বৌদ্ধদর্শনে যোগাচার সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব আলোচনা কর ৷

admin

ভূমিকা : বৌদ্ধদর্শনে যোগাচার সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব 

বৌদ্ধদর্শনের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের দুঃখের বিনাশ তথা নির্বাণের পথ নির্দেশ করা। বুদ্ধত্ব লাভের বুদ্ধদেব তাঁর ধ্যানলব্ধ জ্ঞান চারদিকে প্রচার করতে মনস্থ করেন এবং প্রাচীন ভারতে ধর্মগুরুদের ন্যায় কথোপকথনের মাধ্যমে দুঃখ জর্জরিত জনগণকে তাঁর উপদেশাবলি শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন। কালক্রমে বৌদ্ধদর্শন সিংহল, ব্রহ্মদেশ, শ্যাম, তিব্বত, কোরিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে বিস্তার লাভ করে। বুদ্ধদেবের উপদেশাবলি প্রথমে মুখে মুখে প্রচারিত হলেও পরে তাঁর তিনজন প্রিয় শিষ্য তার উপদেশাবলিকে তিনটি গ্রন্থে পালিভাষায় লিপিবদ্ধ করেন।


বৌদ্ধদর্শনে যোগাচার সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব আলোচনা কর ৷

যোগাচার সম্প্রদায় :

যোগাচার সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হলেন অসঙ্গের গুরুদেব মৈত্রেয়নাথ । অসঙ্গ, বসুবন্ধু, দিগ্‌নাগ প্রমুখ হলেন যোগাচার দর্শনের প্রসিদ্ধ দার্শনিক। যোগাচার দার্শনিকগণ মহাযান ধর্ম সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, ‘যোগাচার মতাবলম্বী দার্শনিকগণ যোগ এবং সদাচারের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করা যায়'-এ মত পোষণ করে বলে এ মতবাদকে যোগাচারবাদ বলা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন, যোগাচার সম্প্রদায়ভুক্ত দার্শনিকগণ বাহ্যবস্তুর অসত্যতাকে উপলব্ধি করার জন্য যোগাভ্যাস করতেন বলে তাঁদের দর্শনের নাম যোগাচার দর্শন ।


যোগাচার সম্প্রদায়ের বিজ্ঞানবাদ :

যোগাচার দর্শনকে বিজ্ঞানবাদও বলা হয়। S. Chatterjee and D. Datta তাঁদের 'An Introduction to Indian Philosophy' গ্রন্থে বলেন, "The Yogācāra view is called Vijnana- vāda because it admits vijnāna or consciousness as the only reality." (Page-149) যোগাচার বিজ্ঞানবাদ অনুসারে বিজ্ঞান বা চেতনাই একমাত্র সৎ বস্তু। 'বিজ্ঞান' শব্দটি অর্থ হলো ‘বিশেষ জ্ঞান'। কিন্তু ভারতীয় দর্শনে 'বিজ্ঞান' শব্দটি সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে চেতনা অর্থে ব্যবহৃত হয়। লঙ্কাবতারসূত্র এ দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। কমলশীল-এর ভাষ্যসহ শান্ত রক্ষিত-এর তত্ত্বসংগ্রহ যোগাচার দর্শনের আর একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ। যোগাচার বিজ্ঞানবাদ চেতনাকে সত্য বলে জানে । জ্ঞান নির্বস্তুক এবং নিরালম্ব । বাহ্যবস্তুর সত্তা চেতনায় । প্রত্যক্ষের বাইরে বস্তুর কোন সত্তা নেই। জ্ঞান-ই জ্ঞেয় । অন্তজ্ঞেয় জ্ঞানই বাইরের বস্তুর আকারে প্রতিভাত হয়। এই যে সম্মুখে একটি ফুল গাছ আছে, অনাদি সংস্কারবশত এটির একটি আকার চেতনায় বর্তমান আছে । নীল, পীত প্রভৃতি ধারণা চেতনার স্বগত বাসনা বা আকার বিশেষ ।


