বৌদ্ধদর্শনে মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব আলোচনা কর

admin

 ভূমিকা : 

গৌতম বুদ্ধের (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দ- খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দ) বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সে মতবাদই 'বৌদ্ধদর্শন' বা ‘বৌদ্ধধর্ম।' বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম ও দর্শনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রায় ত্রিশটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে বলে জানা যায় । S. Chatterjee and D. Datta তাঁদের 'An Introduction to Indian Philosophy' গ্রন্থে বলেন, "Buddhism, thought primarily an ethical-religious movement, thus came to give birth to about thirty schools, not counting the minor one." (Page-140) এ সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


প্রশ্ন: ধর্ম্মসঙ্গনীর আলোচ্য বিষয়বস্তুর ধারনা দাও এবং মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে এটি কতটুকু সার্থক তা মূল্যায়ন কর। ভূমিকা:দার্শনিক তত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বমূলক দেশনাই অভিধর্ম নামে অভিহিত । মাতৃদেবীকে ধর্মসুধা প্রদানের জন্য তাবতিংস স্বর্গে উপনীত হলে ভগবান সেখানেই তিনমাস বর্ষাযাপন সহ প্রথম অভিধর্ম দেশনা করেন। অভিধর্ম অর্থ হলো সূত্র এবং বিনয়ের অতিরিক্ত ধর্ম। এই অভিধর্ম পিটকে সাতটি গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে প্রথম ও অন্যতম প্রধান গ্রন্থ ধৰ্ম্মসঙ্গনী।  ধম্মসঙ্গনীঃ- ধর্ম্মসঙ্গনী শব্দের মূল অর্থ ধর্মে ধর্মের সংগণনা' বা ধর্মের 'সংক্ষিপ্ত দেশনা'। এতে ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্বগুলো আলোচনা করা হয়েছে। চাইল্ডার সাহেবের মতে, একে ধৰ্ম্মসঙ্গনী বলার কারণ হলো এতে কামলোক, রূপলোক, অরূপলোক ও নির্বাণ সম্পর্কীয় বিষয় সমূহ সুন্দরভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সংগ্রহিত করা হয়েছে । এতে সমস্ত বিষয়ের নীতিধর্মের দৃষ্টিভঙ্গীতে মনোবিজ্ঞান সম্মত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। শ্রীমতী রীজ ডেভিডস ধৰ্ম্মসঙ্গনীর ইংরেজী ভাষান্তর করেছেন A Buddhist Manual of Psychological Ethics. প্রকৃতপক্ষে ধর্মসঙ্গনী অভিধর্ম পিটকের একটি সারগ্রন্থ বা manual।  ধর্মসঙ্গনীর আলোচ্য বিষয়বস্তু : ধর্মসঙ্গনীর  অভিধর্ম পিটকের সারাংশ বলা যায়। এতে অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের স্থূল ও সূক্ষ্ম যাবতীয় ব্যাপারকে চিত্ত, চৈতসিক ও জড় পদার্থের মাধ্যমে প্রকাশ করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। নাম - রূপকে কার্য-কারণ নীতি অনুসারে অকুশল কুশল এবং অব্যাকৃত এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথাঃ ১ চিত্ত ও চৈতসিকের পরিচয়, ২. রূপ বা জড় পদার্থের পরিচয়, ৩.