ধর্ম্মসঙ্গনীর আলোচ্য বিষয়বস্তুর আলোচনা কর।

admin

 ভূমিকা:দার্শনিক তত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বমূলক দেশনাই অভিধর্ম নামে অভিহিত । মাতৃদেবীকে ধর্মসুধা প্রদানের জন্য তাবতিংস স্বর্গে উপনীত হলে ভগবান সেখানেই তিনমাস বর্ষাযাপন সহ প্রথম অভিধর্ম দেশনা করেন। অভিধর্ম অর্থ হলো সূত্র এবং বিনয়ের অতিরিক্ত ধর্ম। এই অভিধর্ম পিটকে সাতটি গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে প্রথম ও অন্যতম প্রধান গ্রন্থ ধৰ্ম্মসঙ্গনী। 


ধর্ম্মসঙ্গনীর আলোচ্য বিষয়বস্তুর আলোচনা কর।

ধম্মসঙ্গনীঃ-

ধর্ম্মসঙ্গনী শব্দের মূল অর্থ ধর্মে ধর্মের সংগণনা' বা ধর্মের 'সংক্ষিপ্ত দেশনা'। এতে ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্বগুলো আলোচনা করা হয়েছে। চাইল্ডার সাহেবের মতে, একে ধৰ্ম্মসঙ্গনী বলার কারণ হলো এতে কামলোক, রূপলোক, অরূপলোক ও নির্বাণ সম্পর্কীয় বিষয় সমূহ সুন্দরভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সংগ্রহিত করা হয়েছে । এতে সমস্ত বিষয়ের নীতিধর্মের দৃষ্টিভঙ্গীতে মনোবিজ্ঞান সম্মত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। শ্রীমতী রীজ ডেভিডস ধৰ্ম্মসঙ্গনীর ইংরেজী ভাষান্তর করেছেন A Buddhist Manual of Psychological Ethics. প্রকৃতপক্ষে ধর্মসঙ্গনী অভিধর্ম পিটকের একটি সারগ্রন্থ বা manual

ধর্মসঙ্গনীর আলোচ্য বিষয়বস্তু :

ধর্মসঙ্গনীর  অভিধর্ম পিটকের সারাংশ বলা যায়। এতে অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের স্থূল ও সূক্ষ্ম যাবতীয় ব্যাপারকে চিত্ত, চৈতসিক ও জড় পদার্থের মাধ্যমে প্রকাশ করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। নাম - রূপকে কার্য-কারণ নীতি অনুসারে অকুশল কুশল এবং অব্যাকৃত এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়।

যথাঃ

১ চিত্ত ও চৈতসিকের পরিচয়, ২. রূপ বা জড় পদার্থের পরিচয়, ৩.পূর্বোক্ত বিষয়ের সংক্ষিপ্তসার বা নিক্ষেপ ।

ধর্ম্মসঙ্গনীতে চিত্ত ও চৈতসিকের পরিচয় দিতে গিয়ে প্রথমে কুশল চিত্তকে আলোচ্য বিষয় রূপে গ্রহণ করা হয়েছে। চার প্রকার ভূমি ভেদে কুশল চিত্তের সংখ্যা হল ২১টি। এই ২১ প্রকার কুশল চিত্ত চার ভাগে বিভক্ত। যথা- কামারচর, রূপাবার, অরূপারচর ও লোকোত্তর । বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার সম্প্রযুক্ত হয়ে সৌমনস্য, দৌর্মনস্য, উপেক্ষা সহগত, অসংষ্কারিক, সসংস্কারিক, জ্ঞান সম্প্রযুক্ত, জ্ঞান বিপ্রযুক্ত হয়ে নানা প্রকার হয়।

 

