ পাথর দ্বারা নির্মাণ করা হতো এবং লাঙ্গল টানতে পশুর ব্যবহারও তারা আয়ত্ত করে।


২. কৃষি কাজের সূচনা : কবে কোথায় কখন কৃষিকাজের সূচনা হয়েছে তা আজ মানুষের কাছে অজানা । নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ খাদ্য সংগ্রহকারীর পরিবর্তে খাদ্য উৎপাদনকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ যুগের প্রথম পর্যায়ে দেখা যায় যে, বাড়ির আশেপাশে অপ্রয়োজনীয় বীজ ফেলে রাখে তা থেকেই গাছের জন্ম। এটা তাদের নজরে আসে। এভাবে তারা ভাবতে থাকে কিভাবে মাটির উপর বীজ ছড়িয়ে দিয়ে অধিক ফসল পাওয়া যায়। এভাবেই সূচনা হয়েছিল প্রথম কৃষি কাজের। মূলত তারা যখন গুহা থেকে কোনো সমতল ভূমিতে বসবাস শুরু করে তখনই এই প্রক্রিয়ার উদ্ভব হয় ।


৩. কৃষি সূচনাতে নারী ভূমিকা : অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে কৃষি ও উৎপাদন ব্যবস্থার উৎপত্তি হয়েছে নারীর হাত ধরে। সমাজের পুরুষেরা দলবদ্ধভাবে ফলমুল ও শিকারি সন্ধানে বের হতো। এ সময় উক্ত কাজে পুরুষেরা বাস্ত সময় পার করত, ফলে তাদের ফসল ও উৎপাদনের দিকে নজর দেবার অবসর সময় তাদের ছিল না, কিন্তু মহিলারা সাধারণত গৃহস্থালী কাজ ও বাড়ির আশপাশে কিছু ফলমূল ও জ্বালানি সংগ্রহ করতো, ফলমূলের সাথে যব ও বার্লির বীজ আদ্র জায়গায় গজাতে দেখে তাদের মধ্যে কৌতূহল জন্মায়। ফলে এ অবস্থা থেকেই কৃষি বিপ্লবের সূচনা হয় ।


৪. কৃষি কাজে পশু ব্যবহার : মানব সভ্যতার উদ্দেশ্য নব্য প্রস্তর যুগে কৃষি আবিষ্কারের সাথে সাথে তারা পত পালনের কৌশলও রপ্ত করে। এজন্য পশু গৃহস্থকরণ ও কৃষি কাজে পশু ব্যবহার বিশেষ ভূমিকা পালন করে। নব্য প্রস্তর যুগ কৃষি কাজের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। এরই সাথে কৃষি কাজে পশুর ব্যবহার শুরু হয়, এ সময় কৃষি দ্রব্য পরিবহন, ভূমিকর্ষণ, লাঙ্গল টানা প্রভৃতির জন্য জীবজন্তুর ব্যবহার করা হতো।


৫. উৎপাদিত কৃষিজ দ্রব্য : নব্য প্রস্তর যুগেও বিভিন্ন ধরনের কৃষিজ দ্রব্য উৎপাদিত হতো, এ যুগে সবচেয়ে প্রাচীনতম প্রধান শস্য হলো গম ও বার্লি। কারণ এগুলো চাষ করা সহজ ছিল। বীজও যেখানে সেখানে পাওয়া যেত। বাইবেলেও উল্লেখ আছে প্রথম চাষযোগ্য ফসল হলো গম। সূত্র হতে জানা যায়, পেলেস্টাইনে প্রথম গম চাষ শুরু হয়। নব্য প্রস্তর যুগে গম ও বার্লি ছাড়াও ধান, রাই, যব চাষ করা হতো।


৬. স্বয়ংসম্পূর্ণ উৎপাদন ব্যবস্থা : নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ যা উৎপাদন করতো তা ছিল তাদের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ । এজন্য ঐ সময়ে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সকলের সামর্থনে ও দক্ষতা অনুযায়ী নারী, পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সকলের কাজ ভাগ করে দেওয়া হতো। সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালনসহ কাপড় বুনন, মাটির পাত্র তৈরি, গৃহস্থালী দ্রব্যসামগ্রী তৈরিতে নারীরা নিয়োজিত ছিল। অন্যদিকে পশু শিকার ও পালন করতো পুরুষেরা।


৭. উদ্বৃত্ত উৎপাদন : এ যুগে প্রয়োজনীয় উৎপাদনের সাথে উদ্বৃত্ত উৎপাদন শুরু হয়। উৎপাদন, কৃষি কাজের মাধ্যমে উৎপাদিত দ্রব্য তাদের খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করে। এতে নিজেরা ভোগ করার পরেও কিছু উদ্বৃত্ত থাকত, এই উদ্ধৃত্তাংশ তারা অভাবের সময় ব্যয় করতো।


৮. বিনিময় প্রথা চালু : নব্য প্রস্তর যুগে কোনো কেনা-বেচার প্রথা চালু হয়নি। কিন্তু তারা যে অভিনব প্রথা চালু করে তা হলো- বিনিময় ব্যবস্থা এ সময় যারা চাষ করত তারা কারিগরদের দিত দ্রব্য ও উৎপাদিত কৃষিজ। বিনিময়ে কারিগরি দিক মৃতশিল্প। শিকারের থেকে পমুর হাড় ও শিং নিত খনি কারিগরি বিনিময়ে গুহাতে যা পাওয়া যেত তার ভাগ দিত শিকারিকে। এভাবেই বিনিময়ের মাধ্যমে নানাবিধ চাহিদা পূরণ হতো।


৯. মৎস্য শিকার : খাবারের জন্য তারা যে শুধু উৎপাদন করত তা নয়। তারা সাধারণত নদীর ও সমুদ্রের মোহনায় করত। কারণ এখানে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যেত। যা ধরতে তারা বড়শি, বর্শা, কাঁটা, ঝুপি ব্যবহার করত।


১০. মৃৎপাত্র ব্যবহার : কৃষি কাজের সাথে তারা দ্রব্য সামগ্রী রাখার জন্য মৃৎশিল্পের উদ্ভব করে। তারা কাদা-মাটি দিয়ে প্রথমে অমসৃণ পাত্র বানাতো, তারা এগুলোকে প্রথমে রোদ্রো শুকিয়ে পারে তা আগুনে পুড়িয়ে ব্যবহারযোগ্য করত।


 উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মানব-সভ্যতার ইতিহাসে নব্য প্রস্তর যুগের উৎপাদন ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম। এ যুগেই তারা শুধু প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল না থেকে নিজেরা উৎপাদনের সূচনা করে। তারা খাদ্য সংগ্রহকারী থেকে খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়। এসময় তারা কৃষিজ উৎপাদনে অনেক যন্ত্রপাতিও আবিষ্কার করে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!