গ্রিক সভ্যতার ভৌগোলিক পরিচয় দাও। গ্রিক সভ্যতার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

admin

 

ভূমিকা : প্রাচীনকালে যে কয়েকটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে গ্রিক সভ্যতা একটি প্রধান ও অন্যতম সভ্যতা। প্রাচীনকালে সভ্যতা ও সংস্কৃতির যে ধারণা বর্ণিত হয়েছে তাতে করে অঞ্চলভেদে এর বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। এই বিবেচনা করে ঐতিহাসিকগণ সভ্যতা ও সংস্কৃতির সমন্বয় সাধন করতে চেয়ে বিশ্ব সভ্যতার বিভিন্ন সভ্যতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। নিম্নে গ্রিক সভ্যতার অবস্থান নিরূপণ করা হল ।

গ্রিক সভ্যতার ভৌগোলিক পরিচয় দাও। গ্রিক সভ্যতার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।


গ্রিক সভ্যতার ভৌগোলিক অবস্থান : একটি বিশেষ ধারণা প্রকাশের জন্য হেলেনিক (Hellenic) এবং হেলেনিস্টিক (Hellenistic) শব্দ দুটো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গ্রিক সভ্যতার গঠন পর্ব থেকেই হেলেনিক যুগের শুরু। এ সময় সভ্যতার মূল কেন্দ্র ছিল গ্রিক উপদ্বীপ এবং প্রধান শহর ছিল এথেন্স। হেলেনিক যুগের পরিধি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৭ অব্দ পর্যন্ত। এর পরই গ্রিস মেসিডোনের অধিকারে চলে যায়। মহান আলেকজান্ডার তার সাম্রাজ্যব্যাপী হেলেনিক সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে যে নতুন যুগের উদ্বোধন ঘটায় তাই হেলেনিস্টিক যুগ নামে পরিচিত। এ সময় গ্রিক সংস্কৃতির সাথে অগ্রিক সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটে এবং সংস্কৃতির কেন্দ্র এথেন্স থেকে পরিবর্তিত হয়ে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়। আনুমানিক ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে হেলেনিস্টিক সংস্কৃতির পতন ঘটে। হেলেনীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল ইজিয়ান অঞ্চলসমূহ, আয়োনীয় দ্বীপমালা, এশিয়া মাইনরের সাগর তীরে বেশকিছু গ্রিক উপনিবেশ এবং ২৫ হাজার বর্গমাইলের পর্বতমালা ও সরু সমতলভূমি সমন্বয়ে গঠিত গ্রিক উপদ্বীপ। সাগর সান্নিধ্য গ্রিসে নদীকেন্দিক সভ্যতার বদলে একটি সাগরীয় সভ্যতা গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিল।


উপদ্বীপে ভৌগোলিক বৈচিত্র্য সঠিকভাবে গ্রিসের জন্য আর্শীবাদ ছিল না। দেশটির অন্তরভাগে ছিল প্রচুর পাহাড়। পাহাড় প্রাকৃতিক দেয়াল হিসেবে গ্রিসকে অনেকগুলো ক্ষুদ্র অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষার ও তেমন সুযোগ ছিল না। জমি ছিল মোটামুটি অনুর্বর। গ্রিসের মূল ভূভাগের এক পঞ্চমাংশ জমিতে শুধু কৃষিকাজ চলত। শ্বেত পাথর ও গ্রানাইট পাথর ছাড়া তেমন কোনো খনিজ দ্রব্য গ্রিসে পাওয়া যায়নি।


সাধারণভাবে গ্রিস ভূখণ্ডের অবস্থান নির্দেশ করতে হলে বলা যায়, ইজিয়ান সাগর পূর্ব দিকে গ্রিসকে এশিয়া মাইনর থেকে পৃথক করেছে। অড্রিয়াটিক ও আয়োনীয় সাগর পশ্চিম দিকে ইটালি ও সিসিলি থেকে পৃথক করেছে। আবার দুটি উপসাগর দ্বারা অভ্যন্তরে গ্রিস ভূখণ্ড দুই অংশে বিভক্ত হয়েছে, যেমন, পশ্চিম দিকে কোরিন্থ উপসাগর (Gulf of Corinth) এবং পূর্বদিকে সারনিক উপসাগর (Gulf of Saronic)।


