ভূমিকা :
ষোড়শ লুই-এর গৃহীত শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রাদেশিক পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক সভাগুলোতে ভয়ানক প্রতিবাদ দেখা দেয়। ফ্রান্সের ক্যাথলিক গির্জা তাতে যোগ দেয়। গির্জার বিশপরা পার্লামেন্টের ক্ষমতা শেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। গির্জার সম্পত্তির উপর কর স্থাপনের প্রচেষ্টায় নিন্দা করা হয়। বংশকৌলিন্যের অধিকারী। অভিজাতরা পার্লামেন্টের পক্ষে যোগ দেয়। কারণ এসব অভিজাতদের স্বার্থরক্ষার জন্যই প্যারিসের পার্লামেন্ট লড়াই কাছিল। প্রাদেশিক অভিজাতরা পার্লামেন্টের ক্ষমতা হরণের প্রতিবাদে দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু করে। দ্যাফিনে, দুজো, তুলো প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৭৭৮ খ্রিষ্টব্দে ২২ জুলাই অভিজাত, উচ্চ যাজক ও বুর্জোয়া প্রতিনিধিরা ভিত্তি নামক স্থানে সভায় মিলিত হয়ে জাতীয় সভা বা স্টেটস জেনারেল আহ্বানের দাবি জানায়।
ষোড়শ লুই :
শেষে বলা যায়, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার যোগ্যতা না থাকায় ষোড়শ লুই তার পতন ডেকে আনেন। বার বার তাকে সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও তিনি সদ্ব্যবহার করতে পারেন নি। তার চরিত্রে দুর্বল নিকের আধিক্য থাকায় তিনি সফল হতে পারেননি। ফরাসি বিপ্লবের মুখে তার ও রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। কোনো অদূরদর্শী স্বৈরাচারী শাসক যে বেশি দিন টিকতে পারে না তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো ফরাসি স্বৈরতন্ত্রের শেষ শাসক ষোড়শ লুই।
স্টেটস জেনারেল :
অভিজাতদের চাপে ও অর্থসংকট মোচনের জন্য ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেল নামক জাতীয় সভার অধিবেশন আহ্বান করেন এবং ১৭৮৯ খ্রিষ্টব্দে ৫ মে এ অধিবেশন শুরু হয়। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে জাতীয় সভার আহ্বান এক স্মরণীয় ঘটনা। এদিন থেকেই ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয় বলা যায়। এ অধিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণি রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে প্রকাশ্যে আবির্ভূত হয়। বুর্জোয়াদের শ্রেণিগত চেতনা ও অভিজাতদের বিশেষ হে সুযোগ সুবিধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম সাধারণভাবে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিপ্লব নামে অভিহিত। ১৭৫ বছর পর পুনরায় স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করা হয়। স্টেটস জেনারেল আহূত হলে ফরাসি মধ্যবিত্ত শ্রেণি তথা সাধারণ মানুষের মনে এক অভূতপূর্ব আশা-আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার হয়। অর্থসংকট মোচনের জন্য নতুন কর ধার্য করতে হলে স্টেটস জেনারেলের সম্মতি যে প্রয়োজন এ ধারণা স্টেটস জেনারেলের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। কিন্তু স্টেটস জেনারেলের কার্যাদি পরিচালনা করা তত সহজ ছিল না। প্রথমত, দীর্ঘকাল পরে এর অধিবেশন আহৃত হওয়ার "কার্যপ্রণালি” সম্বন্ধে সে সময় অনেকেরই কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। দ্বিতীয়ত, ইতিমধ্যে এ জাতীয় সভার প্রতিনিধিদের মধ্যে শ্রেণিগত সংঘাতের রূপ পরিবর্তিত হয়েছিল
ফরাসি বিপ্লবে স্টেটস জেনারেলের ভূমিকা :
পুরাতন বিধি অনুসারে স্টেটস জেনারেল সমাজের অভিজাত, যাজক ও জনসাধারণ-এ তিন শ্রেণির নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে নিয়ে গঠিত ছিল। এ তিন শ্রেণির মধ্যে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। এছাড়া এ শ্রেণি ছিল নব্য ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ। বিদ্যাবুদ্ধি ও আর্থিক সচ্ছলতা সকল দিক থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি অভিজাতদের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত হলেও সামাজিক মানমর্যাদা ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি মধ্যবিত্তদের ছিল না। এটাই ছিল অভিজাতদের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্তদের প্রধান ক্ষোভের কারণ। সুতরাং স্টেটস জেনারেল আবৃত হলে মধ্যবিত্তরা তাদের ক্ষোভ মিটানোর সুবর্ণ সুযোগ পায়। স্টেটস জেনারেলে প্রত্যেক শ্রেণির সমষ্টিগতভাবে এক একটি ভোট দানের অধিকার ছিল। প্রথম দুই সম্প্রদায় যাজক ও অভিজাত অপেক্ষা তৃতীয় শ্রেণির সদস্য সংখ্যা বেশি থাকা সত্ত্বেও তাদের