“শক্তি নয়, ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি”- (টি.এইচ. প্রিন এর উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

admin

ভূমিকা :

সময়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রচিন্তার ধারা পরিবর্তিত হয়েছে। আড়াই হাজার বছর পূর্বে প্লেটো এরিস্টটলের যুগ থেকে রাষ্ট্রতত্ত্বের বিকাশ লাভ করে। রাষ্ট্রতত্ত্বের এ ইতিহাসে কখনও রাষ্ট্র কখনও ব্যক্তি প্রাধান্য লাভ করেছে। ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র না কি রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি এ নিয়ে তর্ক এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র কোনো কল্পিত বিষয় নয়। তাদের মধ্যে জার্মানির কান্ট ও হেগেলের মাঝামাঝি অবস্থা থেকে বেছাম ও মিলের উদারনীতিবাদকে সংশোধন করে যে দর্শনের আবির্ভাব ঘটেছিল তাকে উদারনীতিবাদের সংশোধন বলা হয়। আর যেসব দার্শনিক এ সংশোধন কাজে ব্রতী ছিলেন তারা ইংল্যান্ডীয় রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে অক্সফোর্ড আদর্শবাদী সম্প্রদায় নামে পরিচিত। টমাস হিল গ্রিন ছিলেন এ আদর্শবাদের প্রবক্তা।

“শক্তি নয়, ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি”- (টি.এইচ. প্রিন এর উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

টি.এইচ. গ্রিনের পরিচয় (Introduce of T. H. Green) :

ইংল্যান্ডের চিন্তাজগতে নবা কান্টীয়বাদ এবং নব্য হেগেলবাদের স্রোত যখন প্রবলভাবে প্রবাহিত, ঠিক তখনই ১৮৩৬ সালের ৭ এপ্রিল ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের এক যাজক পরিবারে গ্রিন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন যাজক। মিন প্রথমে Rughy-তে এবং পরে Oxford- এর Balliol College-এ লেখাপড়া করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করার পর তিনি একই কলেজের ফেলো নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৮৭৮ সালে তিনি Oxford-এর নৈতিক দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বপদে বহাল ছিলেন


অষ্টাদশ শতকের যুক্তিবাদ, ঊনবিংশ শতকের অভিজাতবাদ ও উপযোগবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আপন করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাষ্ট্র ও ব্যক্তি সম্পর্কে যে নতুন চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে, টি.এইচ. গ্রিন (T.H. Green) ছিলেন তাঁর অন্যতম প্রবক্তা। তিনি তাঁর 'Principle of Political Obligation' নামক গ্রন্থে রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর মতবাদ ব্যক্ত করেন। যা সম্পর্কে বলতে গিয়ে গ্রিন বলেছেন, "Will not force is the basis of the state."


“শক্তি নয়,ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি” উক্তিটি ব্যাখ্যা করা হল-


টমাস হিল প্রিন (Thomas Hill Green) তাঁর 'Principle of Political Obligation' গ্রন্থে বলেছেন, "The state is product of human consciousness, which postulates, liberty, liberty involves right, right demand the state." পর অস্তিত্ব সমাজেই খুঁজে পাওয়া যায়। সমাজ মানুষের এ অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। তাই গ্রিনের দৃঢ় বিশ্বাস তিনি আরও বলেন, অধিকার কোনো চুক্তির ফল নয়। ব্যক্তি সমাজের সভ্য হিসেবে কতকগুলো অধিকার ভোগ করে রাষ্ট্র কখনও শক্তির দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না বা শক্তির দ্বারা সৃষ্টি হয় না। মানুষের ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষের ইচ্ছার উপরই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। অর্থাৎ “শক্তি নয়, ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি স্বরূপ।


এ প্রসঙ্গে গ্রিন আরও বলেন, "It is not coercive power but coercive power exercised according to law, writer or unwritten, for the maintenance of the existing rights of the citizens from external or internal invasions that makes a state."


তিনি আরও বলেন, "The state was not a definite and concrete organization of final character, but an institutionalised expression of the general will of the community."


