মধ্যযুগের সামন্ত প্রথার বৈশিষ্ট্য বিস্তারিত আলোচনা কর।

admin


ভূমিকা : সামন্ততন্ত্রের মূল ভিত্তি ছিল ভূমি। কিন্তু এ জমির নিয়ন্ত্রক ছিল অল্প সংখ্যক লর্ড বা বৃহৎ ভূস্বামী । আর তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল গোটা সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। তাই মধ্যযুগে সামন্ত তন্ত্র ইউরোপের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। ধারণা করা হয় সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয় পাঁচ শতকে। এবং এটি প্রায় আঠারো শতকে সমাপ্তি ঘটে। বিশেষ করে নবম শতক থেকে এর বিস্তৃতি চোখে পড়ার মত। যা ইউরোপে ১০০০ বছর ব্যাপি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাই সামস্ত প্রথার বৈশিষ্ট্য আলোচনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।


মধ্যযুগের সামন্ত প্রথার বৈশিষ্ট্য বিস্তারিত আলোচনা কর।


ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য : সামন্ততন্ত্র ছিল ইউরোপের ভূমি কেন্দ্রিক অর্থ ও শাসন ব্যবস্থা। নিম্নে মধ্যযুগের ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো -


১. শ্রেণিবিভক্ত সমাজ : সামন্ত প্রথার প্রধান ও উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের শ্রেণি বিভাজন। সাধারণত যিনি অধিক জমির মালিক তিনি ছিলেন লর্ড বা ভূস্বামী। আর যারা জমি চাষ করতেন তারা হলো ভেসেল আর লর্ড বা ভূস্বামী এবং ভেসেলের সম্পর্কের ভিত্তিতে যে প্রথা তাই সামস্ত প্রথা। এর মধ্যে যিনি লর্ড তিনি সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিল। অন্যরা ছিল তার অধিনস্ত ভূমিদাস। যাদের তিনি জমি উচ্ছেদ ও নিয়োগ দিতে পারতেন। অর্থাৎ ভেসেল ছিল লর্ডদের কুক্ষিগত গোলাম বা দাস।


২. যাজক সমাজের উদ্ভব : সামন্ত সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যাজক সম্প্রদায়ের উদ্ভব। যাজকদের সম্মান ছিল। রাজার পরেই। যাজক ছিল মূলত রাজার পরামশর্ক ও গির্জা ও গির্জা অধিনস্ত সম্পতিগুলো রক্ষনাবেক্ষণ করা। এরা সামন্ত সমাজে খুবই প্রভাবশালী ছিল। রাজা এবং যাজকদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অটুট। রাজা সমাজে যেকোন বিষয়ে যাজক কর্তৃক ভাষণের ব্যবস্থা করতেন। যেহেতু যাজক ছিল ধর্মীয় নেতা তাই সাধারণ মানুষ ও ভূস্বামী অধিনস্ত কৃষক সহজেই মেনে নিত।


৩. অভিজাত শ্রেণি: সামন্ততান্ত্রিক সমাজে সামন্ত প্রভুরাই ছিলেন অভিজাত শ্রেণি। আর এ শ্রেণি ছিল বংশগত রাজা থেকে শুরু করে তা নাইট পর্যন্ত বিস্তৃত সকল সামন্ত প্রভুই ছিল বিশেষ শ্রেণিভুক্ত। এরাই ছিল শাসক শ্রেণি তবে তারা মূলতঃ ছিল শোষক। অভিজাত শ্রেণিও তাদের পোষ্যবর্গ সব মিলিয়ে তারা ছিল একদশমাংশ। অথচ এরাই ছিল একচেটিয়াভাবে সুবিধা ভোগী ।


