বৌদ্ধ ধর্মের কর্মবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা : বৌদ্ধ ধর্মের কর্মবাদ

কর্ম বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বলা হয় কর্মের শক্তি বিশ্বব্যাপী। বৌদ্ধধর্মের মূল ভিত্তিই হলো 'কর্মবাদ'। মানুষ নিজ নিজ কর্ম অনুসারে কর্মফল ভোগ করে। ভালো কাজ করলে ভালো ফল এবং মন্দ কাজ করলে মন্দ ফল তাকে ভোগ করতে হবেই। শুধু নয় জীবমাত্রই কর্মের অধীন ।



কর্ম শব্দের ধারণা : 

'কর্ম' বলতে কোনো অনুষ্ঠান করা, কোনো কাজ করা ইত্যাদি বোঝায়। বৌদ্ধধর্মে কর্মকে শুভ-অশুভ, কুশল-অকুশল ইচ্ছা বা প্রবৃত্তিকে কর্ম বলে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ যা চিন্তা করা যায়, বাক্যে উচ্চোরণ করা যায় এবং দেহের দ্বারা সম্পাদন করা যায় তাই কর্ম। কায়-বাক্য ও মন এই ত্রিদ্বারে কর্ম সংঘটিত হয়। চিন্তন, কখন এবং করণ (দৈহিক) সমস্তই কর্মের অধীন। মনের চেতনাহীন ক্রিয়াকে কর্ম বলা হয় না। ‘অঙ্গুত্তর নিকায়' নামক গ্রন্থে বুদ্ধ বলেছেন- 'চেতনাহং ভিক্‌খবে কৰ্ম্মং বদামি। চেতয়িত্বা করোতি কায়েন, বাচায় মনসা'পি। অর্থাৎ হে ভিক্ষুগণ! চেতনাকেই (ইচ্ছাশক্তিকে) আমি কর্ম বলি। কারণ চেতনার দ্বারা কায়-বাক্য মনের দ্বারা কর্ম সম্পাদন করে।

কর্মের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে মন বা চিত্ত। চেতনা মনের সহজাত প্রবৃত্তি বিশেষ। চিত্ত থেকে উৎপন্ন উপলব্ধিই চেতনা । একটি ক্ষণের একটি চেতনা সুখ-দুঃখ প্রদান করতে ক্ষম। কায়, কর্ম ও বাক্য কর্ম সমস্তই মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বৌদ্ধধর্ম মতে, নিজ নিজ কর্মের ফল সাবইকে ভোগ করতে হবে। প্রত্যেক কর্মের ফল আছে। গাছের ফলে মতো কর্মফল মানুষের কর্মকে অনুরণ করে। কর্ম যদি ভালো বা মজা হয় তবে ফলও ভালো বা মন্দ হবে।


কর্মে প্রকারভেদ: 

কর্মকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। তা নিচে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হল।

ক. অকুশল কর্ম দশ প্রকার। যথা-

১) প্রাণীহত্যা, ২) চুরি, ৩) অবৈধ মিথ্যাকামাচা বা ব্যাভিচার, ৪) মিথ্যাবাক্য, ৫) পিশুন বা ভেদ থাকা, ৬) পরুষ বা কর্কশ বাক্য, ৭) সম্প্রলাপ বা বৃথা বাক্য, ৮) অভিখ্যা বা লোভ, ৯) ব্যাপাদ বা হিংসা ও ১০) মিথ্যাদৃষ্টি।

খ.দশ প্রকার কুশল কর্ম প্রকার। যথা-

১) দান, ২) শীল, ৩) ভাবনা, ৪) গুরুজনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, ৫) মাতাপিতার সেবা, ৬) পুণ্যদান, ৭) পুণ্যঅনুমোদন, ৮) ধর্ম কর্ম, ৯) ধর্ম দেশনা ও ১০। দৃষ্টিঝজু কর্ম।