গ্রিসের উপকূলে বেশ কিছু সমুদ্র বন্দর গড়ে উঠেছিল। এ কারণে গ্রিকরা ব্যবসায়ী ও নাবিক হিসেবে দক্ষতা অর্জন করে। তাদের বাণিজ্য জাহাজ ইজিয়ান ও কৃষ্ণসাগরের তীরে বেশকিছু উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল।


গ্রিসে পর্বতসমূহ বিভিন্ন অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল বলে এখানে একক কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পরিবর্তে অনেকগুলো স্বাধীন নগর রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। পরবর্তীতে এই প্রভাব সামগ্রিকভাবে গ্রিকদের কোনো জাতিকে। পরিণত করেনি। নিজ নিজ নগররাষ্ট্রের প্রতি গ্রিকদের আনুগত্য ছিল।


 গ্রিক সভ্যতার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য : নিম্নে গ্রিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হল -


১. ভৌগোলিক অবস্থা : সাধারণভাবে গ্রিস ভূখন্ড নির্দেশ করতে হলে বলা যায়, ইজিয়ান সাগর পূর্বদিকে গ্রিসকে এশিয়া মাইনর থেকে পৃথক করেছে। এড্রিয়াটিক ও আয়োনীয় সাগর পশ্চিম দিকে ইটালি ও সিসিলি থেকে পৃথক করেছে। আবার দুটি উপসাগর দ্বারা অভ্যন্তরে গ্রিস ভূখণ্ড দুই অংশে বিভক্ত হয়েছে। যেমন- পশ্চিম দিকে কেরি। উপসাগর এবং পূর্বদিকে সারনিক উপসাগর।


২. সামাজিক অবস্থা : গ্রিক সমাজে সকল শ্রেণির মানুষের বসবাস ছিল। সেখানে অভিজাত, কৃষক, শ্রমিক, বণিক, ভূমিদাস ও কৃতদাসের সমন্বয়ে গ্রিক সমাজ গঠিত হয়েছিল। তবে সমাজে শ্রেণিবিন্যাস ছিল। সমাজের উচ্চতর স্থানে ছিল অভিজাত শ্রেণি। তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হত। তারা সমাজের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। অপর পক্ষে কৃষক, শ্রমিক শ্রেণিরা ছিল সমাজের নিম্নতম স্থানে। তাদের কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। তবে সমাজে বণিক শ্রেণির বেশ সুযোগ সুবিধা পেত।


৩. অর্থনৈতিক অবস্থা : গ্রিসের মূল অর্থনীতি ছিল কৃষি। কৃষির পাশাপাশি পশুপালনও করা হতো। কৃষি চাষের পাশাপাশি এরা বাণিজ্য সম্পর্কেও আগ্রহী ছিল। গ্রিক সভ্যতায় ব্যবসা-বাণিজ্য অগ্রগতি হয়েছিল। গ্রিকদের জমি ছিল। অনুর্বর। ফলে জমিতে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন হত না।


৪. সরকার ব্যবস্থা : গ্রীসে একসময় সরকার ব্যবস্থা ছিল রাজতান্ত্রিক। কিন্তু পরবর্তীতে সরকার ব্যবস্থা রাজতান্ত্রিকতার পরিবর্তে অভিজাত তান্ত্রিকতার রূপ লাভ করে। এতে করে গ্রিসে গণতন্ত্র বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা লাভ করে। ৩০ সদস্য বিশিষ্ট্য কাউন্সিল রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করত। তবে গ্রীক বিভিন্ন নগররাষ্ট্রে সরকার ব্যবস্থা বিভিন্ন ছিল।


৫. ধর্মীয় সংগঠন : গ্রিকরা বিভিন্ন দেবদেবীকে বিশ্বাস করত। তাদের মধ্যে পূর্ব পুরুষদের পূজা করার প্রচলন ছিল। তবে এই খ্যাতিমান পূর্ব পুরুষদের তারা পূজা করত। এ ছাড়াও তারা মাটি, প্রকৃতির পূজা করত। বিভিন্ন অঞ্চল ও নগরে তাদের নিজস্ব দেবতার পূজা করত। পূজার সময় তারা নানা রকম উৎসব ও আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করত।


