হাম্বুরাবি আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ কর।

admin


ভূমিকা : টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী স্থান মেসোপটেমিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে উঁচু সমতল ভূমিতে ব্যাবিলনীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার চরম উৎকর্ষ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে ১৫০০ অব্দ। হাম্বুরাবি ছিলেন এ সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। আইনের ক্ষেত্রে তার অবদান স্মরণীয়।


হাম্বুরাবি আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ কর।


হাম্বুরাবি আইন : হাম্বুরাবির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে স্থানীয় রীতিনীতি ও আইন কানুনের পরিবর্তে সর্বজন। স্বীকৃত বিধিবদ্ধ আইন সংকলন ও প্রণয়ন। প্রায় ৪০০ বছর আগে হাম্বুরাবি নাম্মু সুমেরীয় রাজা লিবিট ইশতার একটি আইন সংকলন করেন। তিনি ব্যাবিলনের অলিখিত আইনের সংকলন ছাড়াও অনেক নতুন আইন সংযোজন করেন । তবে তিনি কোনো নতুন আইন তৈরি করেননি। আইন সংগ্রহ করে সেগুলোকে সংকলন এবং এর ভিত্তিতে বিচার সম্পন্ন করা ছিল তাঁর কৃতিত্ব।


হাম্বুরাবি আইনের বৈশিষ্ট্য : ২৮২টি আইন নানান ব্যবসা-বাণিজ্য, বিবাহ, পরিবার, সম্পত্তি, বৃত্তিধারী লোকদের পারিশ্রমিক এবং দায়িত্ব, ভাড়ার হার, দাস, এবং ক্রয় ও বিক্রয়সহ যাবতীয় দিক সন্নিবেশ করা হয়েছে। নিম্নে হাম্বুরাবির আইনের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো-


১. মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা মামলা : মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা সাক্ষীকে বড় অপরাধ হিসেবে মনে করা হতো। কোনো ব্যক্তি কারো বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনলে এবং তা প্রমাণ করতে না পারলে তবে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হবে। আর মিথ্যা সাক্ষ্য দানকারীর শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।


২· নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার : নারী জাতির মর্যাদা বৃদ্ধিতে হাম্বুরাবি কয়েকটি পদক্ষেপ নিলেও যদি সে স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা অভিযোগ করতো এবং তা প্রমাণ করতে না পারত তবে স্ত্রীকে পানিতে ডুবিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। তাছাড়া যদি কোনো ব্যক্তি মহিলাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতো তবে সে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারতেন।


৩. ঋণ ও সুদ সংক্রান্ত আইন : ঋণ ও সুদের আইন সরকারিভাবে নির্ধারিত ছিল। ঋণী ব্যক্তি তার ঋণ বস্তু বা দ্রব্য পরিশোধ করতে পারত এবং সে ঋণদাতার অধীনে ঋণ শোধ করতে পারত। এ রকম একজন ঋণী ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলে সে তার স্ত্রী, সন্তান এবং দাসকে ঋণশোধের জন্য ঠিক করে যেতে পারত।


৪. পারিবারিক ও বিবাহ আইন : হাম্বুরাবি আইনে পারিবারিক নিয়ম-কানুন বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। বিয়ে চুক্তির মাধ্যমে সম্পাদিত হতো। ছেলে-মেয়ের বিয়ে স্থির করার দায়িত্ব ছিল পিতা-মাতার। পুরুষের ক্ষেত্রে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ও সন্তানদের দ্বায়ভার স্বামীকে নিতে হবে। মেয়েরা বাবা বা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতো। আইনের ১২৯ নং ধারায় বলা হয়েছে, কারো স্ত্রী যদি অন্য পুরুষের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তবে সেই পুরুষ ও স্ত্রী উভয়কে পানিতে ডুবিয়ে মারা হবে। এভাবে হাম্বুরাবি পারিবারিক জীবনকে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেছেন।


৫. দায়িত্বে অবহেলার শাস্তি : হাম্বুরাবি আইনে ২৬, ২৮, ৩৭, ৪২ ধারায় দায়িত্বে অবহেলার শাস্তির উল্লেখ আছে। কোনো সৈন্য, কর আদায়কারী, দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার কর্মে অনুপস্থিত থাকেন, কিংবা তার বদলে কোনো বিকল্প লোককে তার পদে নিযুক্ত করেন তবে সেই কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড হবে।


৬. বাণিজ্য আইন : বাণিজ্য, ব্যাংকিং ও শিল্প তিনটি খাত পরিপূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল। লিখিত চুক্তি ছাড়া কোনো প্রকার ব্যবসায়িক আদান-প্রদানের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। যৌথ কারবার, ঋণ, বিক্রি গুদামজাত করণ সম্পর্কে আইন ছিল। আইন সংহিতায় ১০৪-১১৮ ধারায় বাণিজ্য আইন বর্ণিত ছিল।


৭. দত্তক আইন : বাণিজ্যিক কারণে দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে শিল্পী বা কারিগররা তাদের পেশা শিক্ষা দানের জন্য শিশুদের দত্তক নিত। দত্তক পুত্র সাবালক হলে তার নিজের পিতা বা মাতা ফেরত নিতে পারত না। দত্তক পুত্র পালিত পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো।