১। ইহজন্মে ফল প্রদান অনুসারে কর্ম চার প্রকার। যেমন: ক) দৃষ্টধর্ম বেদনীয় কর্ম, খ) উপপদ্য বেদনীয় কর্ম, গ) অপর পর্যায় বেদনীয় কর্ম এবং ঘ) ভূতপূর্ব বেদনীয় কর্ম।

ক) দৃষ্টধর্ম বেদনীয় কর্ম : যে কর্ম ইহজীবনে ফল প্রদান করতে সক্ষম তাকে বলা হয় দৃষ্টধর্ম বেদনীয় কর্ম।

খ) উপপদ্য বেদনীয় কর্ম : যে কর্ম পরবর্তী জীবনে ফল প্রদান করে তাকে উপপদ্য বেদনীয় কর্ম বলা হয় ।

গ) অপর পর্যায় বেদনীয় কর্ম : এই কর্ম পরবর্তী দ্বিতীয় জন্ম থেকে নির্বাণ লাভ না করা পর্যন্ত যে কোনো জন্মে ফল প্রদানকারী কর্ম। অর্থাৎ যে কর্মের ফল অবশ্যই, তাই অপর পর্যায় বেদনীয় কর্ম। এটা সুযোগ ফেলে ফল প্রদান করবেই।

ঘ) আহোসি বা ভূতপূর্ব বেদনীয় কর্ম : যে কর্মের ফলপ্রদান শক্তি এক সময় ছিল কিন্তু এখন আর নেই তাকে ভূতপূর্ব কর্ম বলা হয় । এটা নিজ দুৰ্বলতা হেতু ফলপ্রদানে সক্ষম নয়।

২। কৃত্য বা কাজ অনুসারে কর্ম চার প্রকার। যেমন-ক) জনক কর্ম, খ) উপত্তন্তক কর্ম কর্ম, গ) উৎপীড়ক বা উপপীড়ক কর্ম এবং ঘ) উপঘাতক কর্ম।

ত) জনক কর্ম : যে কর্ম পুনর্জন্ম ঘটায়, জীবিতকালে যে কর্ম কর ও কর্মজরূপ উৎপাদক এবং কুশল-অকুশল চেতনামূলক তাই জনক কর্ম। জনক কর্ম অতীত কর্মেরই ফল ।

উপযুস্তক কর্ম : যে কর্ম জনক কর্মকে সাহায্য করে তাই উপতত্ত্বক কর্ম। উপতন্তক কর্ম জনক কর্মকে ফল, প্রদানে সাহায্য করে। জনক কর্মের প্রভাবে কর্মের জন্ম হয় আর বেঁচে থাকা হয় উপশুম্ভক কর্মের প্রভাবে।

গ) উৎপীড়ক বা উপপীড়ক কর্ম : এই জাতীয় কর্ম জনক কর্ম বা উপস্তর কর্মের বিপাককে দুর্বল করে কিংবা বাঁধা দেয়া। কুশল উৎপীড়ক কর্ম অনুশল উপস্তম্ভক কর্মকে, অকুশল উৎপীড়ক কর্ম কুশল উপস্তম্ভক কর্মকে বাঁধা দেয় এবং দুর্বল করে।

ঘ) উপঘাতক কর্ম: এ ধরণের কর্মের কাজ হলো বাঁধা দেওয়া। এ রকম শুধু বাধা দেয় না জনক কর্মকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নিজের আধিক্য বিস্তার করে। ফল উৎপন্ন করাই হলো এর কাজ।

৩। জন্মক্ষণে বিপাক দান বা ফল প্রদান অনুসারে চার প্রকার। যেমন- ক) শুরুকর্ম, খ) আসন্ন কর্ম, গ) আচারিত কর্ম এবং ঘ) উপচিত কর্ম ।

