প্রাচীন চীনের দার্শনিক মতবাদ ও দর্শন সম্পর্কে বিবরণ দাও ।

admin


ভূমিকা : চীন পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার অন্যতম পাদপীঠ। তার প্রাচীন সংস্কৃতির অফুরম্ভ ও ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী অনাবিষ্কৃত রয়েছে ৪০০০ বছরের লিখিত ইতিহাসের ধারা রয়েছে। চীনা সভ্যতায় প্রথমে শাং বংশ রাজত্ব করে । শাং বংশের পর চৌ বংশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। প্রাচীন চৌ বংশের দর্শন ও দার্শনিকদের বিবরণের ফলে চৈনিক সভ্যতা ব্যাপক প্রশংসনীয় ছিল।


প্রাচীন চীনের দার্শনিক মতবাদ ও দর্শন সম্পর্কে বিবরণ দাও ।


চীনের দার্শনিক ও দর্শনের বিবরণঃ

প্রাচীন চীনের চৌ বংশের দর্শনের আলোচনা করলে প্রথমে নাম আসে লাওসের। নিম্নে লাওসের প্রচারিত মতবাদ আলোচনা করা হলো-


তাওবাদ : 'তাও' এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পথ। তাওবাদের মূল বিষয় হচ্ছে জীবন পদ্ধতির জ্ঞানগত আতীন্দ্রিয়বাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ঈশ্বর স্রষ্টা নন তিনি মানুষের কৃতকর্মের বিচারক। এ থেকে চীনের চিন্তাবিধগণ ঈশ্বরের শান্তি থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করে।এ চিন্তার পথ ধরে চীনের দার্শনিক লাওসের আবির্ভাব হয়। লাওৎসের প্রচারিত মতবাদ তাওবাদ নামে খ্যাত। নিম্নে তার দর্শনসমূহ আলোচনা করা হলো-


১. নৈতিক দর্শন : লাওৎসের শিক্ষা ছিল পৃথিবীর ন্যায়নীতির সঙ্গে মানুষের ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা। তিনি প্রজ্ঞার দ্বারা একটি আদর্শ সমাজ গঠনের চিন্তা করেন। লাওসে বলেন, মানুষের উচিত প্রকৃতির আপন ধারায় একে অগ্রসর হতে দেয়া এবং মানুষ যদি প্রকৃতির আপন ধারায় চলতে পারে তবেই জীবনে সার্থকতা আসবে। লাওসে বলেন, "স্বার্থপরতা হচ্ছে মানুষের অসুখী হওয়ার প্রধান কারণ।” তিনি জীবন থেকে স্বার্থপরতা উচ্ছেদ করার শিক্ষা দেন।


২. শিক্ষা দর্শন : তাওবাদী লাওসের দর্শন ছিল “শিক্ষা মানুষকে চৌর্যবৃত্তিতে সাহায্য করে।” তারা ভাবে একজন সত্যিকারের পরিপূর্ণ মানুষ সে, যিনি মিতব্যয়ী ও নিরহংকারী। যে যত বেশি অন্যের জন্য ব্যয় করবে, সে ততো বেশি নিজের জন্য পাবে। লাওসের শিক্ষা ছিল বিশ্বজনীন শান্তিবাদ। তার উপদেশসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-


(১) বিশ্বজনীন শান্তিবাদ-প্রতিশোধ পরায়ণ না হওয়া।

(২) প্রেমের মাধ্যমে মানুষে প্রীতি স্থাপন করা।

(৩) সাম্যবাদ-যার অধিক আছে তার কাছ থেকে যার নেই তাকে দেয়াই স্বর্গীয় নীতি ।


৩. রাষ্ট্র দর্শন : লাওৎসের তাওবাদী মতবাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাষ্ট্র দর্শনের শিক্ষা। তাঁর মতে রাজ্যে সরকারি হস্তক্ষেপ অনাচার বৃদ্ধি করে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তিনি বিশ্বাস করতেন সরকারি হস্তক্ষেপ অনাচার বৃদ্ধি করে। সমাজে বাধা-নিষেধ যতো গড়ে তোলো হয়, প্রজারা ততোই নিঃস্ব ও রিক্ত হয়। আইনের সংখ্যা বাড়লে চোর ডাকাতের সংখ্যাও বাড়ে । কারণ আইন বুদ্ধিমান ব্যক্তির দ্বারা সৃষ্টি হয় এবং আইনই অপরাধ সৃষ্টি করে। লাওৎসের মতে, শাসক শ্রেণি চারভাগে বিভক্ত-


(১) সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক যার অস্তিত্বটুকুই মানুষ পাবে।

