ঐতিহাসিক যুগের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা : মানব সভ্যতার ইতিহাস অতিদীর্ঘ। লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রা। মানব সভ্যতার যে সময়ের উপর অলিখিত উপাত্তের সাথে সাথে লিখিত বিবরণও পাওয়া যায় তাকে ঐতিহাসিক যুগ বলে। সুমেরীয়দের উন্নত লিখন পদ্ধতি কিউনিফর্ম ও মিশরে উদ্ভাবিত লিখন পদ্ধতি হায়ারোগ্রাফিক বর্ণমালা, প্যাপিয়াস লিখনযন্ত্র উদ্ভাবনের পর প্রায় ১০ হাজার বছর পূর্বে এ যুগের সূচনা বলে ধারণা করা হয় যা এখন অবধি অব্যহত রয়েছে। লিখিত উৎসের মধ্যে অতি প্রাচীন পান্ডুলিপিমালা, সন্ধিযুক্ত মুদ্রিত পুস্তকের সাথে বর্তমান আধুনিক যুগের তথ্য প্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিক মাধ্যম যুক্ত হয়েছে।


ঐতিহাসিক যুগের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।


ঐতিহাসিক যুগের শ্রেণিবিভাগ :

সাধারণত যে সময়কাল হতে স্পষ্ট ইতিহাস পাওয়া যায় তাকে ঐতিহাসিকরা ঐতিহাসিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই ইতিহাস বর্ণনার সুবিধার্থে ঐতিহাসিকগণ ঐতিহাসিক যুগকে চার ভাগে বিভক্ত করে বর্ণনা প্রদান করেন। এছাড়া এটা ঐতিহাসিক যুগের কাল বিভাজনও বটে। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হল -


১. প্রাচীন যুগ (Ancient period) : প্রাচীনকালের বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে বিভিন্নভাবে ধরা হয়। এর মধ্যে এশিয়া ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদের সময়সীমাকে ভিন্নভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ইউরোপের ইতিহাস অতি প্রাচীন কাজ থেকে। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দের পশ্চিম রোমান সম্রাজ্য পতন পর্যন্ত সময়কে ইউরোপের প্রাচীন যুগ ধরা হয়। আবার ভারতের ইতিহাসে আদিকাল থেকে ১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজির কর্তৃক ভারতের হিন্দু ক্ষমতা অবসানের পর মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সময় কালকে প্রাচীন যুগ বলা হয়। এ দীর্ঘ সময়ের শেষ আট-দশ হাজার বছরে মানুষ সভ্যতার স্তরে উপনীত হয় এবং মেসোপটেনিয়া মিশর সিন্ধু, ব্যাবেলিয়ন, সুমেরীয়, চীন, পারস্য, গ্রিক, রোমান প্রভৃতি বড় বড় সভ্যতা গড়ে ওঠে। এ সময় বিভিন্ন দেশে দেশে বিশেষত প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতার ইহজাতিক উন্নতি ও মানবতাবাদের চরম উৎকর্ষতা সাধিত হয়। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানদের হাতে রোম নগর ধারা পতনের মধ্য দিয়ে এ স্মিত হয়ে পড়ে এবং ক্রমেই তার লোকস্মৃতি মুছে যায় ।


২. মধ্যযুগ (Medieval period) : ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রোমান সম্রাজ্যের রাজধানী রোম জার্মানি কর্তৃক দখল করার পর থেকে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ সময় পর্যন্ত কালকে মধ্যযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া অটোম্যান তুর্কিদের হাতে পূর্ব রোমান বাইজাইন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল পতন পর্যন্ত সময়কালও হলো মধ্যযুগ বলে পরিচিত, এ সময় গ্রিক ও রোমান কেন্দ্রিক ধর্ম ছিল জীবনের প্রধান উপজীব্য। ধর্মীয় নেতা কর্তৃক মানুষ বেশি নিয়ন্ত্রিত ছিল। এ সময় ইহকালিন চিন্তা-চেতনার জায়গায় পরকালিন চিন্তা-চেতনা স্থান পায়। আদি পাপ, শয়তানের প্ররোচনা, অনন্ত সুখের অন্তিম স্বর্গপ্রাপ্তির নিমিত্তে সততা, উৎকণ্ঠা, চির দুঃখের স্থান নরক হতে পরিত্রাণের উপায় উদ্ভাবন, ধর্মগু ধর্মনেতা, ধর্মপ্রচারকের প্রাধান্য লাভ করে। পোপতন্ত্র ও খেলাফতের একছত্র ক্ষমতা ভোগ মধ্যযুগের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এ দীর্ঘ এক হাজার বছর ধরে খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রা। চিন্তা-চেতনা নিয়ন্ত্রণে প্রয়াসী হয়। সাধারণত এ যুগকে ঐতিহাসিকগণ বিশ্বাসের যুগ বলে অবিহিত করেছেন ভারতীয় উপমহাদেশে ১২০৪ সাল থেকে পলাশী যুদ্ধে সময়কাল ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত সময়কে মধ্যযুগ ধরা হয়েছে।