৪. তৃতীয় শ্রেণি: সামন্ত সমাজে তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল কৃষক, শ্রমিক, বণিক এবং ভূমিদাসগণ। একমাত্র সামন্ত প্রভুরাই দাস রাখতে পারত। বণিকগণ গিল্ডের অধীনে ব্যবসা করত এবং কৃষক ছিল বিত্তহীন, সামন্ত প্রভুর জমিতে এরা চাষাবাদ করত। ভূমিহীন এ সমস্ত কৃষককে সামন্ত সমাজে বলা হতো সার্ফ বা ভিলেইন। ভূমি হস্তান্তরের সাথে সাথে নতুন মালিকের নিকট এরাও হস্তান্তরিত হতো। এমনকি সামন্ত প্রভুর অনুমতি ব্যতীত এরা কোনো স্থান ত্যাগ

করতে পারত না।


৫. ব্যক্তিগত সরকার : সামস্ত প্রথার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিগত সরকার বা ক্ষমতার পৃথকীকরণ। সামন্ত প্রথা চালু হবার পূর্বে রাজার হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল রাজার হাতে। কিন্তু সালমেনের মৃত্যুর পর দুর্বল রাজাগণ তাদের সংগঠিত সেনাবাহিনীর অভাবে লোম্বার্ড, ডেন্ডাল, নর্থমেন প্রভৃতি বর্বর বহিঃশত্রুর আক্রমণ হতে রাজ্য ও জনসাধারণের নিরাপত্তা দান করতে ব্যর্থ হলে সাধারণ জনগণ নিরাপত্তার জন্য ভূস্বামী শক্তিশালী সামন্ত প্রভুর নিকট নিজেকে সমর্পণ করে। এতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত সরকার বিকাশ লাভ করে। এর ক্ষমতার বিস্তৃতি ছিল যার জমি ও অধিনস্ত কৃষকের সংখ্যার ভিত্তিতে।


৬. লর্ডদের অবস্থান : রাজা শর্ত সাপেক্ষে লর্ডদের নিকট জমি দান করতেন। লর্ডদের নিকট রাজা রাজস্ব, সৈন্য লোকবল দিতে সামন্ত ও রাজ্যের নিরাপত্তা আশা করতেন। রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলে লর্ডরা রাজাকে শক্তি, অর্থ বাধ্য ছিলো। এছাড়াও এলাকাভিত্তিক লর্ডদের থেকে রাজা পরামর্শ গ্রহণ করতেন। উল্লেখ্য রাজা কর্তৃক তার অধীনস্ত ভূস্বামীদের মধ্যে জমি বিতরণ চলত কয়েকটি স্তরে। ফলে লর্ডরা যেহেতু সরাসরি রাজা থেকে জমি পেতেন ফলে তারা অধিক পরিমাণে রাজার আজ্ঞাবহ ছিলেন।


৭. জমি অধিগ্রহণ বা বণ্টন : সামন্ত সমাজে রাজা কর্তৃক বিভিন্ন স্তরে একাধিক হাত বদল হয়ে জমি অধিগ্রহণ হতো। রাজা প্রথমে জমি গুলো বিতরণ করতেন লর্ডদের নিকট। এছাড়াও রাজা প্রথম পর্যায়ে দান করতেন ডিউক, কাউন্ট, অলি প্রভৃতি বড় বড় উপাধিকারী সামন্ত প্রভুর মধ্যে। এদেরকে বলা হতো টেনান্ট ইন চিফ বা প্রধান ভূমি স্বত্ত্বাধিকারী। এ বৃহৎ ভূস্বামী তাদের অধিকাংশ ভূমি বিতরণ করতেন, ব্যারণ ও ভাইকাউন্ট উপাধিকারীদের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে যে ভূস্বামী জমি পেতেন তাকে বলা হতো নাইট। নাইটদের আর জমি বিতরণের অধিকার ছিল না। এ সমস্ত নাইটদের বলা হতো ভেসেল। যারা সরাসরি জমি চাষ করতেন। তবে সামন্ত প্রথায় কেউ রাজাকে জমি দান করতেন না। ফলে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে।


