প্রটো ঐতিহাসিক যুগ সম্পর্কে পর্যালোচনা কর।

admin

ভূমিকা : মানব সভ্যতাকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মানব সমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ চিহ্নিত করার জন্য ঐতিহাসিকরা ইতিহাসের কাল বিভাজন করেছেন উপাদানের মাপকাঠিতে তারা ইতিহাসের কালকে তিনভাবে ভাগ করেছেন। যথা ১. ইতিহাস, ২. ইতিহাস ও ৩. প্রায় ইতিহাস বা প্রটো ইতিহাস। মানব ইতিহাসের যে যুগের কোনো লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় না তাই প্রাক-ইতিহাস। আর সভ্যতায় যে সময় থেকে শাসন কাঠামো শুরু হয় তাকে প্রটো ইতিহাস বলা যায়।


প্রটো ঐতিহাসিক যুগ সম্পর্কে পর্যালোচনা কর।


প্রটো ঐতিহাসিক যুগের বিশ্লেষণ :

নিম্নে প্রটো ঐতিহাসিক যুগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো -


১. রাজতন্ত্র স্থাপন : প্রাক ঋগ্বেদীয় যুগে আর্যদের বিভিন্ন গোষ্ঠির যুদ্ধের প্রয়োজনে শক্তিশালী ব্যক্তিকে রাজপদে বা যুদ্ধের নেতার পদে স্থাপন করার বহু কাহিনী প্রচলিত। ঋগ্বেদের কালে আর্যদের যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় তাতে একথা বলা যায় যে, রাজতন্ত্রই ছিল সে সময়কার প্রধান রাজনৈতিক ব্যবস্থা। ঋগ্বেদে রাজা, দলনেতা, রাজন শব্দটি পুনঃপুন উল্লেখ পাওয়া যায়।


২. সামরিক শক্তি অর্জন : বৈদিক যুগের প্রারম্ভে আর্য রাজাগণ প্রধানত সামরিক নেতা ছিলেন এবং তাদের রাজপদ লাভের প্রধান যুক্তি ছিল তাদের সামরিক শক্তি ও দক্ষতা। রাজার ছিল নিজ দলের অধীনে লোকসংখ্যার নিরাপত্তা বিধানের ক্ষমতা। ফলে এসব রাজা ও সেনা প্রধানরা রাজ্য শক্তি বৃদ্ধির জন্য সর্বদা অন্যান্য রাজার সাথে সর্বদা যুদ্ধে লিঙ থাকত। কারণ প্রত্যেকে ছিল সামরিক শক্তিতে বলীয়ান।


৩. শক্তিশালী রাজতন্ত্র : ঋগ্বেদে অনেক শক্তিশালী বড় বড় রাজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে উল্লেখ আছে যে, সেকালে বড় বড় প্রাসাদ ছিল। আর এতে বলা যায়, বিশাল প্রাসাদ বৃহৎ রাজার অস্তিত্ব যে ছিল তার প্রমাণ করেছিল। এছাড়া শক্তিশালী রাজতন্ত্র বা বৃহদাকার রাজ্য যে ছিল তার প্রমাণ রাজার সম্রাট উপাধি গ্রহণ সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য তার প্রমাণ দেয়।


৪. সেনানী : রাজা ছিলেন সর্বেসর্বা। তিনি ছিলেন সমাজের মধ্যে সবার ঊর্ধ্বে। তার নিচে ছিল সেনানীর স্থান। যুদ্ধকালে তিনি যুদ্ধের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন । তবে যুদ্ধ পরবর্তীতে তিনি রাজার আদেশে অন্য কাজ করতেন।


৫. পুরোহিত ও গ্রামণী : রাজার সমগ্র কর্মচারীর মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ছিল পুরোহিত। রাজার বিচারকার্যে পুরোহিত সাহায্য করতেন। রাষ্ট্রের পক্ষে বহু যাগযজ্ঞ ইত্যাদির জন্য রাজা নিরুপায় হয়ে অনেক স্বাধীন পুরোহিত নিয়োগ করতেন। এছাড়া গ্রামের সামরিক ও আধা-সামরিক কার্যকলাপের দায়িত্ব ছিল গ্রামণীর উপর। ফলে প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক দিকে দিয়ে গ্রামগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল।


৫. প্রশাসনিক বিভাগ : প্রশাসনিক বিভাগের দিক দিয়ে রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের মূলভিত্তি ছিল পরিবার। কয়েকটি পরিবার নিয়ে একটি গ্রাম গঠিত হতো। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে 'বিশ' গঠিত হতো। এর প্রধানকে বলা হতো বিশপতি। গণ শাসককে বলা হতো গণপতি। এছাড়াও ঋগ্বেদের আমলে সভা-সমিতিরও অস্তিত্ব পাওয়া যায়। শাসন কার্যের জন্য রাজা রাজস্ব আদায় করতেন। রাজা 'বেলি' শুল্ক ও চাঁদা তিন ধরনের রাজস্ব আদায় করতো।