ক) গুরুকর্ম: যে কর্ম নব জন্মক্ষণে সর্বপ্রথম ফল প্রদান করে তাকে গুরুকর্ম বলা হয়।

খ) আসন্ন কর্ম : আসন্ন কর্মকে মরণাসন্ন কর্মও বলা হয়। গুরু কর্ম সম্পাদিত না থাকলে মৃত্যুর পূর্বকালে সম্পাদিত কর্মই যত প্রদান করে। অর্থাৎ আসন্ন কর্ম জনককর্ম হয়। এ সময় কল্যাণ মিত্রের উচিত মৃত্যু মুখে পতিত ব্যক্তিকে কুশল বিষয় স্মরণ করানো।

গ) আচারিত কর্ম : গুরুকর্মও আসন্ন কর্মের অভাবে মরণোন্মুখ ব্যক্তির নিকট আচরিত কর্ম উপস্থিত হয়। তা জননকাজ পরিণত হয়। জীবনে বহুবার সম্পাদিত কর্মই আচরিত কর্ম।

ঘ) উপচিত কর্ম: উপরি-উক্ত তিন প্রকার কর্মের স্মৃতি যদি মৃত্যু সময় উপস্থিত না হয়, তবে এই জন্যে বা পূর্বজন্মকৃত কর্মের স্মৃতির চিন্ত পথে উপস্থিত হয়ে জনক কর্মরূপ পরিণত হয়।

৪। ফল প্রদানে স্থান হিসেবে কর্ম চার প্রকার। যথা: ক) অকুশল কর্ম খ) কামানচর ফল প্রদানকারী কশলকর্ম গ)রূপাবচর ফলপ্রদানকারী কুশলকর্ম এবং ঘ) অরূপাবচর ফলপ্রদানকারী কুশলকর্ম

ক) অকুশল কর্ম : যে পাপকর্ম প্রাণীগণকে মৃত্যুর পর চার প্রকার কাম দুর্গতিতে (অসুর, প্রেত, তির্যক  এবং নিরয়) নিক্ষেপ করে সে সব কর্মকে অকুশল কর্ম বলা হয়।

খ) কামারচর ফল প্রদানকারী কশলকর্ম : মৃত্যুর পর যে কর্মের প্রভাবে জীবগণ কাম সুগতি ভূমিতে (ছায় স্বর্গ ও মনুষ্য), জন্ম গ্রহণ করতে পারে সে সব কুশল ফল প্রদানকারী কর্মকে কামাবচর ফল প্রদানকারী কুশল কর্ম বলা

গ) কামাবচর ফল প্রদানকারী কশলকর্ম : মৃত্যুর পর যে সব কর্ম জীবগণকে রূপলোকের ষোলটি ভূমিতে জন্য ধারণের ফল প্রদান করতে সক্ষম থাকেই কামাবচর ফল প্রদানকারী কুশল কর্ম বলা হয়।

খ) অরূপাবচর ফল প্রদানকারী কশলকর্ম: যে সব সৎ কর্ম বা কুশলকর্ম অরূপলোকের চারটি ভূমিতে প্রার্থীগণকে জস্মগ্রহণ করতে ফল প্রদানে সক্ষম এগুলোই অরুপাবচর ফল প্রদানকারী কশলকর্ম নামে পরিচিতি।

৩ কর্মবাদের ধারণা : 'কর্মী ও বাদ' দুটি অর্থবোধক শব্দের সমন্বয়ে ’কর্মবাদ' গঠিত হয়েছে। 'কর্ম' বলতে কায়, বাক্য ও মনে সম্পাদিত কাজ বা ক্রিয়াকে বোঝায়। 'ফাল বলতে তত্ত্ব  বা ধারণার গভীর বিশ্বাসকে বোঝানো হয়।