(২) সুশাসক যিনি প্রজার শ্রদ্ধা অর্জনে সমান।

(৩) অত্যাচারিত শাসক যার ভয়ে প্রজারা কম্পিত।

(৪) নিন্দিত শাসক যাকে প্রজারা সর্বক্ষণ নিন্দা করে।


তাঁর মতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজতন্ত্র বহাল থাকবে। তবে তিনি বলেন, জ্ঞানী ও সদাশয় রাজা। সরকারের মূল নীতি হবে প্রজার কল্যাণ করা।


কনফুসিয়াসের দর্শন : চীনের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক কনফুসিয়াস। ৫৫১ খ্রিস্ট পূর্বান্ধে নু প্রদেশের চুফুনগরে তার জন্ম। কর্মজীবনে তিনি শস্যগোলার সহকারী পদে নিযুক্ত ছিলেন। উনসত্তর বছর বয়সে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং শাসন বিষয়ে নানান উপদেশ দান করেন।


কনফুসিয়াসের মতাদর্শ : নিম্নে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের বিভিন্ন দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-


১. শিক্ষা দর্শন : তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের জীবনে শান্তি ও সফলতার চাবিকাঠি হচ্ছে তার জ্ঞান এবং জ্ঞানার্জন করা যার নিরবচ্ছিন্ন সাধনা দ্বারা। তাঁর মতে, “যে সত্য সন্ধানী শিক্ষার্থী মলিন যখন পরিধান কিংবা মন্দ আহার গ্রহণে লজ্জাবোধ করে তার জন্য শিক্ষা অপ্রয়োজনীয়। কনফুসিয়াসের শিক্ষায়তনের শিক্ষার বিষয় ছিল তিনটি ইতিহাস, পদ্য ও ব্যবহারিক সৌজন্য বা শালীনতার নিয়মাবলি।


২. নৈতিক দর্শন : কনফুসিয়াসের দর্শনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজকেন্দ্রিক সুখী সমৃদ্ধ জীবনব্যবস্থা। নৈতিক দিক থেকে কনফুসিয়াস মানুষে মানুষে সহানুভূতি এবং আদান-প্রদানের ওপর আস্থাশীল ছিলেন। তাঁর চিন্তাধারা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তৎকালীন সমাজ ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের রাজনীতি ও নৈতিক দিক আলোকপাত করে। তিনি বলেছেন, "আমি নতুন কিছু সৃষ্টি করেনি, প্রাচীন জ্ঞানকে প্রসারিত করেছি মাত্র।" তার নীতিতে স্বর্গীয় আদর্শ বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছেন।


৩. রাষ্ট্র দর্শন : কনফুসিয়াসের মতে, রাষ্ট্র একটি প্রাকৃতিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মানুষ একে পরিবর্তন করতে পারে। রাষ্ট্র মানুষের জন্য, কিন্তু মানুষ রাষ্ট্রের জন্য নয়। তাঁর মতে, “রাজাকে আদর্শ গুণাবলির অধিকারী হতে হবে এবং রাজা প্রতিভাবান পণ্ডিতদের মধ্য থেকে যোগ্যতম প্রার্থীদের নিয়োগের মাধ্যমে শাসন কাজ পরিচালনা করবে। শাসনকর্তা শুধু আদেশই দিবেন না বরং চরিত্র গঠনে জনগণের আদর্শ হবেন। রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য জনগণের অবস্থার উন্নতি করা। কনফুসিয়াস কেন্দ্রীয় শক্তিতে সামন্তবাদের প্রত্যাবর্তনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন, তবে তা অবশ্যই বুদ্ধিবৃত্তির যাচাই সাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে।


৩. ধর্মীয় দর্শন : ধর্ম সম্পর্কে কনফুসিয়াস বিশেষ চিন্তা না করলেও তিনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিতে সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বলেন “পূর্ব পুরুষের প্রতি যেমন সকলের কর্তব্য আছে তেমনি জগদ্বীশ্বরের প্রতি রাজার কর্তব্য আছে। পরজীবন সম্পর্কে তিনি বলেন, “যতো দিন পর্যন্ত আমরা জীবন সম্পর্কে না জানব ততদিন পর্যন্ত কেমন করে মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পরব।”


দার্শনিক মেনসিয়াস : চৌ যুগের অন্য একজন দার্শনিক হলো মেনসিয়াস। তার দর্শন ছিল মূলত রাজনৈতিক। তিনি বলতেন রাষ্ট্র তৈরি হচ্ছে মানুষের মঙ্গলের জন্য। মানুষকে কর প্রভৃতি নির্যাতন করার জন্য নয়। তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্রকে জনকল্যানমুখী করতে হবে। তার মতে, মানুষকে বিভিন্ন করভারে জর্জরিত করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সময়ের বিবর্তনে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে উঠে। চীন সভ্যতা তার মধ্যে অন্যতম। চীনের দর্শন ও দার্শনিকদের আবির্ভাবের ফলে চৈনিক সভ্যতা আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!