মধ্য প্রস্তর যুগ কি? মধ্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।

admin

ভূমিকা : সভ্যতাকে বলা যায়, পরিবর্তনের ইতিহাস। প্রাচীনকালে মানুষ ছিল সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল । এমনকি তারা শিকারে কৌশলও জানতো না। প্রাচীন যুগ পার করে মানুষ যখন প্রস্তর যুগে প্রবেশ করে তখন তারা হাড় ও পাথরের তৈরি হাতিয়ার দিয়ে পশু শিকার করে। মানুষের এই প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা থেকে বিভিন্ন স্তরে উপনীত হওয়ার প্রক্রিয়া যেখানে আলোচিত তা হলো প্রাগৈতিহাসিক যুগ। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মধ্যবর্তী যুগ হলো মধ্য প্রস্তর যুগ।


মধ্য প্রস্তর যুগ কি? মধ্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।

মধ্য প্রস্তর যুগ : বিভিন্ন নিদর্শনের ভিত্তিতে অনুমান করা হয় পুরানো প্রস্তর যুগের অবসান ঘটে ১০ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এ যুগের অবসান ও নব্য প্রস্তর মধ্যবর্তী যুগকে মধ্য প্রস্তর যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আনুমানিক ৮,০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে থেকে এর সূচনা হয়। অবশ্য বিভিন্ন অঞ্চলে এ যুগের সূচনা হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে সময়ে। প্রস্তা যুগে অধিকাংশ পাথরের হাতিয়ার ছোট হয়েছে এবং এর সাথে নতুন সামগ্রী যুক্ত হয়েছে। যদিও এ যুগে মানুষ খাম সংগ্রাহক থেকে উৎপাদনকারী হতে পারেনি। এ কারণে ব্যাপক অর্থে বলতে হয়, ইউরোপসহ অন্যান্য মহাদেশীয় ই ভাগে মধ্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি প্রকৃত পক্ষে পক্ষে প্রাচীন প্রস্তর যুগের ব্যাপ্তী ছাড়া আর কিছুই নয় । এ সময়কালকে কেউ কেউ প্রাচীন প্রস্তর যুগের অবসানকাল বলেও উল্লেখ করেছেন।


 মধ্যপ্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য : নিম্নে পূর্ব প্রস্তুত যুগ পরবর্তী মধ্য প্রস্তর যুগের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা করা হলো-


১. খাদ্য : মধ্য প্রস্তর যুগে মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল মাছ ও মাংস । মাছ ধরা বড়শি, জান, ফাঁদ, তিন পা ওয়ালা মাছ ধরার বশা, ত্রিতল এবং উড়ন্ত পাখি মারার পালক বিশিষ্ট তাঁর আবিষ্কারের ফলে আগের চেয়ে বেশি শিকার সম্ভব হয়। ছোট ছোট প্রাণী যেমন খরগোশ, পাখি শিকার বেড়ে যায়। যখন পশু শিকার মিলত না তখন তারা নদী বা সমুদ্র উপকূলের মোহনায় মাছ ধরে খাদ্য সংগ্রহ করতো। এছাড়াও তারা শাক-সবজি, প্রচুর পরিমাণে ফল বন-জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করতো।


২. বস্ত্র : পুরানো প্রস্তর যুগে মানুষ বস্ত্রহীন উলঙ্গ থাকলেও তারা অনেক সময় শীত থেকে বাঁচতে পশুর চামড়া ব্যবহার করতো। এছাড়া গাছের ছাল-বাকল দিয়ে নিজেদের লজ্জা নিবারণ করতো। কিন্তু মধ্য প্রস্তর যুগে এসে মানুষ লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড়ের আবিষ্কার করতে না পারলেও প্রস্তর যুগ থেকে উন্নত বস্ত্র ব্যবহার করতো। চামড়াগুলো তারা প্রক্রিয়াজাত করে অর্থাৎ, একটার সাথে অন্যটা যুক্ত করার মাধ্যমে নিজেদের শরীর অনুপাতে সেলাই করে ব্যবহার করাতো।