পূর্বোক্ত বিষয়ের সংক্ষিপ্তসার বা নিক্ষেপ । ধর্ম্মসঙ্গনীতে চিত্ত ও চৈতসিকের পরিচয় দিতে গিয়ে প্রথমে কুশল চিত্তকে আলোচ্য বিষয় রূপে গ্রহণ করা হয়েছে। চার প্রকার ভূমি ভেদে কুশল চিত্তের সংখ্যা হল ২১টি। এই ২১ প্রকার কুশল চিত্ত চার ভাগে বিভক্ত। যথা- কামারচর, রূপাবার, অরূপারচর ও লোকোত্তর । বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার সম্প্রযুক্ত হয়ে সৌমনস্য, দৌর্মনস্য, উপেক্ষা সহগত, অসংষ্কারিক, সসংস্কারিক, জ্ঞান সম্প্রযুক্ত, জ্ঞান বিপ্রযুক্ত হয়ে নানা প্রকার হয়।  তারপর অকুশল চিত্ত বিভাগে ৮ টি লোভমূলক ২টি মোহ মূলক ও ২টি দ্বেষমূলক মোট ১২ টি অকুশল চিত্ত বর্ণিত হয়েছে। বিপাক চিত্ত বিভাগে ২৩টি কামাবচর, ৫টি রাপাবচর, ৪টি অরূপাবচর ও ৪ টি লোকোত্তর বিপাকচিত্ত বর্ণিত হয়েছে। ক্রিয়াচিত্ত বিভাগে কামারচর ১১ টি, রূপাবার ৫ টি ৩ অরাপাবচর ৪ টি মোট ২০ টি ক্রিয়াচিত্ত বর্ণিত হয়েছে। এভাবে চিত্তের সংখ্যা হল ৮৯টি। এই ৮৯ প্রকার চিত্তকে অন্যভাবে কামাবচর ৫৪ টি, রাপাবচর ১৫ টি, অরুপাবচার ১২টি ও লোকোত্তর ৪০ টি মোট ১২১ প্রকার ও বিভক্ত করা যায়।কামারচর, রাপারচর, অরূপাবার ও লোকোত্তর এ চার প্রকার চিত্তের মধ্যে কেবল প্রথম প্রকারের চিওগুলোকে সাধারণ চিত্ত বা কামাবচরী চিও বলা যায়। এদের প্রতিক্রিয়া কুশল অথবা অকুশল, ক্রিয়ান্বিত অথবা বিপাকী, সংস্কারিক অথবা অসংস্কারিক, সহেতুক অথবা অহেতুক এভাবে বিবিধ প্রকার হয়। কামভূমির ঊর্ধ্বে অবস্থিত রূপারচর ও অরাপারচর চিত্তসমূহ ধ্যানচিত্ত। এদের প্রতিক্রিয়া কুশলজনক । লোকোত্তর চিত্তসমূহ জাগতিক কুশলাকুশলের উর্ধ্বে অবস্থিত । এরা ক্রিয়ান্বিত ও ফলপ্রসূ হয়। কামারচর হতে অরূপাবার ভূমি পর্যন্ত চিত্তগুলো ভবাভিমুখী ও ভবাবলম্বী  এরা লৌকিক লোকোত্তর চিন্তগুলো নির্বাণাভিমুখী ও নির্বাণাবলম্বী।  চৈতসিক বিভাগে মোট ৫২ প্রকার চৈতসিকের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে চিত্ত বা মন সাধারণত ভাস্বর। চৈতসিক সহযোগেই এটি চৈতসিরের অবস্থা প্রাপ্ত হয়। যে সমস্ত ধর্ম চিত্তের সঙ্গে একসাথে উৎপন্ন ও নিরুদ্ধ চিত্ত হয় এবং একইরূপ আলম্বন ও বাস্তু গ্রহন করে, এমন চিত্ত যুক্ত ৫২ প্রকার চিত্ত বৃত্তির নামই চৈতসিক । চিত্ত চৈতসিক পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উৎপন্ন হতে পারে না।  চৈতসিক বা চিত্তবৃত্তির সংখ্যা ৫২ হলে ও মূল চৈতসিক মাত্র সাতটি। যথা- স্পর্শ, বেদনা, সংজ্ঞা, চেতনা, একাগ্রতা, জীবিতেন্দ্রিয় ও মনস্কার । এ সাত প্রকার চৈতসিকের সম্মিলনেই চতুর্ভুমির চিত্তসমূহ গঠিত হয়। এগুলোকে "সর্বচিত সাধারণ চৈতসিক " বলা হয়। এই সাতটি চৈতসিক ছাড়া ও ৪৫ প্রকার চৈতসিক আছে । এসব এবং সপ্ত সাধারণ চৈতসিক একত্রে চিত্তের সাথে যুক্ত হয়ে চতুভূমির চিত্তসমূহ উৎপন্ন করে। এ বায়ান্ন প্রকার চৈতসিক কোন প্রকার চিত্তের সাথে কিভাবে সম্প্রযুক্ত হয়ে কিরাপ অবস্থা প্রাপ্ত হয় প্রভৃতি নানা প্রকার বিষয়সমূহ ধৰ্ম্মসঙ্গনীতে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। রূপের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ধৰ্ম্মসঙ্গনীতে