'ফরাসি বিপ্লবের জন্য ফ্রান্সের রাজতন্ত্র দায়ী ছিল'- ব্যাখ্যা কর।

admin

ভূমিকা :

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইউরোপে চালু ছিল তা 'Ancient regime' বা পুরাতন শাসন নামে পরিচিত। সমগ্র ইউরোপ তখন ছোটো বড় বহু সংখ্যক রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। একমাত্র ইংল্যান্ড ছাড়া অন্য সব শক্তিশালী দেশে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। রাষ্ট্র তখন জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র ছিল না। রাজতন্ত্র ও রাজবংশই ছিল রাষ্ট্রের মূলভিত্তি। প্রকৃতপক্ষে ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় রাজতন্ত্রের মধ্যযুগীয় ঈশ্বর প্রদত রাজক্ষমতা ও রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচার-এ দুয়ের সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়, যার প্ররিপ্রেক্ষিতে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়।


'ফরাসি বিপ্লবের জন্য ফ্রান্সের রাজতন্ত্র দায়ী ছিল'- ব্যাখ্যা কর।


ফরাসি বিপ্লবের জন্য রাজতন্ত্রের দায় বা প্রভাব :

নিয়ে ফরাসি বিপ্লবের জন্য রাজতন্ত্রের দায় বা প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :


১. স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র : অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ছিল রাজতান্ত্রিক। রাষ্ট্র ছিল রাজবংশোদ্ভূত কোনো বিশিষ্ট ভাগ্যবান ব্যক্তির সম্পত্তি। তাই স্বীয় সম্পত্তি রক্ষার্থে রাজা ছিলেন চরম স্বেচ্ছাচারী। একনায়কতন্ত্র বা একাধিপত্য ছিল রাজার মূলমন্ত্র।


২. আমলাতন্ত্র : ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার ব্যবস্থা আমলাতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করত। সরকার বা প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল মুষ্টিমেয় কয়েক জনের হাতে কুক্ষিগত। জনগণের অধিকার বা স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদৌ ছিল না। রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রতিনিধি সভা ছিল বটে কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ছিল রাজা কর্তৃক মনোনীত। স্বাধীনভাবে কাজ করার কোনো ক্ষমতা তাদের ছিল না।


৩. স্বেচ্ছাতন্ত্র : মধ্যযুগে ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহে ব্যাপক হারে স্বেচ্ছাচারিতার বিকাশ ঘটে। সর্বপ্রকারের মানবাধিকারের মূলে কুঠারাঘাত করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্বৈরাচারী শাসন। তৎকালীন রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না। রাজাই সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। এ প্রসঙ্গে চতুর্দশ লুই বলেন, “আমিই রাষ্ট্র” আর ষোড়শ লুই বলতেন, ”আমি যা তাই আইন।” এ থেকে বুঝা যায়, তৎকালীন রাষ্ট্রে স্বেচ্ছাতন্ত্র সর্ব শিখরে পৌঁছেছিল।


৪. ঈশ্বর প্রদত্ত রাজতন্ত্র: মধ্যযুগীয় শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রপরিচালনায় 'ঈশ্বর প্রদত্ত অধিকার' দাবি করত। তারা মনে করত জনগণকে শাসন করার জন্য ঈশ্বর তাদের নিয়োগ করেছেন। তাই নির্যাতন, নিপীড়ন, উৎপীড়ন-এসবই যেন নিয়তি সুনির্দিষ্ট করে লিখে রেখেছিল জনসাধারণের ললাটে। রাজার অবৈধ কার্যকলাপের সমালোচনা করার কল্পনাও জনসাধারণ করতে পারত না।


৫. রাজার দায়িত্বহীনতা : ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের রাজা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও দায়িত্বহীনতার কারণে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করত। অবশ্য অনেক রাজা এর ব্যতিক্রমও ছিল। যেমন- চতুর্দশ লুই স্বৈরাচারী হলেও জনগণের কল্যাণসাধনের চেষ্টা করতেন। অন্যান্য রাজার বেশির ভাগ ছিল দুর্বল, বিলাসী ও অকর্মণ্য। অর্থাৎ রাজতন্ত্র ফরাসি বিপ্লবের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল।


৬. দুর্নীতিপরায়ণ শাসনব্যবস্থা : ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপে বিশেষ করে ফ্রান্স প্রায় ৪০টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। এসব বিভক্ত অঞ্চলে যেসব উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ ছিল তারা নিজেদের ইচ্ছামতো শাসনকার্য পরিচালনা করত, এমনকি তারা রাজাদেরও এড়িয়ে চলত তৎকালীন শাসনব্যবস্থায় কোনো নিয়মনীতি না থাকায় রাজ্যের সর্বস্তরের শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতিতে ভরে গিয়েছিল।


৭. রাজতন্ত্রের বিচারব্যবস্থা : ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে একমাত্র ইংল্যান্ড ছাড়া ইউরোপীয় আর কোনো দেশে সুষ্ঠু বিচার- ব্যবস্থার প্রচলন ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে বিচারালয়গুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট বিচার ক্ষমতাও থাকত না, এমনকি আইন- কানুনগুলোও সংকলন বা সংরক্ষণ করা হতো না।


৮. ইনটেনডেন্টগণের অত্যাচার : ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের আমলারা রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে স্বীয় স্বার্থের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠত এবং এসব আমলা কর্তৃক নিযুক্ত ইনটেনডেন্টরা দেশে শাসনের নামে শোষণ করতে থাকে। তাদের চরম উচ্ছৃঙ্খলতায় সর্বস্তরের জনগণের জীবন একেবারে দুর্বিষহ হয়ে উঠে। এসব ইনটেনডেন্টগণ দেশ ও জাতির কোনো রূপ কল্যাণ না করে স্বীয় ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক তৎপর ছিল।


উপসংহার :

আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাক ফরাসি বিপ্লব ইউরোপের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বৈরাচার রাজতন্ত্র এবং আমলাতন্ত্রের শাসন, শোষণ ও নির্যাতন ইউরোপের জনগণকে রাজতন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধা করে তুলেছিল। তাই বলা যায় ফরাসি বিপ্লবের জন্য ফ্রান্সের রাজতন্ত্র দায়ী এ কথা আর বলার অপেক্ষা থাকে না।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!