৩. আধুনিক যুগ (Modern period) : খ্রিস্টীয় ১৪৫৬ সাল থেকে তুর্কি মুসলিম দ্বারা কনস্টান্টি নোপাল দখল হলে এর সময়কাল হতে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ অবধি সময়কালকে সাধারণত আধুনিক যুগ ধরা হয়। আধুনিক যুগের শুরুতেই সামন্ততন্ত্রের জায়গা দখল করে পুঁজিবাদী, গ্রামীণ থেকে নগর জীবন। কৃষির পরিবর্তে শিল্প কারখানা উদ্ভাবন, অন্ধ ধর্ম বিশ্বাস ও কুসংস্কারের পরিবর্তে আধুনিক যুগে স্থান করে নেয় যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান। এ যুগের সূচনা মূলত বেনেসাঁর সময়কাল থেকে। এর ফলে মানুষের মুক্ত চিন্তা শক্তি প্রকাশ ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে প্রত্যাবর্তনের জন্য পরিবর্তন সূচিত হয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ইতিহাস চিন্তা ও দর্শনের মনোভাব ও বিজ্ঞানের উদ্ভাবন। এ সময় মানুষের লালিত আদর্শ মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের উন্নতি ঘটে। মধ্যযুগের অন্ধ বিশ্বাস ভেঙ্গে যেতে থাকলে তখন পৃথিবীর নবযুগের সূচনা উন্মোচিত হয়। তবে আধুনিক যুগের সূচনাতেই নানা আবিষ্কার ও উদ্ভাবন মানুষের জীবনে গতি সঞ্চার করেছে। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারতা বেড়েছে বহুগুণ। তবে অতিমাত্রায় উৎসাহী মানুষ একে অপরের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে তারা তাদের জ্ঞানকে মানুষের ধ্বংসের লিন্দায় পরিণতি মেতে ওঠে। যে কারণে এ যুগে সূচিত হয় পর দুইটি মারাত্মক ও ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ। এটাই আধুনিক যুগের শেষ।


৪. আধুনিক উত্তর যুগ (Post modern period) : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় মানুষ তাদের মেধা ও শ্রম। মহাবিশ্বের পরিক্রমায় নিয়োজিত করতে থাকে। এই যুগের প্রথম মহাকৃতি ১৯৬২ সালে ইউরো গ্যাগারিনের মহাকাশ ভ্রমণ, ১৯৬৯ সালে মাইকেল কলিন্স; এডউইন অলড্রিন ও নীল আর্মস্ট্রং এর চাঁদে অবতরণ। মহাবিশ্বে একটি আলোড়ন। সৃষ্টি করে দেয়। এর সাথে তথ্য প্রযুক্তির দ্রুততা প্রকৃতি আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্যকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছে। এসব পরিবর্তনের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিবর্তনের সময়কালকে উত্তর আধুনিক যুগ হিসেবে অবহিত করা হয়। পরিবর্তনের ধারা এখন সর্বত্র বিরাজমান। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এ যুগের পরবর্তী নামকরণ করা হতে পারে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ বর্তমান প্রতিনিয়ত নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে। বিশ্বায়নের চিন্তা সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতি ঘিরে আছে। বিশ্বায়নে সকলে একটি জালের মধ্যে আবদ্ধ। যেসব কারণে মানুষের জীবন বর্তমান অতি আধুনিকতার মধ্যে নিমজ্জিত।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, যে সময় থেকে মানুষ লিখন পদ্ধতি উদ্ভাবন ও নগরায়নের মাধ্যমে নতুন পর্যায়ে পদযাত্রা করতে সক্ষম হয়েছে সে সময়কাল হতেই ঐতিহাসিক যুগের সূচনা। তবে এর সময়কালের সূচনার বিষয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিবেদ বিদ্যমান। মূলত তারা অনেকটা একমত যে, পাথরের যুগের পরেই ঐতিহাসিক যুগের সূচনা যা আজ অবদি চলমান এবং অনন্তকাল চলবে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!