ভূমিকা: সিন্ধু নদের অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ থেকে ১৯০০ অব্দের মধ্যে এ সভ্যতার পূর্ণ পরিণতি সূচিত হয়েছিল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এ সভ্যতা প্রাচীন মিশরীয় ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সমকালীন বলে স্বীকৃত।
সিন্ধু সভ্যতা : পৃথিবীর প্রাচীন সকল সভ্যতা বৃহত্তম নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। আনুমানিক ৩,০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ভারত উপমহাদেশের সিন্ধুসভ্যতা। প্রত্নতত্ত্ববিদ জন মার্শাল এ সভ্যতাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা এবং লিওনার্ড উলি একে “যেমন বিস্ময়কর তেমনি অপ্রত্যাশিত বলে অভিহিত করেছেন।” সিন্ধু নদের মোহনা থেকে পঞ্চনদের সমতলভূমি পর্যন্ত বিরাট এলাকায় সে সময় চাষের কাজ চলত। সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের ফলে প্রমাণিত হয় এ সভ্যতা শুধু ভারত উপমহাদেশের প্রাচীন নয়, বরং মিশর সুমেরীয় আক্কাদীয় ব্যাবিলনীয় ও অ্যাসেরীয় সভ্যতার সমসাময়িক ।
তৃতীয় নগর বিপ্লবের কেন্দ্র বলে মনে করা হয় সিন্ধু সভ্যতাকে। হরপ্পা ও মহেনজোদারো নামে দুইটি নগরের মধ্যে পাওয়া গিয়াছে। একটি হচ্ছে ইরাবতীর ধারে, বর্তমানে পাকিস্তানের লাহোর থেকে একশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম পাঞ্জাবের মন্টোগোমারী জেলায়; অন্যটি সিন্ধু প্রদেশে সিন্ধু নদের তীরে মহেনজোদারো। তবে নগর দু'টির মধ্যে সমস্ত দিক দিয়ে পুরোপুরি মিল ছিল। ঘরবাড়ি তৈরি করার জন্য যে ইট দুইটি নগরের মধ্যে ব্যবহার করা হতো তা একই ধরনের। তাই অনেকেই মনে করত হরপ্পা ও মহেনজোদারো যেন একই রাজ্যের দুটি রাজধানী বা সংস্কৃতির দুটি অবস্থান ।
কিভাবে সুইপার সোশ্যাল ( Swiper social) যুক্ত হয়ে টাকা ইনকাম করবেন?
১৮৭৫ সালে ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ কানিংহাম হরপ্পার অপরিচিত লিপি লেখা একটি সীলের সন্ধান পান। ১৯২১-২৪ সালে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তা রায় বাহাদুর দয়ারাম সোহানী, রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, স্যার জন মার্শালের নেতৃত্বে প্রত্নতাত্ত্বিক দল সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন আবিষ্কার করেন।
আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনায় মানুষের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস, অনুষ্ঠান কার্যাবলি জ্ঞান, আইন, রীতিনীতি, নেতৃত্ব, শিল্প, সাহিত্য ও ধর্ম ইত্যাদির সমন্বিত রূপ হলো সংস্কৃতি। আর তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে সিন্ধু সভ্যতায় ।
সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা :
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে সভ্যতার প্রধান নিদর্শন আবিষ্কৃত হলেও এ সভ্যতা স্থানীয় সভ্যতা ছিল না। সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ভারতজুড়ে এ সভ্যতার বিকাশ ঘটে। নিম্নে সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. হরপ্পা : ১৯২১ সালে পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাবের হরপ্পা নামক স্থানে এ সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছিল একে হরপ্পা সভ্যতা বলা হয় । তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতার মধ্যে হরপ্পাই সেরা। এ দুর্গ নগরীর একদিকে অভিজাতদের বাস অন্যদিকে সাধারণ লোকের বাস ছিল।
২. মহেঞ্জোদারো : পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারো অবিস্থত। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর দূরত্ব প্রায় ৪৮৩ কিলোমিটার। সিন্ধু নদ এদের সংযোগ স্থাপন করেছে।
৩. চানহুদারো : মহেঞ্জোদারোর ৮০ মাইল দক্ষিণে চানহুদারো অবস্থিত। এখানে প্রথম ১৯৩১ এবং পরে ১৯৩৫- ৩৬ সালে খনন কাজ করে। এখানে অবিস্থত ঘর-বাড়ি মহেঞ্জোদারোর মতো।
৩. আমরি : মহেঞ্জোদারো থেকে ৮০ মাইল দূরে ননীগোপাল মজুমদার ১৯২৯ সালে চানহুদারো থেকে ২০ মাইল পশ্চিমে এ শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। এখানে নানান তামা, মৃৎপাত্র ও ব্রোঞ্জের টুকরা পাওয়া গিয়াছে । ৫. কোটদিজি ঃ পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পরিচালক এফ. এ. খান ১৯৪৮ সালে বেলুচিস্তানের কোয়েটা বিভাগের কোটদিজি শহর আবিষ্কার করেন।
৬. লোথাল : গুজরাটের ক্যাম্বে লোথাল মহেঞ্জোদারোর অনুরূপ নগর পরিকল্পনার নিদর্শন পাওয়া যায়। এছাড়া সীলমোহর, মৃৎপাত্রের সঙ্গে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে।
৭. কালিবঙ্গান : উত্তর রাজস্থানের কালিবঙ্গান শহর হরপ্পা সভ্যতার বৃহৎ নগরী। এখানে পাকা ঘর-বাড়ি ছাড়াও বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে।
৮. আলী মুরাদ : আলী মুরাদ সিন্ধুর কাদু থেকে ২০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
৯. বানওয়ালি : হরিয়ানার বানওয়ালিতে প্রাক হরপ্পা ও হরপ্পা যুগের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। হরপ্পা অধ্যায়ে মাটির তৈরি মঞ্চ, রাস্তাঘাট ও পয়ঃপ্রণালি নির্মিত হয়েছিল।
১০. লোহামজোদারো, গাজি : সিন্ধুর অপর গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো লোহামজোদারো ও গাজি সিন্ধু সভ্যতার বহু নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে।
১১. সুরকোতাদা : গুজরাটের আহমেদাবাদের ২৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সুরকোতাদা শহর। এখানে দুর্গ আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো এবং কালিবঙ্গানের অনুরূপ নিদর্শন পাওয়া যায়।
১২. অন্যান্য শহরঃ ১৯৫০-৫১ সালে খনন কাজের ফলে ২৫টি হরপ্পা সংস্কৃতির স্থান পাওয়া যায়। গুজরাটের কাথিয়াওয়ার উপদ্বীপের রংপুর ও রাজাদিয়াতে হরপ্পা সভ্যতার শেষ পর্যায়ের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন ভারতীয় সিন্ধু সভ্যতাটি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সভ্যতার উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে ক্যাম্বে উপসাগর, আরবসাগর এবং পশ্চিমে ইরান-পাকিস্তান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।