৩. বাসস্থান : মধ্য প্রস্তর যুগেও মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস শেখেনি। পুরানো প্রস্তর যুগের মানুষের মতোই তারা যাযাবর ছিল। তবে পুরানো প্রস্তর যুগের মানুষ ছিল অতিমাত্রায় যাযাবর প্রকৃতির। কিন্তু মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ ঘর বানাতে শেখে। তারা পাহাড়ের গুহাগুলো ভালোমতো বসবাসের উপযোগী করে তোলে। তারা হিংস্র জীব-জন্তুর হাত থেকে বাঁচতে গাছের মাঝে শব্দ করে ঘর বানাতে পারতো। তবে খাদ্য সংকট দেখা দিলে তারা খাদ্য সন্ধানে স্থান ত্যাগ করতো।


৪. পশুপালন : মধ্য প্রস্তর যুগের কোনো এক সময় পশু পালন শুরু হয়। যতদূর জানা যায়, কুকুরই মানুষের প্রথম গৃহ পালিত জন্তু। ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে সম্ভবত কুকুর বন ছেড়ে মানুষের কাছাকাছি এসেছিল। এক পর্যায়ে কুকুরগুলো তাদের গৃহ পাহারার কাজে ব্যবহার করতো। এছাড়া অধিক মাত্রায় পশু শিকার হলে তারা অক্ষত পশুগুলো যেগুলো সহজ পোষ মানানো যেত সেগুলো তারা পালত। যা দুর্যোগও খাদ্যভাব মেটাতে সহায়ক ছিল।


৫. বসবাসের স্থান : মধ্য প্রস্তর যুগে মানুষ সরাসরি গুহায় বসবাস করতো না। তারা সহজে খাদ্য পাবার আশায় নদী, জলাশয়, সমুদ্র, হ্রদ প্রভৃতি তীরবর্তী অঞ্চলে সমতল খোলা জায়গায় দলবদ্ধভাবে বসবাস করতো। এসব জায়গায় তারা। পূর্ব প্রস্তর যুগের তুলনায় শক্ত ঘরবাড়ি তৈরি করত। এজন্য তারা প্রধানত গাছের ডাল ও বাকল দ্বারা ছাদ তৈরিতে ছন ব্যবহার করতো। এসব ঘর-বাড়িতে জীবজন্তুর আক্রমণ প্রতিহতো করতে কুকুরগুলো ছিল প্রহরী স্বরূপ।


৬. হাতিয়ার : মধ্য প্রস্তর যুগে পাথরের নতুন ও সূক্ষ্ম হাতিয়ার তৈরি করা হয়। এ যুগে হাতিয়ার হিসেবে বল্লম, বর্ণা, হাত কুড়ালি, চাঁচই, ম্যাটক, কোদাল ব্যবহার করা হতো। এ সময়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো তীর ও ধনুকের ব্যবহার। এ সময়ে শিকারি হাত দিয়ে তীর বা বর্শা নিক্ষেপ না করে ধনুক ব্যবহার করে শিকার বধ করতো। এছাড়া হাতিয়ার হিসেবে ছোট ছোট ফল ও ছিল। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটির সাথে হাড় বা কাঠের হাতল বা বাট লাগিয়ে চাকু, করাত, কাস্তে, বর্শা, শীর্ষ হিসেবে ব্যবহার করতো।