আয়ু-বর্ণে, ভোগ-ঐশ্বর্য এবং জ্ঞান-গরিমায় মানুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তার অন্যতম কারণ কর্ম। জীব মাত্রই নিজ নিজ কর্মে । কর্ম প্রনীদের হীন-উত্তম বা উঁচু-নিচু বিভিন্ন ভাবে বিভক্ত করে। পৃথিবীতে সকল মানুষের আচার-আচরণ যেমন এক রকম নয় তেমনি আবার স্বভাব-চরিত্র একই রকম নয়। 'মিলিল প্রশ্ন' নামক গ্রন্থে ভিক্ষু নাগসেন ও গ্রীকরাজ মিলিন্দের কথোপকথনে নাগসেন স্থবির বলেছিলেন-'সকল মানুষ এক রকম না হওয়ার কারণ হলো তাদের কৃতকর্ম। বিভিন্ন মানুষের কর্মফলে পার্থক্য আছে বলেই মানুষের মধ্যে নানারকম পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।' তিনি আরো বলেন-'সকল বৃক্ষের ফল সমান হয় না। কিছু টক কিছু লবণাক্ত, কিছু মধুর রসযুক্ত। এগুলো বীজের নানাত্ব কারণেই হয়। এভাবে কর্মের নানাত্ব হেতু সকল মানুষ সমান হয় না। কারণ প্রাণী মাত্রই কর্মের অধীন। এ রকম ভিন্নতার অন্যতম কারণ হলো কর্ম।

 

কর্মই প্রাণীকে নানাভাবে বিভাজন করে। জীবের সুখ এবং দুঃখের দাতা কেই নয়। এগুলো কর্মেরই প্রতিক্রিয়া বুদ্ধ সুত্তনিপাত নামক গ্রন্থে বলেন-

"ন জচ্চা ব্ৰহ্মণো হোতি, ন জা হোতি অব্ৰহ্মণো

কমুনা ব্রাহ্মণো হোতি কমুনা হোতি অব্ৰহ্মণো।”

অর্থাৎ জন্ম দ্বারা কেউ শ্রেষ্ঠ হয় না, জন্ম দ্বারা কেউ দুর্বল হয় না, কর্ম দ্বারা ব্রহ্মণ হয় এবং কর্ম দ্বারা অব্রহ্মণ হয় ।


কর্মফলের ব্যাখ্যা : 

কর্মবাদ অনুসারে প্রত্যেক মানুষকে তার নিজ নিজ কৃত কর্মের ফল ভোগ করতে হয়। যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন কর্মফল ভোগ করবে। কর্ম যদি ভালো-মন্দ হয় তবে ফলও ভালো-মন্দ হবে। আপনি যেমন বীজ রোপন করবেন, তেমন ফসল পাবেন। কেউ যদি ধানের বীজ রোপন করে তবে সে ধান পাবে, গম পাবে না। আর যদি কেউ খারাপ ধানের বীজ বপন করে তবে খারাপ ধান পাব, ভালো  ধান পাবে না। পৃথিবীর সর্বত্রেই একই নিয়ম প্রযোজ্য। আমি তোমাকে মুক্ত করবো এ কথা বুদ্ধ কোথাও বলেননি। বর্তমান মুহূর্তের কর্ম পরবর্তী মুহূর্তে ফল প্রদান করে। এটাই পৃথিবীতে প্রাকৃতিক নিয়ম মানুষ নিজ নিজ ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।

আত্মনির্ভরশীল না হলে কারো পক্ষে কোনো প্রকার কাজে সফলতা আসে না। তাই আত্মপ্রতিষ্ঠাই হলো সর্ববিধ মহৎ কাজের ভিত্তিস্বরূপ। মানুষ তার ভালো-মন্দ কর্মের ফলস্বরূপ সুখ-দুঃখ ভোগ করে। কর্ম ফল দেয়, ফল কারণ নির্দেশ করে। বীজ ফল প্রদান করে এবং ফল বীজের বর্ণনা করে। এখানে বীজ এবং ফল উভয়েরই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সেরূপ কর্ম ও কর্মফল পরস্পর নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। ফল পূর্ব থেকে কর্মের মধ্যে অঙ্কুররূপে বিদ্যমান থাকে। 'সঙ্গীতি সূত্র' কর্মের ফল বিবেচনায় কর্মের বিধানকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে।