রাষ্ট্রের প্রকৃত ভিত্তি শক্তি নয়, নাগরিকদের নিয়েই রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও তিনি যেসব যুক্তির উপর ভিত্তি করে এ অভিব্যক্তি প্রদান করেন তা নিচে আলোচনা করা হলো।


১. সামাজিক মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি রাষ্ট্র (Best expression of social values) : গ্রিনের মতে, রাষ্ট্র হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি। এর ভিত্তি হলে চুক্তির কোনো স্থান নেই। আর সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে মুক্ত ইচ্ছার ফল, যা সুস্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ রূপে সমাজে প্রতীয়মান হয়।


২. রাষ্ট্রের কর্তব্য (Duties of the state): গ্রিনের রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশ। গ্রিন মনে করতেন, ব্যক্তির অধিকার বা স্বাধীনতা সংকুচিত করার কোনো অধিকার বা ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই, বরং রাষ্ট্রের উচিত স্বাধীনতা ও অধিকার সংরক্ষণের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া। কারণ তিনি মনে করেন, স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রের পতন ঘটতে পারে।


উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে মানুষের Will-এর চেয়ে Communist law-এর প্রাধান্য ছিল বেশি। রাষ্ট্রই ছিল সর্বেসর্বা, যেখানে Personality development-এর কোনো অবকাশ ছিল না বলেই তার পতন ঘটেছে। তাই রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো ব্যক্তি আত্মোপলব্ধি ও স্বাধীন ইচ্ছায় পথের বিপত্তি দূর করা।


৩. সমাজের সমাজ (Society of all society) : গ্রিন রাষ্ট্রকে সকল সমাজের সমাজ বলে অভিহিত করেন। রাষ্ট্র সকল অভ্যন্তরীণ সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়কারী শক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। তাঁর মতে, এটা অপরাপর সংগঠনের বলেই একটি নৈতিক সংগঠন যার মূলভিত্তি মানব সম্মতি, ক্ষমতা নয়। ক্ষমতার বলে কোনো সম্প্রদায়ের নৈতিক বিধিব্যবস্থা লঙ্ঘন করা উচিত নয়।


৪. রাষ্ট্র কোনো ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান নয় (State is not divine organization) : গ্রিন বলেন, রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি নয় এবং শাসকগণও তার প্রতিনিধি ও ঈশ্বর কর্তৃক ক্ষমতা প্রাপ্ত নয়। তিনি রাজার ঐশ্বরিক অধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি বলেন, রাষ্ট্র এমন কিছু নয় যা ঐতিহাসিকভাবে কাল্পনিক, নৈতিকভাবে ভুল এবং যুক্তিযুক্তভাবে অযৌক্তিক।


৫. বলপ্রয়োগের অধিকার (Right of enforce) : গ্রিনের মতে, রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলা দমনে রাষ্ট্র বলপ্রয়োগ করতে পারে। এ বলপ্রয়োগ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়, বরং তা যথার্থভাবে জনগণের সম্মতির মধ্যেই নিহিত। কেননা সাধারণ সম্মতি না থাকলে বলপ্রয়োগ ধ্বংসাত্মক, লক্ষ্যহীন ও ব্যর্থ বলে প্রতিপন্ন হতে বাধ্য।


উদাহরণস্বরূপ, যোগ্যতর সামরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও জনগণের ইচ্ছা ও মতামতকে উপেক্ষা করার জন্যই তৎকালীন পাকিস্তানের (১৯৭১ পূর্ব) ভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়নি।


৬. রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্য (Obedience of citizens upon state) : গ্রিন বিশ্বাস করেন যে, রাষ্ট্রের প্রতি এবং রাষ্ট্রের আইনের প্রতি নাগরিকরা আনুগত্য প্রদর্শন করবে। কারণ রাষ্ট্র মহৎ ইচ্ছার ফলশ্রুতি এবং তা জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ নিশ্চিত করে নৈতিক জীবনের পথ সুগম করে। গ্রিন আবার বলেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহার করা যাবে যদি রাষ্ট্রীয় আইন সার্বিকভাবে নৈতিক জীবনের পরিপন্থি হয়। তিনি বলেন, আইন অমান্য করা যাবে তবে সন্ত্রাসী পন্থায় নয়, শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের দ্বারা।


৭. ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের অধিকার (Individual and state rights): গ্রিনের চিন্তায় রাষ্ট্রের অধিকার ও ব্যক্তির অধিকার- এ দুটি ধারণার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তাঁর মতে, নৈতিক আদর্শই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে গভীরভাবে সংযুক করে। নিজের নৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য মানুষ চায় এক সুনিয়ন্ত্রিত সাধারণ জীবন, যেখানে গণ ইচ্ছা, গণ মঙ্গলই হবে প্রধান লক্ষ্য। ব্যক্তি চায় রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে নিজের নৈতিক সমর্থনের বিকাশ, আর রাষ্ট্র চায় তাকে বিকশিত করতে। নৈতিক লক্ষ্য পূরণে রাষ্ট্র বলপ্রয়োগেও দ্বিধা করবে না। যে ব্যক্তির নৈতিক লক্ষ্য তথা গণ ইচ্ছা ও জনকল্যাণের আদর্শ থেকে বিচ্যুত সে ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে রাষ্ট্র বলপ্রয়োগ করবে।