৭. শিল্পকলা : মধ্য প্রস্তর যুগের শিল্পকলা প্রস্তর যুগ থেকে কিছুটা পরিবর্তিত রূপ লাভ করেছিল। তাদের নকশা সীমাবদ্ধ ছিল কতিপয় রেখার মধ্যে। এ যুগে তাদের চিত্রের প্রধান উপজিব্য ছিল তাদের নির্মিত দ্রব্য সামগ্রীও হাতিয়ারের মধ্যে। মৎস্য শিকারের হাতিয়ারও হরিণের শিং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে তাদের অঙ্কন রীতি ছিল একেবারেই ভিন্ন। অনেকটা জ্যামিতির নকশার ঢঙ্গে ত্রিকোণ, চতুর্ভুজ, বৃত্তাকার আকারে আঁকা। মধ্যে প্রস্তর যুগে কিছু গুহা চিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। তাছাড়া তারা হাড় ও শিং দিয়ে বিভিন্ন ধরনের অলংকার তৈরি করতে পারত। এছাড়াও ঝিনুক ও জন্তুর দাঁত ব্যবহার করে তারা আকর্ষণীয় অলংকার তৈরি করতে পারত।


৮. আগুনের ব্যবহার : পুরনো প্রস্তর যুগের মহান আবিষ্কার হলো আগুনের আবিষ্কার। তবে কখন কোনো সময়ে আগুনের আবিষ্কার হয় তা বলা কঠিন। প্রস্তর যুগে আগুন আবিষ্কার হলেও তার ব্যবহার ছিল সীমাবদ্ধ। কারণ তারা বারংবার আগুন জ্বালাতে পারত না। তাই একবার আগুন ধরিয়ে তা আর স্বেচ্ছায় নেভাতো না, কিন্তু মধ্য প্রস্তর যুগে আগুনের সর্বোচ্চ ব্যবহার শুরু হয়। রান্না-বান্না থেকে সর্বক্ষেত্রে এর ব্যবহার বেড়ে যায়। এ সময় আগুন জ্বালানোর খুব বেশি কষ্টসাধ্য ছিল না। নুড়ি চকমকে পাথর ও কাঠ টুকরা, কয়লা আগুন জ্বালাতে ব্যবহার করা হতো।


৯. সমাজের উৎপত্তি : প্রস্তর যুগে মানুষ ছিল যাযাবর, তাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। তবে বাঁচার তাগিদে ও শিকারের প্রয়োজনে তারা দলবদ্ধভাবে বসবাস করতো। তারা শিকারের জন্য যে সংগঠন গড়ে তোলে তা ক্ল্যান নামে পরিচিত। কয়েকটি ক্ল্যান মিলে তৈরি হতো ট্রাইব। কিন্তু তখন প্রস্তর যুগে সমাজের চিন্তা ছিল না। কিন্তু মধ্য প্রস্তর যুগে এসে মানুষের মধ্যে সমাজ গড়ে তোলার উপলব্ধি আসে। পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার জন্যই মধ্য প্রস্তর যুগে সমাজ গড়ে ওঠে।


১০. ধর্ম বিশ্বাস : মধ্য প্রস্তর যুগে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসে উন্নতি হয়। তারা অদৃশ্য ও অলৌকিক এবং যাদু বিশ্বাসের সাথে সাথে দেব-দেবতার প্রতি বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। প্রকৃতির নানা বিষয়কে তারা দেব-দেবতা হিসেবে মানতে শুরু করে। এ সময় তাদের প্রধান দেবতা ছিল সূর্য। যেকোনো কাজ শুরুর পূর্বে তারা সূর্যের দিকে তীর ছুড়ে কাজ শুরু করতো। তবে তাদের মধ্যে যে ধর্মের কু-সংস্কার ছিল তা নিঃসন্দেহে।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পুরানো প্রস্তর যুগ থেকে মধ্যে প্রস্তর যুগগুলো উন্নতি লাভ করলেও তা অনেকটা প্রস্তর যুগের আদলেই বিরাজমান ছিল। এ যুগে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের সহজ জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। আগুনের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। পশুশিকারের জন্যও আগুন ব্যবহার করা হতো। খাদ্যের জন্য তারা পশু পালন ও ক্ষুদ্র পর্যায়ে উচ্ছিষ্টাংশ বীজ থেকে খাদ্য পেত। মূলত এ যুগ থেকে উৎপাদনের দিকে সভ্যতা এগিয়ে যায়।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!