যেমন-

ক) অকুশল বা দুঃখদায়ী পাপকর্ম : এগুলো হচ্ছে লোড-দেষ-মোহাচ্ছন্ন চিত্তে সম্পাদিত কর্ম।

খ) কুশল বা সুখদায়ী পুণ্যকর্ম : শীল পালন, দানানুশীলন, পরোপকার সাধন প্রভৃতি সৎকর্ম কুশল বা সুখদায়ী। পুণ্যকর্ম সুখময় ফলদায়ক।

গ) কুশলাকুশল ফলদায়ী পাপ-পুণ্যকর্ম : কুশলাকুশল বিমিশ্রিত চিত্তে সম্পাদিত কর্ম পাপ পুণ্যময় হয় এবং তার ফল সুখ দুঃখময় হয়। এ রকম কর্মের একটি উদাহরণ নিচে প্রদান করা হলো- কোনো এক ব্যক্তি চুরি, শঠতা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি উপায়ে অর্থ উপার্জন করে। কোনো ব্যক্তি তার কাছ থেকে অর্থ চাইলে সে মুক্ত হস্তে দান করে। দুঃখীর দুঃখ মোচনে সে সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ফল লাভের ক্ষেত্রে সে তার বদান্যতা, উদারতা ও পরের উপকার করার ফলস্বরূপ পরবর্তী জন্মে বিত্তশালী হয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। তবে চুরি, শঠতা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি অপকর্মের জন্য মিথ্যা অপবাদের ভাগী হতে পারে। বিপুল অর্থ থাকা সত্ত্বেও ভোগে বঞ্চিত হতে পারে। দৈহিক ও মানসিক নানাকষ্টের মধ্য দিয়ে তার জীবনের অবসান হয়।

ঘ) সব রকম কর্মক্ষয়কর যার মুক্তি লাভ সম্ভব : মানুষ যখন লোভ-শেষ-মোহে আকৃষ্ট হয়, তখন তার মধ্যে নানারকম কামনা-বাসনা উৎপন্ন হয়। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ত্বক ও মনকে সংযত করার মাধ্যমে এগুলোকে দমন করা সম্ভব। তাঁর জন্য দরকার একাগ্র সাধনা, যার মধ্য দিয়ে পরম মুক্তি লাভ সম্ভব ।


কর্ম ও কর্মফল কোথায় থাকে : 

রাজা মিলিন্দ ভদন্ত নাগসেনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ ভিত্তে, কর্ম কোথায় থাকে?' ভদন্ত নাগসেনের উত্তরঃ ‘মহারাজ, এই ক্ষণপরিবর্তনশীল নামরূপের (Mind and body) মধ্যে কর্ম কোথাও সঞ্চিত থাকে না। কিন্তু নাম রূপকে ভিত্তি করে এটি প্রবর্তিত হয় এবং উপযুক্ত মুহূর্ত আসলে ফল প্রসব করে, যেমন আমল আমগাছের কোথাও লুকিয়ে থাকে না, তবে আমগাছকেই ভিত্তি করে এটি অবস্থিতি এবং যথাকালে ফলাকারে উৎপন্ন হয়।

বায়ু বা তেজ যেমন কোন স্থানে লুকিয়ে থাকে না, কার্য-কারণের শৃঙ্খলার দ্বারা এদের অনুভব করা যায়, তদ্রূপ কর্ম এই নামরূপ সমন্বিত কায়ের ভেতরে বা বাইরে কোথাও অবস্থান করে না।

কর্ম হচ্ছে একটি স্বকীয় শক্তি। এক জন্ম হাতে অন্য জন্মে এটি সংক্রামিত হয়। এটি জন্ম-জন্মান্তরে ব্যক্তির স্বভাবে। প্রভাবিত করে। এর ফলে আমরা অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন শিশুকে দেখতে পাই যমজ সন্তানের দুইজনের মধ্যে দুই রকম স্বভাব ও প্রতিভা লক্ষ্য করি। একই পিতামাতার সন্তান হলেও সেই সন্তানদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার গুণাবলী। ও স্বভাব-চরিত্র দেখতে বই। ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত ও জাগতিক কল্যাণের জন্য এই কর্মতত্ত্ব সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।