তারপর অকুশল চিত্ত বিভাগে ৮ টি লোভমূলক ২টি মোহ মূলক ও ২টি দ্বেষমূলক মোট ১২ টি অকুশল চিত্ত বর্ণিত হয়েছে। বিপাক চিত্ত বিভাগে ২৩টি কামাবচর, ৫টি রাপাবচর, ৪টি অরূপাবচর ও ৪ টি লোকোত্তর বিপাকচিত্ত বর্ণিত হয়েছে। ক্রিয়াচিত্ত বিভাগে কামারচর ১১ টি, রূপাবার ৫ টি ৩ অরাপাবচর ৪ টি মোট ২০ টি ক্রিয়াচিত্ত বর্ণিত হয়েছে। এভাবে চিত্তের সংখ্যা হল ৮৯টি। এই ৮৯ প্রকার চিত্তকে অন্যভাবে কামাবচর ৫৪ টি, রাপাবচর ১৫ টি, অরুপাবচার ১২টি ও লোকোত্তর ৪০ টি মোট ১২১ প্রকার ও বিভক্ত করা যায়।কামারচর, রাপারচর, অরূপাবার ও লোকোত্তর এ চার প্রকার চিত্তের মধ্যে কেবল প্রথম প্রকারের চিওগুলোকে সাধারণ চিত্ত বা কামাবচরী চিও বলা যায়। এদের প্রতিক্রিয়া কুশল অথবা অকুশল, ক্রিয়ান্বিত অথবা বিপাকী, সংস্কারিক অথবা অসংস্কারিক, সহেতুক অথবা অহেতুক এভাবে বিবিধ প্রকার হয়। কামভূমির ঊর্ধ্বে অবস্থিত রূপারচর ও অরাপারচর চিত্তসমূহ ধ্যানচিত্ত। এদের প্রতিক্রিয়া কুশলজনক । লোকোত্তর চিত্তসমূহ জাগতিক কুশলাকুশলের উর্ধ্বে অবস্থিত । এরা ক্রিয়ান্বিত ও ফলপ্রসূ হয়। কামারচর হতে অরূপাবার ভূমি পর্যন্ত চিত্তগুলো ভবাভিমুখী ও ভবাবলম্বী  এরা লৌকিক লোকোত্তর চিন্তগুলো নির্বাণাভিমুখী ও নির্বাণাবলম্বী।

চৈতসিক বিভাগে মোট ৫২ প্রকার চৈতসিকের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে চিত্ত বা মন সাধারণত ভাস্বর। চৈতসিক সহযোগেই এটি চৈতসিরের অবস্থা প্রাপ্ত হয়। যে সমস্ত ধর্ম চিত্তের সঙ্গে একসাথে উৎপন্ন ও নিরুদ্ধ চিত্ত হয় এবং একইরূপ আলম্বন ও বাস্তু গ্রহন করে, এমন চিত্ত যুক্ত ৫২ প্রকার চিত্ত বৃত্তির নামই চৈতসিক । চিত্ত চৈতসিক পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উৎপন্ন হতে পারে না।

 চৈতসিক বা চিত্তবৃত্তির সংখ্যা ৫২ হলে ও মূল চৈতসিক মাত্র সাতটি। যথা- স্পর্শ, বেদনা, সংজ্ঞা, চেতনা, একাগ্রতা, জীবিতেন্দ্রিয় ও মনস্কার । এ সাত প্রকার চৈতসিকের সম্মিলনেই চতুর্ভুমির চিত্তসমূহ গঠিত হয়। এগুলোকে "সর্বচিত সাধারণ চৈতসিক " বলা হয়।

