পরিষদ বা সংস্কার আন্দোলনের কারণ বর্ণনা কর ।

admin

ভূমিকা

মধ্যযুগের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে পরিষদ আন্দোলন বা Councillor Movement একটি সংস্কারবাদী পদক্ষেপ ছিল। মধ্যযুগে গির্জা বা পোপ রাষ্ট্র ব্যক্তিজীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। মধ্যযুগের শেষভাগে যাজককুল যখন বিলাসিতা স্বেচ্ছাচারিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সংশ্রবে এসে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করার স্বপ্নে বিভোর থাকে এবং সকল ধরনের নৈতিকতাকে পদদলিত করে স্বার্থের হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে তখনই পরিষদ বা সংস্কার আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। আন্দোলনের মাধ্যমে পোপতন্ত্রের অবসান হয়


পরিষদ বা সংস্কার আন্দোলনের কারণ বর্ণনা কর ।

পরিষদ আন্দোলন পরিষদ আন্দোলনের অপর একটি নাম হলো সংস্কার আন্দোলন। পঞ্চদশ শতাব্দীর এই আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল পোপের ক্ষমতা হ্রাস এবং সম্রাটের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। প্রসঙ্গে বলা যায়, 'Councillor Movement aiming at the breaking of the supremacy of the church and challenging the arrogance of papacy.” জন অব প্যারিস, মার্সিলিও, উইলিয়াম ওকাম, জন অব গার্সন, পিয়ার ডি এটলি প্রমুখ ছিলেন এই আন্দোলনের পুরোধা


পরিষদ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বা কারণ

প্রতিটা আন্দোলনের পিছনেই বিশেষ কিছু কারণ থাকে। একইভাবে পরিষদ আন্দোলনের পিছনে কতিপয় কারণ বা প্রেক্ষাপট রয়েছে। নিম্নে পরিষদ বা সংস্কার আন্দোলনের কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :


. সম্রাট পোপের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব: পরিষদ বা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম কারণ সম্রাট পোপের ক্ষমতা তথা কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব। পোপ সম্রাটের অব্যবাহত ক্ষমতার দ্বন্দ্বে চতুর্দশ শতকের প্রথমদিকে মানুষের মধ্যে পোপ যাজক বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠে। এতে পোপ বা গির্জার সর্বময় কর্তৃত্বে আঘাত আসে। এর পাশাপাশি মানুষের দর্শন চিন্তাচেতনায় এক ধরনের পরিবর্তন আসে। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এই পরিবর্তন 'পরিষদ বা সংস্কার আন্দোলন' নামে পরিচিত


. গির্জার অবাধ কর্তৃত্ব হ্রাস: পরিষদ আন্দোলনের অন্যতম কারণ ছিল গির্জা বা পোপের সর্বময় কর্তৃত্ব মধ্যযুগে খ্রিষ্টাধর্মের একচ্ছত্র আধিপতা থাকায় পোপের ক্ষমতার বলর উল্লেখযোগ্য হারে প্রসারিত হয়। পোপ সার্বে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সার্বভৌমিকতার বলে পোপ তার ইচ্ছামতো ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। এতে রাষ্ট্র গণজীবনের সর্বস্তরে এক ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। এরূপ সমস্যার সমাধানে পরিষদ আন্দোলন গড়ে উঠে


. গির্জার অবকাঠামোগত সংস্কার: মধ্যযুগে সকল সমস্যার মীমাংসাকারী হিসেবে গির্জার আবির্ভাব ঘটে ফলে গির্জা তার সর্বজনীনতা হারিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বিধায় গির্জার অবকাঠামোগত সংস্কার আবশ্যক হয়ে পড় ধীরে ধীরে পোপবক্স কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র ধর্মীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে গির্জার কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে এমন পরিস্থিতিতে পরিষন আন্দোলন শুরু হয়


