ভূমিকা :
গৌতম বুদ্ধের (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দ- খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দ) বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সে মতবাদই 'বৌদ্ধদর্শন' বা ‘বৌদ্ধধর্ম।' বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম ও দর্শনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রায় ত্রিশটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে বলে জানা যায় । S. Chatterjee and D. Datta তাঁদের 'An Introduction to Indian Philosophy' গ্রন্থে বলেন, "Buddhism, thought primarily an ethical-religious movement, thus came to give birth to about thirty schools, not counting the minor one." (Page-140) এ সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নিম্নে প্রশ্নপত্রের আলোকে মাধ্যমিক শূন্যবাদ বা মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব আলোচনা করা হলো :
মাধ্যমিক
শূন্যবাদ : মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের
প্রবর্তক হলেন বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন। তিন পর 'মূল-মাধ্যমিক-কারিশ' (Mula-Madhyamika-Karikas) গ্রন্থে মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দার্শনিক মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা
করেন। মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দার্শনিক মতবাদের নাম হলো শূন্যবাদ। শূন্যবাদ অনুসারে
সবকিছুই শূন্য (Void)। মন বা বাহ্যবস্তু বলে কোন কিছুরই সত্তা নেই। S. Chatterjee and D. Datta তাঁদের 'An Introduction to
Indian Philosophy' গ্রন্থে বলেন, "The doctrine of Sunya-vada has been
understood in India, by non-Buddhist philosophers in general, to mean that the
universe id totally devoid of reality, that everything is sūnya or void."
(Page-143)
জড়জগৎ
সম্পর্কে মাধ্যমিক মত : মাধ্যমিক
শূন্যবাদ অনুসারে জড়জগৎ এবং মনোজগৎ সবই মিথ্যা। মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের মতানুসারে
জ্ঞাতা (The knower or the
subject), জ্ঞেয় (The known or the object) এবং জ্ঞান (Knowledge) পরস্পর নির্ভরশীল। এ তিনটির মধ্যে যে কোন একটির যদি অস্তিত্ব না
থাকে বা মিথ্যা হয় তবে অপর দুটিও মিথ্যা হতে বাধ্য। যেমন- অন্ধকারে যখন আমরা কোন
দড়িকে সাপ বলে জানি তখন সাপ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান মিথ্যা হয়, যেহেতু সেখানে
বাস্তবিক কোন সাপ নেই। সাপের জ্ঞান যেখানে মিথ্যা সেখানে যে মন জেনেছে সে মনও
মিথ্যা। কাজেই গাধ্যমিকগণ এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, জড়জগতে বা মনোজগতে যাই আমরা
প্রত্যক্ষ করি না কেন সবই মিথ্যা।
মাধ্যমিক
শূন্যবাদ অনুসারে সবই শূন্য :
মাধ্যমিক শূন্যবাদ অনুসারে সবই অসৎ এবং সবই শূন্য। এ কারণে মাধ্যমিক মতবাদকে ভারতে
এবং ইউরোপে সর্ববৈনাশিকবাদ বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাধ্যমিক মতবাদ
সর্ববৈনাশিকবাদ নয়। কারণ মাধ্যমিকগণ সর্বসত্তাকে অস্বীকার করেন নি। তাঁরা কেবল
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও পরিদৃশ্যমান জগতের সত্তাকে অস্বীকার করেন। কিন্তু পরিদৃশ্যমান
জগতের অন্তরালে যে সত্তা বিদ্যমান তাকে তাঁরা অস্বীকার করেন নি। তাঁদের মতে,
পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরালের সত্তাকে কোন রকমের গুণের দ্বারা বর্ণনা করা যায় না।
যেহেতু পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরালের সত্তা বর্ণনাতীত সেহেতু সবই শূন্য। 'শূন্য'
অর্থে সাধারণ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যায় ন!-এ কথাই মাধ্যমিকগণ বলেছেন।
সুতরাং চরম সত্তাকে শূন্য বলার অর্থ তাকে অস্বীকার করা নয়।
মাধবাচার্য-এর
মত : মাধবাচার্য তাঁর লঙ্কাবতার সূত্রে বলেন, জাগতিক
কোন বস্তুর প্রকৃত সত্তা কি না তা বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করা যায় না, তাই তা