৮. নৈতিক চেতনাবোধ (Moral consciousness) : গ্রিনের মতে, মানুষের নৈতিক চেতনা বোধই তাকে বলে দেয় যে, তার পক্ষে কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়। একথা সত্য যে, সমাজে অনেক লোক আছে যাদের এ চেতনা বোধের অভাব রয়েছে কিংবা যারা ইচ্ছাকৃতভাবেই এর প্রতি উদাসীন। এ অজ্ঞতা বা উদাসীনতাবশত তারা এমন সব কাজ করে যা মানুষের নৈতিক জীবনের পক্ষে গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রাষ্ট্র এ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রয়োজনে শক্তিপ্রয়োগ করবে। তবে তা অবশ্যই গণ ইচ্ছার ভিত্তিতে।


৯. রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির বিরোধিতা (Antagonism of individual toward state) : গ্রিন রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তিনা বিরোধিতাকে সমর্থন করেননি। তাঁর মতে, স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যক্তি রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে পারে না। কারণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তির স্বাভাবিক অধিকারের সুরক্ষা এবং তার নৈতিকতাকে বিকশিত করা। সাথে সাথে গণ ইচ্ছ জনকল্যাণের ধারণাকে প্রসারিত করা। তবে রাষ্ট্র আদর্শচ্যুত হলে ব্যক্তি তার বিরোধিতা করবে বৈকি। ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, জনস্বার্থকে সুরক্ষিত করতেই গ্রিন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার অধিকার দিয়েছেন।


১০. সার্বভৌমিকতার প্রয়োজনীয় উপাদান (Essential elements of sovereignty) : গ্রিন শক্তিকে সার্বভৌমিকতার প্রয়োজনীয় উপাদান বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ সাধারণের মঙ্গলের জন্য এবং নৈতিকতার বিকাশকে অব্যাহত রাখতে আইন প্রয়োগের জন্য শক্তির প্রয়োজন। আবার রাষ্ট্রের ভিত্তি বলতে তিনি গণ সম্মতি তথা সাধারণের মতামতকে বুঝিয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন যে, এ গণ সম্মতির অর্থ এই নয় যে, জনগণের প্রত্যেকেরই আইন তৈরি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে।


১১. রাষ্ট্র সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান নয় (State is not the highest organization): গ্রিন হেগেলের ন্যায় রাষ্ট্রকে লক্ষ্য ভাবেন নি, বরং লক্ষ্য উত্তরণের পন্থা হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। হেগেল যে অর্থে রাষ্ট্রকে চরম সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান বলে বর্ণনা করেছেন, গ্রিন তা করেননি। রাষ্ট্রের মধ্যে তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন নৈতিক ইচ্ছা ও জনকল্যাণের আদর্শ। ব্যক্তি বা রাষ্ট্র কেউই তার আদর্শ নয়। সমাজ, ধর্ম, নৈতিক ও জনকল্যাণই হলো তার আদর্শ।


১২. ব্যক্তিস্বাধীনতা (Freedom of individual) : গ্রিনের মতে, আত্মসচেতনতাই স্বাধীনতার পূর্বশর্ত। স্বাধীনতার সাথে জড়িত থাকে অধিকারের প্রশ্ন যা রক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রের। তাঁর মতে, রাষ্ট্রেই মানুষের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ব্যক্তির জন্যই স্বাধীনতা এবং মানুষ রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে রাষ্ট্রের মধ্যে নিজের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। রাষ্ট্র প্রয়োজনবোধে এসব পরম কল্যাণমূলক আদর্শ ও অধিকার বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বাস্তবিকপক্ষে সার্বভৌম শক্তির প্রধান কাজ উত্তম অধিকার সংরক্ষণ করা


উপসংহার : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিকগণ তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছার সত্যিকার বাস্তবায়ন ঘটাতে পারে। সকল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কেন্দ্র হলো রাষ্ট্রব্যবস্থা। রাষ্ট্র মানুষের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। এটা মুক্ত ব্যক্তিত্ব সৃষ্টির প্রতিষ্ঠান; নাগরিকদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। তাই এটা শক্তির উপর নয়, ইচ্ছার উপরই প্রতিষ্ঠিত। বিখ্যাত দার্শনিক যিনও এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আর এজন্যই তিনি বলেছিলেন, "Will not force is the basis of the state.


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!