বলা হয়েছে, জীবদেহ, রূপ বলতে সাধারণতঃ জীবজগৎ, জড় জগৎ, মৃতদেহ এবং তৎসম্পর্কীয় যাবতীয় বিষয় ও বস্তু বুঝায়। পৃথিবী, অপ্, তেজ, বায়ু প্রভৃতি চারি মহাভূত, যারা আভিধার্মিক দৃষ্টিভঙ্গীতে কাঠিন্য ও ব্যাপকত্ব, তারল্য ও স্নেহত্ব, উষ্ণত্ত্ব ও গতি প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুনের দ্যোতক, এবং মহাভূত হতে উৎপন্ন চক্ষু, শ্রোত্রাদি পঞ্চ ইন্দ্রিয়, রূপ, শব্দাদি ইন্দ্রিয় উৎপন্ন বিষয়, স্ত্রী ইন্দ্রিয়, পুরুষ ইন্দ্রিয়, জীবিত ইন্দ্রিয়, কায়িক লঘুতা, কায়িক মৃদুতা, কায় বিজ্ঞপ্তি, বাক বিজ্ঞপ্তি প্রভৃতি গুণগুলো আলোচিত হয়েছে।  উপরোক্ত বিষয়গুলো আলোচনার পর ধম্মসঙ্গনীতে জীবজগতের শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, বিশ্বব্রহ্মান্তের সর্বনিম্নে কামলোক, তারপর রূপলোক, তার ঊর্ধ্বে অরূপ লোক। কামলোকের তিনটি স্তর। মথা নরক, মনুষ্যলোক ও দেবলোক। কামলোকের সর্বনিম্নে নিয়ে, মধ্যে মনুষ্যলোক এবং সর্ব উর্ধ্বে ছয়টি দেবলোক । নরক আবার চার ভাগে বিভক্ত। যথা-নিরয়, প্রেত, তির্যক ও অসুর। রূপলোকের ১৬টি স্তর এবং অরূপ লোকের ৪ টি স্তর। লোকোত্তর জগত তাদের সাথে সম্পর্ক বর্জিত । কারণ বিশ্বব্রহ্মান্ড সংস্কৃত এবং লোকোত্তর জগৎ অসংস্কৃত। সংস্কৃত বস্তুর ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু অসংস্কৃত লোকোত্তর জগত চিরস্থায়ী । এ জগতে একবার উৎপন্ন হতে পারলে তা থেকে পুনরায় পতনের কোন সম্ভাবনা নেই। এটাই বুদ্ধ প্রবর্তিত নির্বাণ। এই নির্বানের স্বরূপ উদ্‌ঘাটনই অভিধর্ম পিটকের প্রধান উদ্দেশ্য।   মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে ধম্মসঙ্গনীর মূল্যায়নঃ- অভিধর্ম পিটকের ধর্মসঙ্গনীর বিষয়বস্তু সমূহ পরমার্থ সম্পর্কীয় পরমাথ বচন। এতে বৌদ্ধ মননশীলতার চরম বিকাশ প্রতিফলিত হয়েছে। এই গ্রন্থের মূল আলোচ্য বিষয় বৌদ্ধ দর্শন ও পরমার্থ সত্য। পরমার্থ মাত্রই জটিল ও সাধনালভ্য। সংস্কার মন ও কঠোর সাধনা ব্যাতীত এটি হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন। শীলবান ব্যক্তি একনিষ্ঠ সাধনার দ্বারাই এতে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। এতে বলা হয়েছে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যাবতীয় রূপই জীবন্ত দেহ ও জড় পদার্থের বিবিধ প্রকার অভিব্যক্তি। মূলত কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের সাহায্যে বক্তব্য বিষয়ের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করাই ধম্মসঙ্গনীর প্রধান বিশেষত্ব, অতএব যে মনস্তত্ব বিশ্লেষণে ধম্মসঙ্গনীর সার্থক মূল্যায়ন হয়েছে ।   মন্তব্যঃ- পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্মসঙ্গনী গ্রন্থটি অভিধর্ম পিটকের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এতে সমস্ত বিষয়ের নীতিধর্মের দৃষ্টিভঙ্গীতে মনোবিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করা হয়েছে।


