ভূমিকা :
মানব সভ্যতার ইতিহাসে সিন্ধু সভ্যতার অবদান অপরিসীম। মিশর ব্যাবিলনীয়রা প্রভৃতি সভ্যতায় সমসাময়িক এক ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা প্রায় হাজার বছর পূর্বে ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল। বৈদিক সভ্যতাকেই ভারতবর্ষের সর্বপ্রাচীন সভ্যতা বলে যে ধারণা এতোদিন চলে আসছিল নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে তা সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়। তবে বিভিন্ন কারণে এ সভ্যতার পতন ঘটে।
সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ :
লিখিত উপাদন, ঐতিহাসিক দলিলের অভাবে সিন্ধু সভ্যতার পতন সম্পর্কে সঠিক কাল জানা যায় না । ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা পতনের বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছেন।
১. অভ্যন্তরীণ সংকট : বৈদেশিক আক্রমণকে কেউ কেউ এ সভ্যতার পতনের প্রধান কারণ বললেও খনন কাজের ফলে এর অভ্যন্তরীণ সংকট দৃশ্যমান হয়। কৃষির বিপর্যয়কে অন্যতম অভ্যন্তরীণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বালুভূমির প্রসার, অপরিকল্পিত বৃক্ষ কর্তনের ফলে কোনো কোনো অঞ্চল বনশূন্য হয়ে পড়ে। ১৯০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য ভাটা দেখা যায়। এ সভ্যতার প্রধান কেন্দ্রগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যায়, তাতে কারিগরি পেশ ও বাণিজ্য সত্যতার গুরুত্ব হারায়। কোনো কোনো সভ্যতা সংকট উত্তরণের চেষ্টা করলেও সিন্ধু সভ্যতার লোকজন তাকে বিশেষ নজর দেয়নি।
২. ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন : সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলের শাখা নদীসহ অপরাপর অংশ শুষ্ক মরু অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। সিন্ধুনদের গতিপথ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় জলাভাবে ভূপৃষ্ঠের ক্রমবর্ধন শুদ্ধতা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণ।
কিভাবে সুইপার সোশ্যাল ( Swiper social) যুক্ত হয়ে টাকা ইনকাম করবেন?
৩. পৌর সুবিধা শিথিল : সিন্ধু সভ্যতার গৌরব নগর পরিকল্পনা ও পৌর ব্যবস্থা ক্রমশ ভেঙ্গে পড়ে। মহেঞ্জোদারো হরপ্পা ও অন্যান্য নগরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃহৎ অট্রালিকার বদলে পুরনো ইটের বাড়ি তৈরি হয়। এমনকি বাড়ি ঘরগুলো রাজপথের উপরে এসে পড়ে এবং একটি বিশৃঙ্খল শহরে পরিণত হয়।
৪. বন্ধুত্ব : সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ হিসেবে অনেকে এ সভ্যতার বন্ধাত্বকে দায়ী করেছেন। সমসাময়িক সভ্যতার প্রতিযোগিতায় এ সভ্যতা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে। সমসাময়িক মিশরীয়, সুমেরীয়রা, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও সিন্ধু অঞ্চলের মানুষের অনগ্রসর মন-মানসিকতার জন্য এ সভ্যতা একটা পর্যায়ে পর আর আগাতে পারেনি। এমনকি তারা বৈদেশিক আক্রমণ মোকাবেলা ও সক্ষম হয়নি।
৫. লোকসংখ্যা বৃদ্ধি : লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বড় বড় দালানের ঘরগুলো ছোট ছোট ঘরে ভাগ করে নিয়েছিল মহেঞ্জোদারো শহরটি ক্রমে শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়ে শ্রীহীন, শৃঙ্খলহীন শহরে পরিণত হয়।
৬. সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তন : সিন্ধু বা সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে তার শাখা নদীর অববাহিক অঞ্চল ভিন্ন অপরাপর শুষ্ক মরু অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
৭. সিন্ধু সভ্যতার সম্প্রসারণ : সিন্ধু সভ্যতার অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ক্রমেই নাগরিক উৎকর্ষতা হারিয়ে ফেলে ছোট ছোট কক্ষে ভাগ করা হয়, বড় বড় অট্টালিগুলো দারিদ্র্যতার ফলে বাসস্থান খিঞ্জি বস্তিতে রূপান্তরিত হয়। দলে শ্রীহীন ও শৃঙ্খলাবর্জিত শহরে পরিণত হয় মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা শহর দুটি।
৮. প্রাকৃতিক বিপর্যয় : দু'ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা জানা যায়। যেমন-বন্যা ও ভূমিকম্প। মহেঞ্জোরো নগরের কাছে ভয়াবহ ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল এর ফলে এ নগরী ধ্বংস হয়েছিল। ২৭৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে প্রলয়কারী বন্যায় শহর দুটো ব্যাপক ক্ষতি হয়। সিন্ধু নদের বার্ষিক বন্যাকে এ সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ বলা হলেও তা সব স্থান ও সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। যেমন-কালিবঙ্গান। এখানে বন্যার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এখানে বন্যার প্রকোপ ছাড়াই শহরটির অবক্ষয় দেখা দেয়।
৯. মরু অঞ্চলের ক্রমপ্রসার : মরু অঞ্চলের ক্রমপ্রসার সিন্ধু সভ্যতা বিকাশ বা ধ্বংসের অন্যতম কারণ হিসেবে পণ্ডিতগণ মনে করেন। আর্দ্রতাহীন, শুষ্ক মরু অঞ্চলে পরিণত করে সে সভ্যতা ধ্বংসের জন্য রাজপুতনার মরুভূমি সম্প্রসারণ অনেকাংশে দায়ী ছিল।
১০. আর্যদের আক্রমণ : সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে আর্যদের আক্রমণ। আর্যদের আক্রমণের ফলে এ সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
১১. বৈদেশিক আক্রমণ : মহেঞ্জোদারোর রাস্তা, সিঁড়ি ও বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু কংকাল উদ্ধার এবং এগুলোর কোনোটির মাথার খুলিতে ভারি অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন থেকে অনুমান করা হয় বহিরাগতদের দ্বারা এ সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। অনার্য ও অন্যান্য জাতির লোকের কংকাল প্রাপ্তি থেকে অনেকে মনে করেন সিন্ধু উপত্যকার বহিরাগত শত্রুর মোকাবেলা করতে হয়েছে। বেলুচিস্তান ও ইরানের কয়েকটি উপজাতির লোকের সঙ্গে এসব অস্থি ও কংকালের মিল থেকে কেউ কেউ বহিরাগত আক্রমণকারীদের আর্য বলতে নারাজ।
উপসংহার : উপযুক্ত কারণগুলোর মধ্যে কোন কারণটি সিন্ধু সভ্যতা পতনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তা সম্পূর্ণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা নামক জনপদ দুটো মৃত্তিকার গহীনে তলিয়ে যায় । ভূমিকম্প স্থান বিচ্যুতি, নদীর পথ পরিবর্তন ইত্যাদি কারণেও এ সভ্যতা ধ্বংস হতে পারে।