এই সাতটি চৈতসিক ছাড়া ও ৪৫ প্রকার চৈতসিক আছে । এসব এবং সপ্ত সাধারণ চৈতসিক একত্রে চিত্তের সাথে যুক্ত হয়ে চতুভূমির চিত্তসমূহ উৎপন্ন করে। এ বায়ান্ন প্রকার চৈতসিক কোন প্রকার চিত্তের সাথে কিভাবে সম্প্রযুক্ত হয়ে কিরাপ অবস্থা প্রাপ্ত হয় প্রভৃতি নানা প্রকার বিষয়সমূহ ধৰ্ম্মসঙ্গনীতে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। রূপের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ধৰ্ম্মসঙ্গনীতে বলা হয়েছে, জীবদেহ, রূপ বলতে সাধারণতঃ জীবজগৎ, জড় জগৎ, মৃতদেহ এবং তৎসম্পর্কীয় যাবতীয় বিষয় ও বস্তু বুঝায়। পৃথিবী, অপ্, তেজ, বায়ু প্রভৃতি চারি মহাভূত, যারা আভিধার্মিক দৃষ্টিভঙ্গীতে কাঠিন্য ও ব্যাপকত্ব, তারল্য ও স্নেহত্ব, উষ্ণত্ত্ব ও গতি প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুনের দ্যোতক, এবং মহাভূত হতে উৎপন্ন চক্ষু, শ্রোত্রাদি পঞ্চ ইন্দ্রিয়, রূপ, শব্দাদি ইন্দ্রিয় উৎপন্ন বিষয়, স্ত্রী ইন্দ্রিয়, পুরুষ ইন্দ্রিয়, জীবিত ইন্দ্রিয়, কায়িক লঘুতা, কায়িক মৃদুতা, কায় বিজ্ঞপ্তি, বাক বিজ্ঞপ্তি প্রভৃতি গুণগুলো আলোচিত হয়েছে।

 

উপরোক্ত বিষয়গুলো আলোচনার পর ধম্মসঙ্গনীতে জীবজগতের শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, বিশ্বব্রহ্মান্তের সর্বনিম্নে কামলোক, তারপর রূপলোক, তার ঊর্ধ্বে অরূপ লোক। কামলোকের তিনটি স্তর। মথা নরক, মনুষ্যলোক ও দেবলোক। কামলোকের সর্বনিম্নে নিয়ে, মধ্যে মনুষ্যলোক এবং সর্ব উর্ধ্বে ছয়টি দেবলোক ।

নরক আবার চার ভাগে বিভক্ত। যথা-নিরয়, প্রেত, তির্যক ও অসুর। রূপলোকের ১৬টি স্তর এবং অরূপ লোকের ৪ টি স্তর। লোকোত্তর জগত তাদের সাথে সম্পর্ক বর্জিত । কারণ বিশ্বব্রহ্মান্ড সংস্কৃত এবং লোকোত্তর জগৎ অসংস্কৃত। সংস্কৃত বস্তুর ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু অসংস্কৃত লোকোত্তর জগত চিরস্থায়ী । এ জগতে একবার উৎপন্ন হতে পারলে তা থেকে পুনরায় পতনের কোন সম্ভাবনা নেই। এটাই বুদ্ধ প্রবর্তিত নির্বাণ। এই নির্বানের স্বরূপ উদ্‌ঘাটনই অভিধর্ম পিটকের প্রধান উদ্দেশ্য।

 

 মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে ধম্মসঙ্গনীর মূল্যায়নঃ-

অভিধর্ম পিটকের ধর্মসঙ্গনীর বিষয়বস্তু সমূহ পরমার্থ সম্পর্কীয় পরমাথ বচন। এতে বৌদ্ধ মননশীলতার চরম বিকাশ প্রতিফলিত হয়েছে। এই গ্রন্থের মূল আলোচ্য বিষয় বৌদ্ধ দর্শন ও পরমার্থ সত্য। পরমার্থ মাত্রই জটিল ও সাধনালভ্য। সংস্কার মন ও কঠোর সাধনা ব্যাতীত এটি হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন। শীলবান ব্যক্তি একনিষ্ঠ সাধনার দ্বারাই এতে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। এতে বলা হয়েছে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যাবতীয় রূপই জীবন্ত দেহ ও জড় পদার্থের বিবিধ প্রকার অভিব্যক্তি। মূলত কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের সাহায্যে বক্তব্য বিষয়ের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করাই ধম্মসঙ্গনীর প্রধান বিশেষত্ব, অতএব যে মনস্তত্ব বিশ্লেষণে ধম্মসঙ্গনীর সার্থক মূল্যায়ন হয়েছে ।


 মন্তব্যঃ-

পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্মসঙ্গনী গ্রন্থটি অভিধর্ম পিটকের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এতে সমস্ত বিষয়ের নীতিধর্মের দৃষ্টিভঙ্গীতে মনোবিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করা হয়েছে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!