নিম্নে প্রশ্নপত্রের আলোকে মাধ্যমিক শূন্যবাদ বা মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব আলোচনা করা হলো :

মাধ্যমিক শূন্যবাদ : মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের প্রবর্তক হলেন বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন। তিন পর 'মূল-মাধ্যমিক-কারিশ' (Mula-Madhyamika-Karikas) গ্রন্থে মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দার্শনিক মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেন। মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দার্শনিক মতবাদের নাম হলো শূন্যবাদ। শূন্যবাদ অনুসারে সবকিছুই শূন্য (Void)। মন বা বাহ্যবস্তু বলে কোন কিছুরই সত্তা নেই। S. Chatterjee and D. Datta তাঁদের 'An Introduction to Indian Philosophy' গ্রন্থে বলেন, "The doctrine of Sunya-vada has been understood in India, by non-Buddhist philosophers in general, to mean that the universe id totally devoid of reality, that everything is sūnya or void." (Page-143)

জড়জগৎ সম্পর্কে মাধ্যমিক মত : মাধ্যমিক শূন্যবাদ অনুসারে জড়জগৎ এবং মনোজগৎ সবই মিথ্যা। মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের মতানুসারে জ্ঞাতা (The knower or the subject), জ্ঞেয় (The known or the object) এবং জ্ঞান (Knowledge) পরস্পর নির্ভরশীল। এ তিনটির মধ্যে যে কোন একটির যদি অস্তিত্ব না থাকে বা মিথ্যা হয় তবে অপর দুটিও মিথ্যা হতে বাধ্য। যেমন- অন্ধকারে যখন আমরা কোন দড়িকে সাপ বলে জানি তখন সাপ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান মিথ্যা হয়, যেহেতু সেখানে বাস্তবিক কোন সাপ নেই। সাপের জ্ঞান যেখানে মিথ্যা সেখানে যে মন জেনেছে সে মনও মিথ্যা। কাজেই গাধ্যমিকগণ এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, জড়জগতে বা মনোজগতে যাই আমরা প্রত্যক্ষ করি না কেন সবই মিথ্যা।

 

মাধ্যমিক শূন্যবাদ অনুসারে সবই শূন্য : মাধ্যমিক শূন্যবাদ অনুসারে সবই অসৎ এবং সবই শূন্য। এ কারণে মাধ্যমিক মতবাদকে ভারতে এবং ইউরোপে সর্ববৈনাশিকবাদ বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাধ্যমিক মতবাদ সর্ববৈনাশিকবাদ নয়। কারণ মাধ্যমিকগণ সর্বসত্তাকে অস্বীকার করেন নি। তাঁরা কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও পরিদৃশ্যমান জগতের সত্তাকে অস্বীকার করেন। কিন্তু পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরালে যে সত্তা বিদ্যমান তাকে তাঁরা অস্বীকার করেন নি। তাঁদের মতে, পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরালের সত্তাকে কোন রকমের গুণের দ্বারা বর্ণনা করা যায় না। যেহেতু পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরালের সত্তা বর্ণনাতীত সেহেতু সবই শূন্য। 'শূন্য' অর্থে সাধারণ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যায় ন!-এ কথাই মাধ্যমিকগণ বলেছেন। সুতরাং চরম সত্তাকে শূন্য বলার অর্থ তাকে অস্বীকার করা নয়।


মাধবাচার্য-এর মত : মাধবাচার্য তাঁর লঙ্কাবতার সূত্রে বলেন, জাগতিক কোন বস্তুর প্রকৃত সত্তা কি না তা বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করা যায় না, তাই তা অবর্ণনীয়। জাগতিক বস্তুকে সৎও বলা যায় না, কারণ যা সৎ তা শর্তাধীন নয়। কিন্তু আমরা জানি জাগতিক সকল বস্তুই শতাধীন। জাগতিক বস্তুকে অসৎও বলা যায় না, কারণ অসৎ বস্তু (যেমন- আকাশ-কুসুম) প্রতিভাত হয় না। কিন্তু জাগতিক বস্তু প্রতিভাত হয়। আবার জাগতিক বস্তুকে সৎ ও অসৎ বলা চলে না। কারণ দুটি বিরুদ্ধ ধর্মের এক জায়গায় সমাবেশ সম্ভব নয়। একইভাবে জাগতিক বস্তুকে সৎও নয়, অসৎও নয়- এ কথাও বলা যায় না। কারণ দুটি বিরুদ্ধ ধর্মের এক বস্তুতে অভাবও সম্ভব নয় । তাই বস্তুকে শূন্য বলা হয়েছে। অর্থাৎ জাগতিক বস্তুর অনির্বচনীয়তাকেই শূন্যতা আখ্যা দেয়া হয়েছে ।

 

'শূন্যবাদ' ও প্রতীত্য সমুৎপাদ : নাগার্জুনের শূন্যবাদ' প্রতীত্য সমুৎপাদ হতে নিঃসৃত। যে মতবাদ অনুসারে সব বস্তুই শর্তাধীন তাকে প্রতীত্য সমুবাদ বলে। নাগার্জুনের মতে, বস্তুর সকল ধর্মই উৎপত্তির দিক হতে শর্তসাপেক্ষ বলে তা শূন্য।