৮. সম্পত্তি আত্মসাৎ, সুধ সংক্রান্ত আইন : সম্পত্তি আত্মসাৎ, জমি সংক্রান্ত মিথ্যা সাক্ষী, সম্পদ লুট প্রভৃতি হাম্বুরাবীর আইনের ৯-১১, ২২-২৪ ধারায় উল্লেখ আছে। অসাবধানে চুরি করা অথবা সম্পত্তির উপর বিক্রেতার স্বত্ব নেই এমন সম্পত্তি ক্রয় করলে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল। যদি কোনো ডাকাত ডাকাতি করার সময় ধরা পড়ে তবে তার মৃত্যুদণ্ড হবে। কোনো আগুন লাগা জায়গায় কেউ লুট করলে অপরাধীকে আগুনে ফেলে দেয়া হতো ।


৯. শ্রেণি বিভক্ত আইন : হাম্বুরাবি আইনে শ্রেণি বিভক্ত সমাজব্যবস্থা, বিভিন্ন শ্রেণির সুযোগ-সুবিধা এবং ভিন্ন ভিন্ন শান্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। রাজা একক মাত্র একশ্রেণি, অন্যসব প্রজা আর এক শ্রেণি অভিজাত ও ধনীদের ক্ষেত্রে অন্য ধরনের আইন প্রচলিত ছিল। বিচারের ক্ষেত্রে নিচু শ্রেণির জন্য আইন ছিল ভিন্ন। কোনো অভিজাত, কোনো গরিব ব্যক্তির চোখ ক্ষতি করলে সেক্ষেত্রে চোখের বদলে চোখ নষ্ট না করে অর্থের বিনিময়ে অভিজাতদের শান্তি থেকে মুক্তি দেয়া হতো।


১০. ভূমি আইন : কৃষি ব্যাবিলনের প্রধান জীবিকা হওয়ায় কৃষিকার্যের নিয়ন্ত্রণে আইন করেন। ভূমিসম্পত্তি ক্রয়- বিক্রয় একটি যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পাদিত হতো। রাজা নিজস্ব জমি সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারী, কারিগর, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর লোকদের ভাগ দিতেন।


১১. শ্রম আইন : কোনো চাষী যদি জমি চাষের জন্য নিয়োগ করা হতো তবে উক্ত চাষী-প্রতি বছর আট জ্বর খাদ্যশস্য মজুরি হিসেবে পেত। চাষের জন্য কোনো গরু ভাড়া করা হলে গরুর মালিক প্রতিদিন ১২ শিলা খাদ্যশস্য ভাড়া হিসেবে পেত। প্রভৃতি ক্ষেত্রে হাম্বুরাবির শ্রমিকদের মজুরি সম্পর্কে বেশ সচেতন ছিলেন। শ্রমিদের মজুরি তাদের কাজ করার সাথে সাথে দেওয়ার উপরও তাগিদ দেন। তিনি মালিক যাতে শ্রমিকদের তাদের ন্যায় মজুরি হতে কম না দিতে পারে সেক্ষেত্রে সঠিক আইন প্রণয়ণ করেন।


১২. ইমারত আইন : ইমারতের ক্ষেত্রে নির্মাতার ফি এবং নির্মাণের কাজ অবহেলার শাস্তির বিধানও আইনে ছিল। কোনো নির্মাতা অভিজাত ব্যক্তির কোনো বাড়ি নির্মাণ করে দিত তবে প্রতি সের এর জন্য মজুরি পেত ২ মেকেল । যদি বাড়ির দেয়ালে ফাঁটল ধরত বা ধসে পড়তো তাহলে নির্মাতা নিজ খরচে তা মেরামত করে দিতে বাধ্য থাকত ।


১৩. সেচ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আইন : কৃষক, ভূস্বামী যাতে কৃষি উৎপাদনে মনোযোগী হয় তাই সেচ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কয়েকটি আইন প্রণয়ন করা হয়। কোনো লোক যদি পরিখা খনন, সেচ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অবহেলা করে এবং এর ফলে যদি পার্শ্ববর্তী কোনো জমির ক্ষয়ক্ষতি হয় তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির যাবতীয় ক্ষতিপূরণ সে দিতে বাধ্য থাকবে। রাজা হাম্বুরাবীর আইন কৃষি ক্ষেত্রে আরো বিধান করে ভালো ফলনে বিধান রেখেছে। এ জন্যে ব্যাবিলনীয়রা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আইনে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছিল।


৪. বিচারব্যবস্থা : ব্যাবিলনীয় আইন ছিল খুবই কঠোর, সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়াই ছিল আইনের প্রধান লক্ষ্য। ডাকাতি-চুরি, দাঙ্গা সৃষ্টি, সরকারি দায়িত্বে অবহেলা, অপহরণ, ধর্ষণ পলাতক দাস, মিথ্যা অভিযোগকারীর ফাঁসি হতো। কারণ হাম্বুরাবী মনে করতেন লঘু অপরাধই একজন অপরাধীর মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্ম দিতে পারে।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, হাম্বুরাবী আইনে মানুষের সঠিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি আইন প্রণয়নের বিধান জারি করেন। সমাজকে সুখী, সমৃদ্ধ, শান্তিকামী ও সুশৃঙ্খল হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে এই আইনে। তাই হাম্বুরাবী আইনে বিভিন্ন ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও তা তৎকালীন প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।







#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!