৭. পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের : বৈদিক আর্যদের সমাজ ও পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারে পিতার অবস্থান ছিল সবার উর্ধ্বে। পিতার পরিবারের সন্তান-সন্ততি সহ সকলের উপর প্রাধান্য ছিল। পরিবারের মধ্যে কেউ অপরাধ করলে পিতা বিচার কার্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন।


৮. জাতিভিত্তিক সমাজ : পূর্বে ভারতবর্ষে জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল না। আর্যরা ভারতের ভূখণ্ডে প্রবেশ করলে ভারতে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব হয়। ফলে সমকালীন ধর্মীয় নেতারা মানুষের গুণ ও কার্যের কার্যানুসারে সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র চারটি শ্রেণিবিভাগ করেন এবং প্রতিটি বর্ণের জন্য আলাদা আলাদা কার্য নির্ধারণ ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় । এতে বলা হয় যে, গুণ ও বর্ণ অনুসারে যার যার কাজ যে পেশা সে শুধু তাই করবে।


৯. নারীর মর্যাদা : বৈদিক যুগে পুরুষের ন্যায় নারীর মর্যাদা ছিল। এ যুগে নারীরা পুরুষের ন্যায় বিদ্যাচর্চা করতো। এদের মধ্যে আপালা, ঘোষা, বিশ্বকোরা প্রমুখ নারীর নাম পাওয়া যায়। তারা বিদ্যাচর্চা, শাস্ত্রচর্চাসহ প্রয়োজনে পুরুষের সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতেন। এছাড়াও তারা পুরুষের ন্যায় স্বাধীন ছিল।


১০. কৃষি ও পশু পালন : বৈদিক যুগে মানুষের অর্থনীতির প্রধান মাধ্যম ছিল কৃষি। সে যুগে কৃষিব্যবস্থা অনেক উন্নত ছিল। কৃষি জমিতে তারা লাঙ্গল টেনে ফসল ফলাতো। যব, বার্লি ছিল তাদের প্রধান খাদ্যশস্য। কৃষিকাজ পরিচালনা করতে গিয়ে তারা পশু পালনের কৌশল আয়ত্ত করে। গরু, ছাগল, ঘোড়া ছিল তাদের প্রধান গৃহ পালিত পশু। একদা তারা গাভীর দুধ দহন করতে ও খেতে শেখে। তারা ষাড় দ্বারা গাড়ি টানার কাজ করত। তবে এর মধ্যে তারা পশু শিকারও করতো।


১১. শিল্প ব্যবহার : বৈদিক যুগে শিল্প বিকাশে লাভ হয়েছিল। তারা কৃষি কাজে বিভিন্ন হাতিয়ার তৈরি করাসহ নানা শিল্পকর্মে পারদর্শিতা অর্জন করে। এর মধ্যে মৃৎ শিল্প, বস্ত্র শিল্প, কার শিল্প, ধাতু শিল্প, মৌ-শিল্প ইত্যাদি তৈরিতে পারদর্শি ছিল। সাধারণ বাসন পত্র থেকে শুরু করে তারা বিভিন্ন ধাতুর দ্রব্যাদি প্রস্তুত করতে শেখে।


১২. ধর্মীয় বিশ্বাস ও জীবনব্যবস্থা : বৈদিক যুগে আর্যরা ধর্মীয় দিক থেকে উন্নত ছিল। বৈদিক যুগে আর্যরা বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। এ গুলোর মধ্যে তারা দেব-দেবীর রূপে উপাসনা করতো। যথা পৃথিবী সংক্রান্ত দেব-দেবী, আকাশ, বাতাস, সূর্য ও স্বর্গীয় দেব-দেবী। বৈদিক যুগে বহু দেব-দেবীর এ কাজকে অপরের সাথে সমর্থক বলে গণ্য করতো। সকল দেবতা একই ভগবানের প্রতীক অর্থ ও একেশ্বরবাদী ধারণার অবতারণা হয়।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রটো ঐতিহাসিক যুগে বৈদিক সভ্যতা ছিল সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার একটি নব রূপায়ণ, এ সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে দেখা যায় প্রটো ঐতিহাসিক যুগে মানুষ ও তার সমাজ চিত্র কেমন ছিল। এ সমাজে রাজার পরেই ছিল পুরোহিত ও সেনানী। এ সমাজে নারী ও পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!