 

শূন্যবাদ ও মধ্যম পন্থা : শূন্যবাদকে মাধ্যমিক মতবাদ বলার কারণ হলো এ মতবাদ 'মধ্যম পন্থা' অবলম্বন করে। এ মতবাদ বস্তুর শর্তাধীন অস্তিত্বকে স্বীকার করে একদিকে যেমন বস্তুর নিত্যতা অস্বীকার করে অপরদিকে বস্তুর নিছক শূন্যতাকেও অস্বীকার করে। প্রতীত্য সমুৎপাদকে বুদ্ধদেব মধ্যম পন্থা বলতেন। শূন্যবাদ প্রতীত্য সমুৎপাদ হতে নিঃসৃত বলে নাগার্জুনও একে মধ্যম পন্থা বলেছেন।

 

শূন্যবাদ আপেক্ষিকণাদ নয় : শূন্যবাদকে আপেক্ষিকবাদও বলা যায় না। কারণ শূন্যবাদ অনুসারে কোন বস্তু বা বস্তুর ধর্মকে জানতে হলে অন্যবস্তুর সঙ্গে তার সম্বন্ধের মাধ্যমে জানতে হয়। আপেক্ষিকবাদের মতো শূন্যবাদও স্বীকার করে যে, কোন বস্তুর এমন কোন ধর্ম নেই যা সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর।

জগৎ সম্পর্কে মাধ্যমিক মত : মাধ্যমিক দর্শন অবভাসিক জগৎ এবং এর অন্তরালে এক পরমার্থিক জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করে। এই দর্শন মতে, অনিত্যতা, পরিবর্তনশীলতা, কার্যকারণ সম্পর্ক প্রভৃতি পরমার্থিক জগৎ সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়, কেবল অবভাসিক জগৎ সম্পর্কে প্রযোজ্য ।

 

সত্য সম্পর্কে নাগার্জুনের মত : নাগার্জুন বলেন, বুদ্ধদেবের শিক্ষায় দুই রকমের সত্য স্বীকৃত হয়েছে। যথা : সংস্কৃতি সত্য এবং পরমার্থ সত্য। সংবৃতি সত্য নিম্নস্তরের এবং এটি সাধারণ লোকের জন্য। আর পরমার্থসত্য উচ্চস্তরের সত্য যা নির্বাণের মাধ্যমে উপলব্ধি হয় । তিনি আরো বলেন, সংস্কৃতি সত্য হলো পরমার্থ সত্য লাভের সোপান হিসেবে কাজ করে এবং যারা এ দুই রকমের সত্যের পার্থক্যকে বুঝতে পারে না তারা বুদ্ধদেবের শিক্ষার সঠিক তাৎপর্যও বুঝতে পারে না। নাগার্জুন বলেন, নির্বাণলাভে যে পরমার্থ সত্যের অভিজ্ঞতা হয় তাকে ব্যবহৃত ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। তবে তার নেতিবাচক বর্ণনা দেয়া সম্ভব। যেমন- যা সাধারণভাবে জানা যায় না, যা নতুনভাবে অর্জন করা যায় না ইত্যাদি-তাই নির্বাণ। নির্বাণকে যেমন বর্ণনা করা যায় না তেমনি নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরও বর্ণনা দেয়া যায় না। তাই 'তথাগত' সম্পর্কে বুদ্ধদেবকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বুদ্ধদেব চুপ করে থাকতেন মাধ্যমিকগণের সত্যের প্রকারভেদ, জগতের মিথ্যাত্বের স্বীকৃতি ও পরমার্থিক সত্যের অবর্ণনীয়তার কথা চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, মাধ্যমিক দর্শনের সঙ্গে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের বিশেষ মিল লক্ষ্য করা যায় ।

 

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় মাধ্যমিক সম্প্রদায় বুদ্ধের আচরণ ও বাণীর বিশ্লেষণ দ্বারা সমগ্র ভারতীয় দার্শনিক চিন্ত ধারায় এক গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ঘটিয়েছে। মূলত মাধ্যমিক চিন্তার প্রভাবেই বৌদ্ধদর্শন একটি আধ্যাত্মিকমূলক কর্ম পরিণত হয়েছে। কাজেই মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব তথা শূন্যবাদ ভারতীয় দর্শনের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে

 

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!