৪. গ্রিক বিজ্ঞান : বিজ্ঞান ক্ষেত্রে গ্রিকরা ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। কারণ গ্রিককে বলা হয় জ্ঞান বিজ্ঞানের মিলন। ক্ষেত্র। সেখানে অনেক বিজ্ঞানী জন্ম গ্রহণ করেছেন। বিজ্ঞানী থেলিস সূর্য গ্রহণ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। এই সময় তারা পৃথিবীর মানচিত্র অংকন করেছিলেন। বিজ্ঞানী পিথাগোরাস জ্যামিতি সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছিলেন। হিপোক্রিটাস চিকিৎসা শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য দেখিয়েছিলেন।


৭. দর্শন শাস্ত্র : গ্রীককে বলা হয় দার্শনিকদের লীলা ভূমি। বিখ্যাত দার্শনিক থেলিস গ্রীসে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি দর্শন শাস্ত্রে ব্যাপক পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। গ্রিক দার্শনিকরা মানুষ এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উদ্ভব ও বিকাশের বিষয়বলি আলোচনা করতে গিয়ে সমৃদ্ধ দর্শন উপহার দেন।


৮. গ্রীক সাহিত্য : খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকে মহাকবি হোমার তার মহাকাব্য ইলিয়ড ও ওডেসি রচনা করেছিলেন। হোমার গ্রিক সাহিত্যকে একটি সমৃদ্ধ সাহিত্যে পরিণত করেন। সাহিত্য ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কৃতিত্ব দেখান হোসিওড। তিনি দেবতা ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মানুষের জীবন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন ।


৯. গ্রীক স্থাপত্য : গ্রিক স্থাপত্য রীতিতে তিনটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা- ১. ডোরীয় রীতি ২. আয়োনীয় রীতি ও ৩. কারিন্থীয় রীতি। গ্রিকরা স্থাপত্য শিল্পে ব্যাপক বিকাশিত হয়েছিল তাদের শিল্পের মননশীলতা ও শিল্পকলা ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তারা এক্সোকালিস এর মত বিখ্যাত শিল্পকর্মের স্রষ্টা।


১০. ভাস্কর্য শিল্প : গ্রিক ইতিহাসে ভাস্কর্যের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। গ্রিসের ভাস্করগণদের অনেক সম্মান করা হতো। ভাস্কর গণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- মাইনর, ফিদিয়াস এবং প্রাক্সিটেলেস। ফিদিয়াস ৭০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দেবী এথেনার মূর্তি তৈরি করেছিলেন। যা ছিল গ্রীক ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য কৃতি ।


১১. গ্রিক লিপি : গ্রিকদের লিপি সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। তারা ফিনিশীয়দের কাছ থেকে লিখন বিদ্যা আয়ত্ত করেছিল। ফিনিশীয়রা ২২টি বর্ণমালা উদ্ভাবন করেছিল। গ্রিকরা এর সাথে আরও ৪টি বর্ণ যোগ করে। যেগুলো ছিল ইংরেজী।


১২. গ্রিকদের খেলাধুলা : প্রথম অলিম্পিক খেলার প্রবর্তন করে গ্রীস। যেহেতু গ্রীসের অনেক চিন্তাবিদের জন্মভূমি। সেহেতু তারা সমগ্র বিশ্বকে একটি বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য তারা ৭৭৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এই অলিম্পিক খেলার প্রচলন করেছিল।


১৩.সামরিকব্যবস্থা : গ্রিকরা সামরিক ক্ষেত্রে কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতা পালন করেছিল। তারা হেলটদের সন্তানদের সেনাবাহিনীতে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল । সাত বছর বয়সের সময় তাদের সেনা ছাউনিতে যেতে হতো।


উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, গ্রিকরা ছিল একটি উন্নত রাষ্ট্র যেখানে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছিল। গ্রিকরা সাহিত্য, স্থাপত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন ক্ষেত্রে অগ্রগাম্য ছিল এবং তারা গণতন্ত্র চর্চায় ছিল সর্বোত্তম।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!