বিশ্বে বিদ্যমান এই পঞ্চ নিয়মের মধ্যে কর্ম নিয়ম একটি মাত্র। এই নিয়ম স্বয়ংসট। এই নিয়মে কর্তার প্রয়োজন। নেই। যেমন প্রাকৃতিক নিয়ম, মাধ্যাকর্ষণের নিয়মে কর্তা নিষ্প্রয়োজন। বাহ্যিক স্বাধীন শাসকের বা কর্তার হস্তক্ষেপ ব্যতীত এটি আপন ক্ষেত্রে কাজ করে যেতে পারে। যেমন কোন ব্যক্তিই আগুনকে দাহ করতে আদেশ দেয়নি, পানিকে তার সমতার অনুসন্ধান করতে বলেনি, বাতাসকে কেউ প্রবাহিত হতে বলেনি- এইগুলি সব মহাধাতুর অন্তর্নিহিত গুণ। অরুপ, কর্ম অদৃষ্ট যেমন নয়, তেমন পূর্ব নির্ধারিত বিধানও নয় যার নিকট আমাদের অসহায়ভাবে সমর্পন করতে হবে। মানুষ তার ভাল-মন্দ কর্মের ফলস্বরূপ স্বাভাবিকভাবেই সুখ-দুঃক ভোগ করে থাকে। উপযুক্ত ফল প্রসবই কর্মের অন্তর্নিহিত শক্তি। কর্ম ফল দেয়, ফল কারণ নির্দেশ করে। বীজ ফল প্রদান করে এবং ফল বীজের বর্ণনা করে, উভয়েই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সেইরূপ কর্ম ও কর্মফল পরস্পর সম্পর্ক জড়িত। ফলই পূর্ব হতে কর্মের মধ্যে অস্কুররূপে বর্তমান থাকে।

সব কিছু কর্ম নিয়ন্ত্রিত নয় : 

যদিও বৌদ্ধধর্ম সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, কর্মই তাদের মধ্যে বিবিধ বৈষম্যের কারণ তবু যুদ্ধ এটাও স্বীকার করেনি যে সবকিছুই কৰ্মনিয়ন্ত্রিত। 'আমরা যা কিছু সূখ-দুঃখ বা অদুঃম-অসুখ অনুভূতির হই তার পেছনে শুধু কর্মের ফল - এই ধারণার বিরুদ্ধে বুদ্ধ বনেছেন সে যদি পূর্ণতাই মানুষের সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রিত করে তাহালে পূর্বকর্ম বশতঃ মনুষ এই জন্যে কর্ম করতে হতো না। একজন মন্দ লোক সবর্না মন্দ থাকত, কেননা তার কর্মই তাকে মন্দ করেছে। রোগমুক্ত হবার জন্য মুখদাধর্মী বা জর্মন থাকলে ডাক্তার নিকট যেতে হতো না, এমনিতে সুস্থ হতো। যদি পূর্বকর্মই সমস্ত নিয়ন্ত্রণ করতো তাহলে মানুষ নিয়তি বা কর্মের উপর নির্ভরশীল হতো। ব্যক্তি তার বর্তমান ও ভবিষ্যতকে শুদ্ধ করতে প্রয়াসী হবে না। তাহলে স্বাধীন ইচ্ছা বলতে কিছুই থাকত না। বুদ্ধের মতে জড় ও চেতন রাজ্যে পাঁচটি নিয়ম আছে। যেমন-

১। ঋতু নিয়ম : যেমন সময়োপযোগী বৃষ্টি হওয়া, বাতাস প্রবাহিত হওয়া ইত্যাদি।

২। কর্ম নিয়ম : কর্ম ও কর্মফলের নিয়ম, যেমন ডাল ও মন্দ কর্ম ভাল ও মন্দ ফল প্রদান করে।

