টি.এইচ. গ্রিন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রকৃত জনক ছিলেন-এ কথা কতটুকু সত্য তা আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

বেন্থাম যদিও উপযোগবাদী দার্শনিক, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উপাসক তবুও তিনি ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে যথার্থ প্রেক্ষিতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হন। উপযোগবাদের এ ব্যর্থতার গ্লানি উন্মোচন করে। সমাধানের নতুন পরিকল্পনা নিয়ে যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এগিয়ে আসেন ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে তাঁরা Oxford Idealist বা অক্সফোর্ড আদর্শবাদী সম্প্রদায় নামে পরিচিত। এ আদর্শবাদী সম্প্রদায় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা প্রদান করেন।


টি.এইচ. গ্রিন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রকৃত জনক ছিলেন-এ কথা কতটুকু সত্য তা আলোচনা কর।


জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র (People's welfare state) :

জনগণের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য যে রাষ্ট্র তৎপর থাকে তাই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। অর্থাৎ যে রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক চাহিদা বন্ধু, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে তাই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র।


জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ Pourd বলেছেন, যে রাষ্ট্র শান্তি শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তামূলক কাজে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে তার কর্মতৎপরতার আওতায় মানব কল্যাণের সকল ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং তার প্রশাসনিক প্রয়াস দ্বারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাসমূহ দূর করার চেষ্টা করে, তাকেই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলে।


তাই বলা যায় যে, রাষ্ট্র জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সবধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান করে, তাই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। টি.এইচ. গ্রিনকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জনকও বলা হয়।


নিম্নে টি.এইচ মিনকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জনক বলার কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :


১. রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা (Necessity of state) : রাষ্ট্রের উদ্ভব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মিন (Green) বলেছেন, ব্যক্তির জন্যই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে এবং ব্যক্তির প্রয়োজনের মধ্যেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিহিত। আর ত গ্রিন বলেছেন, ”ব্যক্তির অধিকার বলবৎ করতে পারে একমাত্র রাষ্ট্র।” অর্থাৎ অধিকার বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রের আবশ্যক। Professor Barker তাঁর 'Political Thought in England' গ্রন্থে বলেছেন, "The state is the product of human consciousness. Human consciousness postulates liberty, liberty involves rights, rights demand the state."


২. রাষ্ট্রের ভিত্তি (Base of state) : রাষ্ট্রের ভিত্তি সম্পর্কে Green-এর ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট। অস্টিন ঊর্ধ্বতন মানবীয় কর্তৃপক্ষকে সার্বভৌম বলেছেন। গ্রিন (Green) বলেছেন, এটাকে শুধুমাত্র ঊর্ধ্বতনের বলপ্রয়োগের ক্ষমতার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না। কেননা কোন শাসকের পক্ষেই তিনি যতই স্বৈরাচারী ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হোক না কেন, দীর্ঘকাল কেবল শক্তির জোরে জনগোষ্ঠীর অনুগত লাভ করতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে গ্রিন তাঁর Lectures on the Principles of Political Obligation' গ্রন্থে বলেছেন যে, "In the will and reason of men as determined by social relations.” তিনি আরো বলেছেন, রাষ্ট্র হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি, এর ভিত্তিমূলে চুক্তির কোনো স্থান নেই। আর সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে মুক্ত ইচ্ছার ফল।


৩. রাষ্ট্রের কর্তব্য (Responsibility of state) : গ্রিন মনে করেন, ব্যক্তিত্বের উন্নয়নের সাথে ইচ্ছা সম্পর্কিত বিধায় রাষ্ট্রের উচিত এমন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে জনগণ তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন করে তার স্বাধীন ইচ্ছাকে প্রয়োগ করতে পারে। এর লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে সকল প্রকার বাধা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। কারণ তিনি মনে করেন, স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রের পতন ঘটতে পারে।


৪. সম্পত্তির অধিকার (Right of property ) : T. H. Green সম্পত্তির অধিকারকে জাতীয় অধিকারের মূলভিত্তি বলে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, সমাজের কল্যাণে ব্যক্তির সামর্থ্যকে অবাধে প্রয়োগ করার জন্য তার সম্পত্তির অধিকার থাকা প্রয়োজন। তাঁর মতে, ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকার প্রয়োজন রয়েছে। আবার ব্যক্তির সম্পত্তির Limitations-এর কথা তিনি বলেছেন। কেননা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি বেশি থাকলে সে Power বেশি Hold করবে। ফলে Inequality দেখা দিবে। Green পুঁজি সম্পত্তিকেও সমর্থন করেছেন এবং বলেছেন, এ ধরনের সম্পত্তি সামাজিক কল্যাণ বিঘ্নিত করে না। কারণ পুঁজি বিনিয়োগের ফলে যে মুনাফা অর্জিত হয় তার একাংশ জনগোষ্ঠী ও শ্রমিক রাষ্ট্রের জনক বলা যায়। শ্রেণি ভোগ করে এবং অপর অংশ বিনিয়োগকারী বা পুঁজির মালিক ভোগ করে। এদিক থেকে গ্রিনকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জনক বলা হয়।


৫. অধিকার সম্পর্কিত ধারণা (Concept related right) : Green তাঁর রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণায় নাগরিকের অধিকারের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, অধিকার হলো সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত সুযোগ সুবিধা। তাঁর মতে, সমাজ ও কর্তৃত্ব হিসেবে পালনীয়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির কোনো অধিকার নেই। আইন তার কাছে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব হিসেবে পালনীয়।


৬. শিক্ষা সম্পর্কে (About education) : Green রাষ্ট্র কর্তৃক বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের কা বলেছেন। তিনি বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা বাধ্যতামূলক হলে কোনো পিতামাতা তাদের সন্তানদেরকে অজ্ঞতার অন্ধকারে রাখবে না।