মনের অস্তিত্ব : মাধ্যমিকদের মতো যোগাচারগণও বাহ্যবস্তুকে 'অসৎ' বলেন। কিন্তু মন সম্পর্কে যোগাচারগণ মাধ্যমিকদের সঙ্গে একমত হতে পারেন নি। যোগাচারদের মতে, 'মন' সৎ বস্তু। তাঁরা বলেন, মাধ্যমিকদের মতো মনের সত্তা অস্বীকার করলে যুক্তি, চিন্তা ও বিচার সবই মিথ্যা হয়। কারণ মন না থাকলে এসবের একটিও সম্ভব নয়। এখন 'যুক্তি' যদি মিথ্যা হয় তবে মাধ্যমিকদের নিজেদের মতবাদের সমর্থনে যেসব যুক্তি তাঁরা দিয়েছেন সেসবই মিথ্যা হয় এবং তাঁদের দর্শন আর প্রতিষ্ঠিত হয় না। সুতরাং মনের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হবে।


যোগাচারগণ মনকে ‘আলয় বিজ্ঞান' নাম দিয়েছেন। যেহেতু মন সব সংস্কারের আঁধার সেহেতু ‘আলয় বিজ্ঞান' অন্যান্য দর্শনের আত্মারই সমতুল্য। আত্মা নিত্য কিন্তু ‘আলয় বিজ্ঞান' নিয়ত পরিবর্তনশীল মানসিক অবস্থার প্রবাহ মাত্র। যোগাচারগণ বলেন, এ মন যদি সংযম ও সাধনার দ্বারা কামনাবাসনা ত্যাগ করতে পারে তবে তা নির্বাণে পরিণত হয়। অন্যথায় এ কামনবাসনা দ্বারা এ মন জীবকে কাল্পনিক বাহ্যজগতের বন্ধনে আবদ্ধ করে। এজন্যই যোগাচারগণ বলেন, মনেই কামনা-বাসনার জন্ম এবং মনেই তাদের লয়, মন স্বর্গগামীও হতে পারে অথবা নরকগামীও হতে পারে ।


মনই একমাত্র সৎ বস্তু : যোগাচারগণ বলেন, চিত্ত বা মনই একমাত্র সৎ বস্তু। বাহ্যবস্তু বলে কোনকিছুরই সত্তা নেই। তাঁদের মতে চিত্ত বা মন বলতে চিন্তা, ধারণা ও অনুভূতির প্রবাহকেই বুঝায়। তাঁরা বলেন, চেতনার বহির্ভূত বাহ্যবস্তু মনের ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনকি মানুষের দেহও তার চিত্ত বা মনের ধারণা মাত্র। স্বপ্নে বা চিত্তের বিকার অবস্থায় মানুষ যেমন অবস্তুকে অস্তিত্বশীল বাহ্যবস্তু বলে ভুল করে, তেমনি সুস্থ অবস্থায় মানুষ মনের ধারণাকে বাহ্যবস্তু বলে দর্শন করে।


আসলে বাহ্যবস্তু বলে কিছুই নেই এবং এর অস্তিত্বের কোন প্রমাণও নেই। যোগাচারগণের মতে চেতনা এবং চেতনার বস্তু অভিন্ন। ধর্মকীর্তি বলেন, নীলবর্ণ এবং নীলবর্ণের জ্ঞান অভিন্ন, কারণ এদের পৃথক অবস্থায় কখনো দেখা যায় না। চনোপীড়াবশত এক চন্দ্রকে যেমন দুই চন্দ্র বলে মনে হয়, তেমনি এরা অভিন্ন হলেও ভ্রমবশত এদের পৃথক বলে মনে হয় । জ্ঞানের বিষয় ব্যক্তি-জ্ঞাতার মনের ভাব বা ধারণা ছাড়া অন্য কিছু নয় । যোগাচারগণ এ মত পোষণ করেন বলে তাঁদের মতবাদকে আত্মগত ভাববাদ (Subjective Idealism) বলা হয় ।


বাহ্যবস্তুর অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যোগাচার মত :