. অর্থের সদ্ব্যবহার : মধ্যযুগে গির্জা একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়। গির্জা বা পোপের সাধারণ মানুষের ছিল প্রবল শ্রদ্ধাবোধ। ফলে পোপেরা অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যায়। তারা এসব রাষ্ট্রীয় সম্পদর নিজের মনে করে এর যথেচ্ছ ব্যবহার করেন। এতে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের পরিবর্তে পোপতন্ত্রের উন্নয়ন ঘটে। এক পর্যন্ত সাধারণ মানুষ ভূত হয়ে উঠে বিধায় গির্জার অর্থের দাবিতে সংস্কার আন্দোলন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে


. গণতন্ত্রের বিকাশ: পরিষদ আন্দোলনের অন্যতম কারণ ছিল গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন। মধ্যযুগে খ্রিষ্টধর্মে সীমাহীন কর্তৃত্বের বলে গোপতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে উঠে। পোপের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের দরুন জনজীবন অতিষ্ঠ পড়ে। মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনযাপনের আশায় পোপ বলয় থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করে


. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ : রাষ্ট্র তথা জনগণের সামগ্রিক উন্নয়নে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু মধ্যযুগ গোপরা ডানের নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ফলে রাষ্ট্র জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ধর্মীয় উদ্দেশ্য হাসিলের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এহেন পরিস্থিতিঃ পরিষদ তথা সংস্কার আন্দোলন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে


. স্বেচ্ছাচারিতা রোধ: খ্রিষ্টধর্মের দোহাই দিয়ে পোপ স্বৈরাচারী হয়ে উঠে। পোপতন্ত্র বা পোপ নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে এবং ক্ষমতার মধ্যমণি মনে করতেন। এছাড়া তারা তাদের ক্ষমতাকে স্বাধীন ইচ্ছামতে ব্যবহার বা স্বৈরতন্ত্রের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। পোপের স্বৈরাচারী ক্ষমতার দরুন রাষ্ট্র জনগণের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এবং পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারীরা পোপের স্বেচ্ছাচারিতা রোধে পরিষদ বা সংস্কার আন্দোলনের ডাক দেন


. ধর্মদ্রোহিতার অবসান : ধর্মকে উদ্দেশ্য হাসিলের উপায় হিসেবে ব্যবহারের দরুন ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভক্তি হয় তাছাড়া পোপের সার্বভৌমত্ব চরমভাবে সমালোচিত হতে থাকে। গির্জার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বিশ্বাস পায়। পক্ষান্তরে, গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতি জনসমর্থন বাড়তে থাকে। অর্থাৎ ধর্মের অভ্যন্তরে এক ধরনের বিদ্রোহ জন্ম নে যার অবসানে আন্দোলনকারীরা সংস্কার আন্দোলনের ডাক দেন


. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : মধ্যযুগে নীতি-নৈতিকতার চরম অধঃপতন ঘটে যা ন্যায়বিচারের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ তোলে। গির্জার যাজকগণ নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধির আশায় ব্যাকুল হয়ে উঠে। যাজকদের একা আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাচেতনার ফলে ন্যায়বিচারের ধারণা নিভৃতে কাঁদতে থাকে। এরূপ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যাজকদের মধে নৈতিকতার প্রসারে পরিষদ বা সংস্কার আন্দোলনের ডাক আসে


১০. নিয়ন্ত্রণ ভারসাম্যনীতি প্রতিষ্ঠা : মধ্যযুগের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে পোপের একচ্ছত্র আধিপত্য হ্রাে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি এর ফলে জাতীয় রাষ্ট্রের গঠন হুমকির সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে, জনগণের যুক্তিবাদিতা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বৃদ্ধি পায় ফলে পোপতন্ত্রের উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। কারণে সংখ আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়


উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায় যে, গির্জা বা পোপের সার্বভৌম ক্ষমতা হ্রাসকরণের মহান লক্ষ্যকে সামনে রে পরিষদ বা সংস্কার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। আন্দোলনের ফলে মধ্যযুগীয় পোপতন্ত্রের কলঙ্কজনক অধ্যাকে যবনিকাপাত ঘটে। শুধু তাই নয়, আন্দোলন রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি, জাতীয় রাষ্ট্রের সূচনা, জনগণের ধারাকে শক্তিশা করে। সর্বোপরি, সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে নবজাগরণের উন্মেষ ঘটে যা আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল

 

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!