৭. ব্যক্তিস্বাধীনতা (Individual freedom) : ব্যক্তিস্বাধীনতা সম্পর্কে গ্রিন সনাতনী মতবাদের বিরোধিতা করেন। স্বাধীনতা সম্পর্কে সনাতনী মতবাদ হলো কোনো মানুষের যা ইচ্ছা তা করা। কিন্তু গ্রিন বলেছেন যে, মানুষের যা খুশি তাই স্বাধীনতা হতে পারে না। যথার্থ স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের লক্ষ্যসমূহ অর্জনের পথে মানুষ যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় সেসব প্রতিবন্ধকতা থেকে বিমুক্তি। আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রেও ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা প্রদান করা হয় না, বরং ব্যক্তিকে এমন স্বাধীনতা প্রদান করা হয় যাতে সে তার পরিপূর্ণ সত্তার বিকাশের সুযোগ পায়। সুতরাং এ থেকে প্রমাণ মিলে যে, গ্রিন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রকৃত জনক ছিলেন।



৮. যুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা (Concept about war) : বর্তমানে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে যুদ্ধ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে থাকে। আর গ্রিনের মতেও যুদ্ধ কোনো সময়ই চূড়ান্ত অধিকার নয়। স্বাধীন জীবনযাপনের পরিপন্থি সংশোধনের জন্য আরেকটি ভুল কোনোক্রমেই করা উচিত নয়। তাঁর মতে, যুদ্ধে কালক্রমে দেশপ্রেক্ষিকতা ও জাতীয় হিসেবে যুদ্ধকে ধরা হয়। তাঁর মতে, কোনো ভুল সংশোধনের জন্য যুদ্ধকে বৈধ করা যেতে পারে। তবে একটি ভুল জীবনের শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়। তাই একটি সত্যিকার জাতীয় রাষ্ট্র বিভিন্ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে যুদ্ধকে এড়িয়ে চলে। যুদ্ধ সম্পর্কে গ্রিনের ধারণা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের যুদ্ধ সম্পর্কিত ধারণার সাথে সম্পূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করে।


৯. শাস্তি সম্পর্কে ধারণা (Concept about peace) : আধুনিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার অনুকূল পরিবেশ হিনও বলেছেন যে, অপরাধীদের ইচ্ছা সবসময় স্বাধীনতা বিরোধী। অপরাধীদের শাস্তি বিধানে রাষ্ট্রশক্তি নিয়োগ করবে। অপরাধীদের ইচ্ছা সবসময় স্বাধীনতা বিরোধী। অপরাধীদের শাস্তিবিধানে রাষ্ট্র শক্তি নিয়োগ করবে। অপরাধীদের এমন শাস্তি প্রদান করতে হবে যেন, পাপাচারদের ইচ্ছা এবং মনে পরিবর্তন আনা যায়। এক্ষেত্রে গ্রিন (Green), "The object of punishment is to secure freedom of action for the moral well to every member of the community." তাই গ্রিনের মতে, অপরাধীদের শুধু শান্তি প্রয়োগই নয়, এটা রাষ্ট্রের প্রধান কাজও বটে।


১০. বিদ্রোহ (Rebellion) : গ্রিন বলেছেন, রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে নাগরিকগণ অধিকার দাবি করতে পারে এবং শর্তসাপেক্ষে বিদ্রোহ করতে পারে। জনগণের ন্যায়সংগত দাবি আদায়ে ব্যর্থ, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী এবং অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার জনগণের রয়েছে।


১১. অন্যান্য (Others) : কলকারখানার গঠন ও পরিচাল নব্যবস্থা, জমির খাজনা নির্ধারণ, খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল রোধ ইত্যাদি বিষয়ে রাষ্ট্রিক হস্তক্ষেপ দ্বারা সমাজকে দ্রুত অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার কথা গ্রিন বলেছেন। স্বাস্থ্য ও শ্রমের উপর আইন প্রণয়নের প্রচেষ্টাকে গ্রিন অনুমোদন করেছেন। দেহ ও মনের পূর্ণতর পুষ্টি সাধনকে গ্রিন সৎ জীবনের পূর্বশর্ত বলে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন, বাস্তবানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করাই রাষ্ট্রের উচিত। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা, দ্রারিদ্র্য, অজ্ঞতা, নিরক্ষরতা, মদ্যপান ইত্যাদি সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রকে বসে থাকলে চলবে না, সাং ভূমিহীন কৃষক, শতাব্দীর বঞ্চনা বহনকারী দরিদ্র জনসাধারণ, অত্যধিক পরিশ্রমে ন্যুব্জ নারী, এদের দিকেও রাষ্ট্রকে তাকাতে হবে


উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, তিনি বুর্জোয়া কাঠামোর মধ্যে একটা কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন। গ্রিন রাজনীতি ও অর্থনীতিকে পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত বলেছেন। তিনি আরও বলেন, সমাজের কল্যাণের জন্যই এদের পরস্পর নির্ভরশীলতা দরকার। গ্রিন তার উদারনীতিবাদে বলেন যে, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ যদি সংকর রকম ক্ষতিকর কাজ না করে, স্বাধীনতার পরিধিকে ব্যাপক করে তোলে এবং সাধারণ কল্যাণ সুনিশ্চিত করার দিকে অগ্রসর হয়, তাহলে এ হস্তক্ষেপকে স্বীকার করে নিতে হবে। জনসাধারণের কল্যাণ যদি না হয়, তাহলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কোনো প্রয়োজন নেই। সুতরাং গ্রিনকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জনক বলা যেতে পারে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!