৩। বীজ নিয়ম : অঙ্কুর বা বীজের নিয়ম, যেমন ধানের বীজ হতে ধান জন্মায়, ইক্ষু হতে চিনির স্বাদ পাওয়া যায়, মধু হতে মধুর স্বাদ পাওয়া যায় ইত্যাদি। সৃষ্টি তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এই প্রণালীতে করা যেতে পারে।

৪। চিত্ত নিয়ম : মানসিক নিয়ম। যেমন- চিত্তের গতি প্রণালী এবং মনের শক্তি, প্রায় অসম্ভব কাজকেও সাফল্য হওয়া ইত্যাদি।

৫। ধর্ম নিয়ম : স্বাভাবিক নিয়ম। যেমন বোধিসত্ত্বের শেষ জানো সংঘটিত ঘটনা এবং মধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রভৃতি। এই সর্বাত্মক পঞ্চ নিয়মের দ্বারা জড়-চেতন প্রত্যেক পদার্থের ব্যাখ্যা করা যায়।

বিশ্বে বিদ্যমান এই পঞ্চ নিয়মের মধ্যে কর্ম নিয়ম একটি যাত্র। এই নিয়ম স্বয়ংসৃষ্ট। এই নিয়মে কর্তার প্রয়োজন নেই। যেমন- প্রাকৃতিক নিয়ম, মাধ্যাকর্ষণের নিয়মে কর্তা নিষ্প্রয়োজন। বাহ্যিক স্বাধীন শাসকের বা কর্তার হস্তক্ষেপ ব্যতীত এটি আপন ক্ষেত্রে কাজ করে যেতে পারে। যেমন- কোন ব্যক্তিই আগুনকে জ্বলতে বলেননি, পানিকে তার সমতার অনুসন্ধান করতে বলেনি, বাতাসকে কেউ প্রবাহিত হতে বলেনি- এইগুলি সব মহাধাতুর অন্তর্নিহিত গুণ। তদ্রুপ, কর্ম অদৃষ্ট যেমন নয়, তেমন পূর্ব নির্ধারিত বিধানও নয় যার নিকট আমাদের অসহায়ভাবে সমর্পন করতে হবে। মানুষ তার ভাল-মন্দ কর্মের ফলস্বরূপ স্বাভাবিকভাবেই সুখ-দুঃখ ভোগ করে থাকে। উপযুক্ত ফল প্রসবই কর্মের অন্তর্নিহিত শক্তি। কর্ম ফল দেয়, ফল কারণ নির্দেশ করে। বীজ প্রদান করে এবং ফল বীজের বর্ণনা করে, উভয়েই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সেইরূপ কর্ম ও কর্মফল পাম্পের সম্পর্ক জড়িত। ফলই পূর্ব হতে কর্মের মধ্যে অঙ্কুররূপে বর্তমান থাকে।

কর্মবাদের গুরুত্ব : 

কর্মবাদ বৌদ্ধধর্মে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বুদ্ধের কর্মবাদ অনুসারে চিত্ত বা চেতনাই হলো কুশলকর্ম এবং অকুশল কর্মের উৎপত্তিস্থল। এই কর্মবাদ অনুসারে খারাপ চিন্তা করাও পাপ। কুশল চেতনার মাধ্যমে কুশলকর্ম সম্পাদিত হয়। কার্যকারণনীতির প্রক্রিয়ার দ্বারা গত জীবনের কর্মফলে বর্তমান জীবন, বর্তমান জীবনের কর্মফল ভবিষ্যৎ জীবন গঠন করে। স্বর্গ হতে নিম্নতর নরক পর্যন্ত সমস্ত জীব কর্মসূত্রে প্রথিত। সকলেই কর্মের একই নিয়মে নিয়ন্ত্রিত। কোনো কর্ম একবার সম্পাদন ক্যালে অনন্তকাল পর্যন্ত তার ফল প্রদান করতে থাকে। এভাবে কর্মের ফল অথবন অখন্ডনীয়। সবাইকে তা ভোগ করতে হবে। ধর্মপদের এ বিষয় বলা হয়েছে,- মন সকল কাজের মধ্যে অগ্রগামী। সব ধর্ম নিয়ম) মনের উপর প্রতিষ্ঠিত।  প্রসন্ন মনে কেউ যদি কোনো রকম কাজ সম্পাদন করে তাহলে সুখ তাকে ছায়ার মতো অনুসরন করে।