যোগাচারদের মতে, মনের বাইরে 'মনাতিরিক্ত' যদি কোন বস্তু আছে বলে কেউ কল্পনা করেন তবে সে কল্পিত বস্তুকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। কারণ ঐ কল্পিত বস্তু হয় অণু পরিমাণ, না হয় অণুর সমষ্টি হবে। যদি অণু পরিমাণ হয় তবে এত ছোট বলে তাকে মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারে না। আর যদি অণুর সমষ্টি হয় তা হলেও তাকে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। কারণ এর বিভিন্ন অংশ একই সময়ে ও একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করা যায় না। আর একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ না হলে পরিপূর্ণ সমষ্টি সর্বদাই প্রত্যক্ষের অগোচর থাকবে। সুতরাং উক্ত বস্তুরও প্রত্যক্ষ হয় না ।


যোগাচারদের মতে মনের বাইরে বস্তুর অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী :

যোগাচারদের মতে, মনের বাইরে যদি বস্তুর অস্তিত্ব থাকে তবে ঐ বস্তুর অস্তিত্বও ক্ষণস্থায়ী। যেখানে বস্তু সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করা বস্তুর অস্তিত্ব ছাড়া সম্ভব নয় সেখানে ঐ বাহ্যবস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান হতে পারে না, কারণ বাহ্যজ্ঞানের সময় ঐ বস্তু একই বস্তু থাকতে পারে না। তাই যোগাচারগণ বলেন, বাহ্যবস্তুকে 'মনের ধারণা' বললে এসব অসুবিধা আর থাকে না ।


মন বিভিন্ন মানসিক অবস্থার প্রবাহ :

যোগাচার সম্প্রদায়ের বিজ্ঞানবাদ অনুসারে, মন বিভিন্ন ক্ষণস্থায়ী মানসিক অবস্থার একটি প্রবাহ । এ প্রবাহে অতীত প্রত্যক্ষের সংস্কারসমূহ প্রচ্ছন্ন থাকে। কোন এক বিশেষ সময়ে কোন একটি প্রচ্ছন্ন সংস্কার অনুকূল অবস্থা পেয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে। যে সময়ে যে বস্তুর সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে সে সময়ে সে বস্তুই প্রত্যক্ষ করা যায়, অন্য বস্তু নয়। যেমন— সব পূর্ব প্রত্যক্ষের সংস্কার মনে থাকলেও মানুষ যে সময় যেটা দরকার কেবল সেটাই স্মরণ করবে। এ কারণে জ্ঞাতা সবসময় সব বস্তুকে প্রত্যক্ষ পারে না ।


বার্কলির আত্মগত ভাববাদের সাথে বিজ্ঞানবাদের পার্থক্য :

যোগাচারাদের মতবাদের সাথে পাশ্চাত্য দার্শনিক বার্কলির আত্মগত ভাববাদের মিল পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তারপরেও বার্কলির আত্মগত ভাববাদের সাথে বিজ্ঞানবাদের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন-


প্রথমত, বার্কলি প্রত্যক্ষ এবং প্রত্যক্ষ-কর্তার চৈতন্যের বাইরে বস্তুসত্তার জ্ঞান অস্বীকার করেন। কিন্তু যোগাচার বিজ্ঞানবাদীরা চৈতন্য প্রবাহের সঙ্গে জ্ঞানের পূর্বতসিদ্ধ আকারগুলো, যেমন- ভাবনা সংস্কার, কর্ম সংস্কার, বাসনা বা বুদ্ধিবৃত্তি এবং প্রবণতা প্রভৃতিকেও প্রবাহের আধেয় হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।


দ্বিতীয়ত, বার্কলি শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। কিন্তু যোগাচার বিজ্ঞানবাদ ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না। তৃতীয়ত, বার্কলির মতে অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর। কিন্তু যোগাচার বিজ্ঞানবাদ অনুসারে চেতনা নিরপেক্ষ জ্ঞান সম্ভব নয়।


উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায়, যোগাচার সম্প্রদায়ের-বিজ্ঞানবাদ অনুসারে একমাত্র বিজ্ঞান বা চৈতন্যই সত্য। তাইতো বিজ্ঞানবাদ মানুষের চৈতন্য সম্পর্কে যেসব ব্যাখ্যা প্রদান করেছে তা সমগ্র ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!