৮. পারস্পরিক দায়-দায়িত্ব : সামন্ত তান্ত্রিক ভূমি ব্যবহার ভূমির মালিকগণ বা লর্ড এবং সামন্তদের পারস্পরিক কিছু দায় দায়িত্ব পালন করতে হতো। অর্থাৎ এ ব্যবস্থায় লর্ড এর উপর ভেসেলদের যেমন দায়িত্ব পালন করতে হতো, ঠিক তেমনি ভাবে সার্ফ বা ভ্যাসেলদের উপর লর্ড এরও দায়িত্ব কর্তব্য ছিলো। তাছাড়াও সামরিক শক্তি দান, পরামর্শকর প্রদানসহ রাজার প্রতিও সামন্ত প্রভুদের কিছু দায়-দায়িত্ব ছিলো। এতে ক্ষুদ্র কৃষক থেকে শুরু করে রাজা পর্যন্ত একটা সম্পর্ক বজায় ছিল


৯. ব্যক্তিগত অধীনতা : সামন্ত সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিগত অধীনতা। রাজ্যের সমস্ত জমির মালিক ছিল রাজা। তিনি লর্ডদের মধ্যে জমি বিতরণ করতেন। লর্ড থেকে আনুগত্য ও নির্দিষ্ট কর্তব্য পালনে অঙ্গীকার করে জমি পেতেন ভ্যাসালরা এবং ভ্যাসালদের কাছ থেকে কৃষকরা জমি পেত। এভাবে জমি ক্রমাগত খন্ডিত হতো এবং তার মালিকও হস্তান্তরিত হতো। ফলে জমি আস্তে আস্তে ব্যক্তিগত অধীনতায় চলে যেত।


১০. লর্ডদের দায়িত্ব : লর্ড বা সামন্ত প্রভুগত কৃষকদেরকে জমি বিতরণ করতেন। তবে জমির উপর লর্ডের একছত্র আধিপত্য ছিল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে লর্ড তার অধীনস্ত সামন্ত বা ভ্যাসালদের নিরাপত্তা প্রদান করতেন এবং কোনো ভ্যাসেলের মৃত্যু হলে তার জমি ও সন্তান দেখাশোনা করতেন। এমনকি তার সন্তান যত দিন বড় না হয় তার লর্ড তার বৈধ অভিভাবক হতেন। যদি কোনো ভ্যাসাল তার উত্তরাধিকারী না রেখে মারা যেতেন তবে লর্ড তার জমির মালিক হতেন। আবার যদি কোনো ভ্যাসেল চুক্তি ভঙ্গ করতেন, পালনে ব্যর্থ হতেন, আনুগত্য প্রদর্শনে ব্যর্থ হতেন তবে লর্ড ভ্যাসালদের জমি বাজেয়াপ্রাপ্ত করে অনুরূপ শর্তে অন্যকে দান করতেন।


১১. ভ্যাসালের দায়িত্ব ও কর্তব্য : ভ্যাসাল বা সামন্ত প্রভূকে লর্ডকে বশ্যতা স্বীকার করতে হতো এবং যুদ্ধ বিগ্রহে ভ্যাসালগণ সর্বদা লর্ডকে সাহায্য প্রদান করতো। যুদ্ধকালীন সাহায্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সৈন্য দিয়ে দুর্গ প্রতিরক্ষা, প্রয়োজনে নিজে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ, পরামর্শ ও কর প্রদান । এছাড়া রাজা বন্দি হলে সর্বশক্তি দিয়ে তাকে উদ্ধার করতে হতো। এছাড়া তার বশ্যতা শিকার করতে হাটুগেড়ে সম্মান প্রদর্শন করতে হতো।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভূমি কেন্দ্রীক প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে বলা হতো সামন্ত প্রথা। সামন্ত প্রথাকে কেন্দ্র করে নানাবিধ ব্যক্তির বা শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। সামন্ত সমাজে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন রাজা। রাজা তার বিস্তর জমি বিতরণ করতেন লর্ডদের নিকট। লর্ডরা আবার তা বিতরণ করতেন ভ্যাসালদের নিকট, ভ্যাসল বিতরণ করতেন নাইটদের নিকট । আর নাইটদের তা বিতরণের অধিকার ছিল। তারাই ছিল মূলতঃ ভূমিদাস।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!