কর্মের মাধ্যম তিনটি। যথা- কায়, থাকা এবং মনো। প্রতিনিয়ত এই তিনটি মাধ্যম দিয়ে কর্ম সম্পাদিত হয়। কোনো কোনো কর্মে তিনটি মাধ্যমই এক সঙ্গে থাকে। কোনো কাজে দুটো এবং কোনো কোনো কাজ দেখল একটি মাধ্যম দিয়েই সম্পাদিত হয়। তিন মাধ্যমে আমরা যে সব কাজ করছি, তার কোনোটি সৎ, কোনোটি অসৎ আবার কোনোটি নিরপেক্ষ। কোনো কর্ম সৎ নাকি অসৎ তার বিচার করা হয় কর্মকলের দ্বারা। যে কর্মের ফল কর্তার নিজের ও নিজের পারিপার্শ্বিক জীবজগতের পক্ষে কল্যাণময় ও সুখপ্রদায়ী তাকে বলা হয় সৎ কর্ম। যা কর্তার নিজের পারিপার্শ্বিক জীবজগতের অকল্যাণকর বা দুঃখ আনয়ন করে তাই অসৎ কর্ম। যে কর্ম সম্পাদন হলেও ফলপ্রসূ হয় না তাই নিরপেক্ষ কর্ম।

কর্ম দ্বারা সমাজে মানুষের অবস্থান সুদৃঢ় হয় কিংবা প্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব, জন্ম দিয়ে নয়। সুন্দরভাবে প্রতিদিনের কর্ম সম্পাদন করলে জীবন সুখময় হয়। তবে সম্পাদিত কৰ্মে মধ্যে কুশল চেতনা থাকা দরকার। এভাবে কাজ করলে ভালো ফলাফল অবশ্যম্ভাবী। সেজন্য বৌদ্ধধর্মে কর্মবাদের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কর্মের মাধ্যমেই একজন মানুষ তার নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করতে পারে। কর্মই মানুষকে উচ্চ আসনে আসীন করে। কর্মের সুফল সর্বদিকেই প্রবাহিত হয়। কর্মই মানুষের চালিকাশক্তি। মানুষ নিজেই নিজের কর্মফল বহন করে। পশ্চাতে ফেলে আসে না। বৌদ্ধ কর্মবাদ অনুসারে, প্রাণী হত্যা না করা, চুরি না করা, ব্যভিচারে লিপ্ত না হওয়া, মিথ্যা কথা না বলা, মাদক জাতীয় সেবন না করাসহ বৃথা বাক্য না বলা, কর্কশ বাক্য না বলা-এর বিধান রয়েছে। সুন্দরভাবে জীবিকা অবলম্বনের অন্যায় ও অসমাজিক সকল প্রকার কাজ করা উচিত নয়। কেননা, নিন্দিত বা খারাপ কাজ যারা করে তাদেরকে সমাজে সবাই অবজ্ঞা করে। ঘৃণার চোখে দেখে। সুতরাং বুদ্ধের কর্মবাদ মনে রেখে কল্যাণনয় কর্ম উচিত। শুভ বা কুশলকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে যে ফল অর্জিত হয় তা কখনো পুণ্যের পথ ধ্বংস করতে পারে না। এমন কর্ম সম্পাদন করতে হবে যার মাধ্যমে পরিবার, সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্রের সুনাম বৃদ্ধি পায়।

 

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!