কোনো সুযোগ সুবিধা ছিল না। কারণ স্বার্থের খাতিরে প্রথম দুই শ্রেণি সবসময় তৃতীয় শ্রেণির বিপক্ষে থাকত। স্টেটস জেনারেলের অধিবেশনের প্রারম্ভেই প্রথম দুই শ্রেণির সাথে তৃতীয় শ্রেণির বিবাদ শুরু হয় এবং বিবাদের কারণ হলো ভোট গণনার প্রশ্ন নিয়ে। স্টেটস জেনারেলের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ১২১৪। এর মধ্যে যাজকদের সংখ্যা ছিল ৩০৮, অভিজাতদের ২৮৫ ও তৃতীয় শ্রেণির সংখ্যা ছিল ৬২১। তৃতীয় শ্রেণির সদস্যদের মধ্যে ৩৬০ জন ছিলেন আইনজীবী, কিছু সংখ্যক লেখক, ব্যবসায়ী, ব্যাংক মালিক ও কিছু সংখ্যক সমৃদ্ধ কৃষক। প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় শ্রেণিতে মধ্যবিত্তরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এ কারণেই তাদের প্রাধান্য ছিল।
প্যাট্রিয়ট দল ও তাদের কর্মসূচি : স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন শুরু হলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিগণ জাতীয় অথবা প্যাট্রিয়ট দল গঠন করে। এ দলে কিছু উদারপন্থি অভিজাত ছিলেন। এ দলের কর্মসূচি ছিল নাগরিক, বিচার বিভাগীয় ও রাজস্ব সংক্রান্ত ক্ষমতা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সম্মত সরকার। এ প্যাট্রিয়ট দল তথা মধ্যবিত্তদের প্রধান লক্ষ্য ছিল অভিজাতদের বিশেষ সুযোগ সুবিধাগুলো নস্যাৎ করে তাদের সাথে সমান মানসম্মান ও অধিকার অর্জন করা। মধ্যবিত্ত তৃতীয় শ্রেণি দাবি করে যে, ভোট গণনা শ্রেণি হিসাবে না করে সংখ্যা হিসাবে করতে হবে। অভিজাতদের মধ্যে উদারপন্থি ও নিম্ন যাজকগণ তৃতীয় শ্রেণির প্রস্তাব সমর্থন করে। এ সাংবিধানিক সংকট সমাধানে ষোড়শ লুই ব্যর্থ হলে তৃতীয় সম্প্রদায় ভুক্ত প্রতিনিধিগণ ও কিছু প্যারসীয় যাজক নিজেদের ফ্রান্সের “জাতীয় পরিষদ" বলে ঘোষণা করে এবং ধার্য কর অধিকার নিজেদের হাতে তুলে নেয়।
স্টেটস জেনারেলের আহ্বানের সমীচীনতা : প্রকৃতপক্ষে ষোড়শ লুই জাতীয় সভার আহ্বান করে স্বেরাচারী বুরবো রাজতন্ত্রের পতন অনিবার্য করে তোলেন। কারণ জাতীয় সভার অধিবেশনকে উপলক্ষ্য করেই ফরাসি বিপ্লব সর্বাত্মক রূপ পরিগ্রহ করে। অবশ্য সেই সঙ্গে এও স্বীকার করতে হয় যে, পরিস্থিতির চাপে পড়েই ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য হন। এ কথা অনস্বীকার্য যে ষোড়শ লুই ছিলেন সদাশয় ও মহানুভব ব্যক্তি। কিন্তু তার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও দূরদৃষ্টির যথেষ্ট অভাব ছিল। এটা সত্য যে, ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য তাকেই একমাত্র দাবি করা যায় না। চতুর্দশ লুই-এর শাসন হতেই এ সংকট উত্তরোত্তর ঘনীভূত হয়ে উঠছিল এবং এক বিশাল পরিমাণ আর্থিক দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই ষোড়শ লুই সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার আমলেই ফরাসি রাজকোষ প্রায় নিঃশেষিত হয়ে যায়। অর্থনৈতিক সংস্কারের আশু প্রয়োজন তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু অভিজাত শ্রেণির প্রবল বিরোধিতার সম্মুখে তিনি অসহায় প্রতিপন্ন হন। সুতরাং আর্থিক বিপর্যয়ে নিরুপায় হয়ে তিনি স্টেটস জেনারেল আহ্বান করতে বাধ্য হন।
কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ভাঙন, বিচার বিভাগের দুর্নীতি, অভিজাত শ্রেণির স্বার্থপরতা প্রভৃতি ষোড়শ লুইকে হতাশ করে। এ সময় ফরাসি দার্শনিকদের প্রচার ফরাসি জনগণের মধ্যে এক অভূতপূর্ব উদ্দীপনা সঞ্চার করে। ইংল্যান্ডের গৌরবম বিপ্লব ও আমেরিকায় স্বাধীনতার আদর্শ ফরাসি জনগণের সম্মুখে বিপ্লবের আদর্শ স্থাপন করে। ঐতিহাসিক কাব্বান এর মতে "The calling of the states General was undoubtedly the critical steps for it meant the abdication of absolute monarchy " অর্থাৎ স্টেটস জেনারেলের আহ্বান স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের পক্ষে এক চূড়ান্ত পরাজয় ।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, স্টেটস জেনারেলের প্রতিনিধিদের কোনোরূপ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু ষোড়শ লুই এ সুযোগ গ্রহণ করে জাতিকে কোনো রূপ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন। গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের আদর্শ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। যদিও জনগণের অভাব অভিযোগ দূর করার তিনি পক্ষপাতী ছিলেন। তথাপি প্রতিনিধি সভার সাথে সম্ভাব রক্ষা করে দেশের সমস্যা সমাধান করার ব্যাপারে তার অক্ষমতা প্রমাণিত হয়।