অবর্ণনীয়। জাগতিক বস্তুকে সৎও বলা যায় না, কারণ যা সৎ তা শর্তাধীন নয়। কিন্তু
আমরা জানি জাগতিক সকল বস্তুই শতাধীন। জাগতিক বস্তুকে অসৎও বলা যায় না, কারণ অসৎ
বস্তু (যেমন- আকাশ-কুসুম) প্রতিভাত হয় না। কিন্তু জাগতিক বস্তু প্রতিভাত হয়।
আবার জাগতিক বস্তুকে সৎ ও অসৎ বলা চলে না। কারণ দুটি বিরুদ্ধ ধর্মের এক জায়গায়
সমাবেশ সম্ভব নয়। একইভাবে জাগতিক বস্তুকে সৎও নয়, অসৎও নয়- এ কথাও বলা যায় না।
কারণ দুটি বিরুদ্ধ ধর্মের এক বস্তুতে অভাবও সম্ভব নয় । তাই বস্তুকে শূন্য বলা
হয়েছে। অর্থাৎ জাগতিক বস্তুর অনির্বচনীয়তাকেই শূন্যতা আখ্যা দেয়া হয়েছে ।
'শূন্যবাদ'
ও প্রতীত্য সমুৎপাদ : নাগার্জুনের শূন্যবাদ'
প্রতীত্য সমুৎপাদ হতে নিঃসৃত। যে মতবাদ অনুসারে সব বস্তুই শর্তাধীন তাকে প্রতীত্য
সমুবাদ বলে। নাগার্জুনের মতে, বস্তুর সকল ধর্মই উৎপত্তির দিক হতে শর্তসাপেক্ষ বলে
তা শূন্য।
শূন্যবাদ
ও মধ্যম পন্থা : শূন্যবাদকে মাধ্যমিক
মতবাদ বলার কারণ হলো এ মতবাদ 'মধ্যম পন্থা' অবলম্বন করে। এ মতবাদ বস্তুর শর্তাধীন
অস্তিত্বকে স্বীকার করে একদিকে যেমন বস্তুর নিত্যতা অস্বীকার করে অপরদিকে বস্তুর
নিছক শূন্যতাকেও অস্বীকার করে। প্রতীত্য সমুৎপাদকে বুদ্ধদেব মধ্যম পন্থা বলতেন।
শূন্যবাদ প্রতীত্য সমুৎপাদ হতে নিঃসৃত বলে নাগার্জুনও একে মধ্যম পন্থা বলেছেন।
শূন্যবাদ
আপেক্ষিকণাদ নয় : শূন্যবাদকে
আপেক্ষিকবাদও বলা যায় না। কারণ শূন্যবাদ অনুসারে কোন বস্তু বা বস্তুর ধর্মকে
জানতে হলে অন্যবস্তুর সঙ্গে তার সম্বন্ধের মাধ্যমে জানতে হয়। আপেক্ষিকবাদের মতো
শূন্যবাদও স্বীকার করে যে, কোন বস্তুর এমন কোন ধর্ম নেই যা সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর।
জগৎ
সম্পর্কে মাধ্যমিক মত : মাধ্যমিক
দর্শন অবভাসিক জগৎ এবং এর অন্তরালে এক পরমার্থিক জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করে। এই
দর্শন মতে, অনিত্যতা, পরিবর্তনশীলতা, কার্যকারণ সম্পর্ক প্রভৃতি পরমার্থিক জগৎ
সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়, কেবল অবভাসিক জগৎ সম্পর্কে প্রযোজ্য ।
সত্য
সম্পর্কে নাগার্জুনের মত : নাগার্জুন
বলেন, বুদ্ধদেবের শিক্ষায় দুই রকমের সত্য স্বীকৃত হয়েছে। যথা : সংস্কৃতি সত্য
এবং পরমার্থ সত্য। সংবৃতি সত্য নিম্নস্তরের এবং এটি সাধারণ লোকের জন্য। আর
পরমার্থসত্য উচ্চস্তরের সত্য যা নির্বাণের মাধ্যমে উপলব্ধি হয় । তিনি আরো বলেন,
সংস্কৃতি সত্য হলো পরমার্থ সত্য লাভের সোপান হিসেবে কাজ করে এবং যারা এ দুই রকমের
সত্যের পার্থক্যকে বুঝতে পারে না তারা বুদ্ধদেবের শিক্ষার সঠিক তাৎপর্যও বুঝতে
পারে না। নাগার্জুন বলেন, নির্বাণলাভে যে পরমার্থ সত্যের অভিজ্ঞতা হয় তাকে
ব্যবহৃত ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। তবে তার নেতিবাচক বর্ণনা দেয়া সম্ভব। যেমন-
যা সাধারণভাবে জানা যায় না, যা নতুনভাবে অর্জন করা যায় না ইত্যাদি-তাই নির্বাণ।
নির্বাণকে যেমন বর্ণনা করা যায় না তেমনি নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরও বর্ণনা দেয়া
যায় না। তাই 'তথাগত' সম্পর্কে বুদ্ধদেবকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বুদ্ধদেব চুপ করে
থাকতেন মাধ্যমিকগণের সত্যের প্রকারভেদ, জগতের মিথ্যাত্বের স্বীকৃতি ও পরমার্থিক
সত্যের অবর্ণনীয়তার কথা চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, মাধ্যমিক দর্শনের সঙ্গে
শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের বিশেষ মিল লক্ষ্য করা যায় ।
উপসংহার
: পরিশেষে বলা যায় মাধ্যমিক সম্প্রদায় বুদ্ধের
আচরণ ও বাণীর বিশ্লেষণ দ্বারা সমগ্র ভারতীয় দার্শনিক চিন্ত ধারায় এক
গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ঘটিয়েছে। মূলত মাধ্যমিক চিন্তার প্রভাবেই বৌদ্ধদর্শন একটি
আধ্যাত্মিকমূলক কর্ম পরিণত হয়েছে। কাজেই মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব তথা
শূন্যবাদ ভারতীয় দর্শনের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে