ভূমিকা : প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে বংশগতি (Heredity) এবং পরিবেশের (Environment) পারস্পরিক প্রভাবে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই দেখা যায়, সব ব্যক্তি এক বিশেষ ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে উঠে। অবশ্য সৃষ্টির রূপান্তরের ফলে ব্যক্তিত্বের কাঠামো পরিবর্তিত হতে পারে। বংশগত সূত্রে শিশু তার ভবিষ্যৎ ব্যক্তিত্বের উপর রেখাপাত করে। আর সংস্কৃতি থেকে শিশু পায় একটি নির্দিষ্ট ছাঁচ, যে ছাঁচে উপাদানগুলোকে ফেলে একটি নির্দিষ্ট ধরনের ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে। শিশু যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে সে পরিবার, বিশেষ করে শিশুর মাতা-পিতা, শিংশগতসূত্রে যে উপাদানগুলোকে পেয়েছে সেগুলোকে সমাজের সংস্কৃতি অনুযায়ী সংস্কৃতির ছাঁচে বিন্যস্ত করেন।
ব্যক্তিত্বের উপর সংস্কৃতির প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আমাদের 'ব্যক্তিত্ব' এবং 'সংস্কৃতি' সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে হবে।
ব্যক্তিত্ব : ব্যক্তিত্ব হল ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণ। ব্যক্তিত্বকে সমাজকাঠামো থেকে আলাদা করা যায় না। ব্যক্তি তার সমাজের ব্যক্তিবর্গ তাদের আচরণ, সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ এসব উপাদানের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়ে থাকে। আর এসব পারস্পরিক সম্পর্কের ফল হিসেবে ব্যক্তি একটি ব্যক্তিত্ব অর্জন করে থাকে। অর্থাৎ, ব্যক্তির সাথে সমাজের বিভিন্ন উপাদানের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার ফলেই ব্যক্তিত্বের উদ্ভব হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হল। গর্ডোন আলপোর্ট (Gordon Allport) বলেছেন, “ব্যক্তিত্ব ব্যক্তির মনোদৈহিক প্রতিক্রিয়াসমূহের এক গতিময় সংগঠন, পরিবেশের সাথে তার অনবদ্য অভিযোজন নির্ধারণ করে।"
ওয়াল্টার মিশেল (Walter Mischel) বলেছেন, “ব্যক্তিত্ব গঠিত হয় আচরণের (চিন্তন ও আবেগসহ) পার্থক্যসূচক ধরন নিয়ে যা তার জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে প্রত্যেক ব্যক্তির উপযোগ স্থাপনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে।”
ক্রাইডার এবং তাঁর সহযোগীরা বলেছেন, “ব্যক্তিত্বকে আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার অনবদ্য ধরন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে, যা ব্যক্তিক এবং ব্যক্তির সাথে পরিবেশের সম্পর্ককে চিহ্নিত করে। "
ম্যানহোন এবং ম্যামহোন বলেছেন, “ব্যক্তিত্ব তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী আচরণের ধরন নিয়ে গঠিত হয়, যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সুসামঞ্জস্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
উত্তওয়ার্থ এবং মারকুইস বলেছেন, “ব্যক্তিত্বকে ব্যাপক অর্থে একজন ব্যক্তির আচরণের সামগ্রিক গুণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, যা তাঁর চিন্তার ধরন ও প্রকাশভঙ্গি, তার মনোভাব ও আগ্রহ, তার কাজের প্রকৃতি এবং তার ব্যক্তিগত জীবন দর্শনে প্রকাশ পায়।” বাসুকিস্ট এবং জরবিং বলেছেন, "ব্যক্তিত্ব হল সময় ও পরিবেশের মধ্যদিয়ে অতিক্রান্ত আচরণ ও চিন্তার এক বিশেষ ধরন, যা এক ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তি থেকে পৃথক করে।"
অতএব, ব্যক্তিত্ব হল একটি জটিল বিষয়। আসলে ব্যক্তিত্ব দেহমনের এক জীবন্ত ঐক্য। ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, সহজাত প্রবৃত্তি, মানসিক প্রবণতা ও ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা, আগ্রহ, জীবনাদর্শ, অভ্যাস, অভিজ্ঞতা, কল্পনাশক্তি, বুদ্ধি, নৈপুণ্য, দোষ, ঋণ প্রভৃতি প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে উপযোজনের ক্ষমতা এবং বাহ্য প্রতিক্রিয়া- এ সবকিছুর সংমিশ্রণেই ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তির শুধুমাত্র গুণ ও ক্রিয়ার সমষ্টি নয়, শুধুমাত্র সংগতি বা ঐক্য নয়, ব্যক্তিত্ব হল সেই সত্তা যা গুণ ও ক্রিয়ার মধ্যে উপস্থিত থেকে তাদের সংহর বা ঐক্যবদ্ধ করে ।
ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সংস্কৃতি : ইংরেজি Culture শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ 'সংস্কৃতি'। ইংরেজি Culture শব্দটি ল্যাটিন শব্দ 'Colere' থেকে এসেছে। 'Colere' শব্দটির অর্থ হল 'কর্ষণ করা'। সর্বপ্রথম ইংরেজি সাহিত্যে 'Culture' শব্দটি ব্যবহার করেন ফ্রান্সিস বেকন।
সংস্কৃতির সংজ্ঞা : সাধারণভাবে সংস্কৃতি বলতে একটি জাতির আচার আচরণ, মূল্যবোধ, খাওয়া, পরা, কথা বলা, চলাফেরা, ভাষার ব্যবহার ইত্যাদির আবেগিক বা মানসিক অবস্থাকে বুঝায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : সংস্কৃতির সর্বজন গ্রহণযোগ্য কোন সংজ্ঞা কেউ প্রদান করতে পারেন নি। সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীগণ তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীগণ সংস্কৃতিকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে সংস্কৃতির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হল :
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “সংস্কৃতি মানুষের একটি বিশেষ মনোভাবের অনুশীলন ও অভিব্যক্তি।" সমাজবিজ্ঞানী Jones এর মতে, “মানব সৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টিই হল 'সংস্কৃতি।"
সমাজবিজ্ঞানী Ross এর মতে, "সকল বস্তু ও অবস্তুর কৌশল হচ্ছে সংস্কৃতি।
সমাজবিজ্ঞানী Cooley, Angel & Carr বলেছেন, “একত্রে বাস করার ফলশ্রুতি যা বংশ পরম্পরায় উৎকীর্ণ করা যায়। তাকেই সংস্কৃতি বলা হয়।”
ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানী E B Tylor তাঁর Primitive Culture গ্রন্থে বলেছেন, “জ্ঞান-বিজ্ঞান, আচার-বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতিবোধ, আইনকানুন এবং অনুশীলন ও অভ্যাস, যেসব মানুষ কোন এক সমাজের পরিবেশে আয়ত্ত করে সেসবের সমষ্টিই হল সংস্কৃতি।"
পরিশেষে উল্লিখিত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে চলতে গিয়ে এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে মানুষ যা কিছু উদ্ভাবন বা আবিষ্কার করেছে সেটিই তার সংস্কৃতি।
ব্যক্তিত্বের উপর সংস্কৃতির প্রভাব : কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তার কৃষ্টির দ্বারা নির্ধারিত হয়। কৃষ্টি বলতে কোন সমাজের সদস্যদের শিক্ষালব্ধ আচরণের ধারাকে বুঝায়। চলাফেরা, পোষাক পরিচ্ছেদ, পছন্দ অপছন্দ সবকিছুই মানুষ তার সমাজে প্রচলিত প্রথা অনুসারে করে থাকে। তবে বৃষ্টি শুধুমাত্র সামাজিক প্রথা নয়, পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন, মনোভাব, বিশ্বাস, নীতিরীতি, মূল্যবোধ সবই কৃষ্টির অন্তর্গত ।
মার্গারেট মীত 'সামোয়া' নামক একটি উপজাতির কিশোরদের উপর অনুসন্ধান পরিচালনা করে দেখতে পান, তাদের কিশোরকাল মোটেই মানসিক চাপে ভারাক্রান্ত নয়। তারা পারিবারিক জীবনে সুউপযোজিত (উরষদ ধকল বফ) এর যৌন বিষয়ে উদারপন্থি। অপরদিকে, নিউগিনির মন উপজাতির কিশোররা অত্যধিক মানসিক চাপগ্রস্ত। যৌনতার অবদমন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আক্যালো, শারীরিক সৌন্দর্য প্রদর্শন, পরিশ্রমী হওয়া এবং ক্ষমতাবানদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা মনুসের বৈশিষ্ট্য ।
সমাজ মনোবিজ্ঞানী এবং নৃবিজ্ঞানীগণ আদিম মানুষের সামাজিক প্রথা, প্রতিষ্ঠান ও আচরণের উপর দীর্ঘকাল ধরে গবেষণা করে তাদের সংগৃহীত তথ্য থেকে ব্যক্তির উপর কৃষ্টির প্রভাব সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছেন। ব্যক্তিত্বের উপ কৃষ্টির প্রভাব সম্বন্ধে যেসব গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে মার্গারেট মীড ও রুথ বোনেডিক্ট এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অপর এক গবেষণায় মীড নিউগিনির অ্যারাপ্রেশ, মুক্তগুমর ও চাম্বুলী নামক তিনটি উপজাতির নারী পুরুষে স্বভাবগত বৈষম্য ও তার কারণ অনুসন্ধান করেন। এ অনুসন্ধানে দেখা যায়, একই ভৌগোলিক বসবাস করা সত্ত্বেও তিনটি উপজাতির ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান। অ্যারাপ্রেশরা অন্যগ্রাসী, সহযোগী, শান্ত ও নম্র স্বভাবের। নারীসুলভ গুণাবলি তাদের আদর্শ।
অন্যদিকে, মুভগুমর নারী পুরুষেরা পুরুষসুলভ গুণাবলির পূজারী। তারা সন্ত্রাসী, নির্দয় এবেং যৌন বিষয়ে বাধাবৰ্দ্ধনহীন। দু'টি উপজাতির স্বভাবে এ বৈপরীত্যে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মীড শিশু প্রতিপালনের পার্থক্যের প্রতি নির্দেশ করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, অ্যারাপ্রেশ মা তার শিশুকে খাওয়ানোর সময় শিশুকে আরামদায়ক অবস্থানে রেখে বেশখানিকটা সময় ধরে খাওয়ান। অন্যদিকে, মুক্তগুমর মা খুব তাড়তাড়ি শিশুকে খাওয়ানোর কাজটি সমাধা করেন এবং এ সময় এমন একটি অস্বস্তিকর অবস্থানে শিশুকে রাখেন যাতে করে এক রকম যুদ্ধ করে শিশুকে তৃপ্ত হতে হয়। শিশু পালনে এ ধরনের পার্থক্যের কারণে অ্যারাপ্রেশ ও মুক্তগুমরনের ব্যক্তিত্ব সংলক্ষণে পার্থক্য সূচিত হয় বলে গবেষক মনে করেছেন।
চাম্বুলীদের মধ্যে নারী ও পুরুষের ভূমিকা ও বৈশিষ্ট্য আমাদের সমাজব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের সমাজে নারীরাই প্রাধান্য বিস্তার করে এবং পুরুষরা নির্ভরশীল প্রকৃতির ও অপেক্ষাকৃত কম দায়িত্বশীল হয়ে থাকে। এসব পার্থক্য থেকে মীড এ শিশুকালই বৃষ্টির প্রভাবে গড়ে উঠে। উপসংহারে উপনীত হন যে, নারী ও পুরুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে যে ধারণা প্রচলিত তা ভুল।
প্রকৃতপক্ষে, মানব প্রকৃতি মীড এর ন্যায় বেনেডিক্ট ও তাঁর গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে সংস্কৃতি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। তিনি নিউগিনির Dobu নিউ মেক্সিকোর Zuni এবং ভ্যানকুভার দ্বীপের Kwakitul এ তিনটি আদিম সমাজের সংস্কৃতিগত পার্থক্যও তার প্রভাব সম্বন্ধে অনুসন্ধান করেন। জুনি সম্প্রদায়ের আদর্শ হচ্ছে ভদ্রতা, নম্রতা ও লৌকিকতা। পক্ষান্তরে, তবুmসম্প্রদায়ের আদর্শ ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা, সন্দেহ পরায়ণতা, বিশ্বাস ঘাতকতা। আর জোয়াজিটল সম্প্রদায়ের আদর্শ হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতা, তীব্র প্রতিযোগিতা, বেনেক্টিভ এ তিনটি উপজাতির ব্যক্তিত্বের এসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, একেক সংস্কৃতিতে একেক ধরনের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে। তাই সংস্কৃতিগত পার্থক্যের কারণে তাদের ব্যক্তিত্ব পার্থক্য দেখা যায়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যক্তিত্ব গঠনে সংস্কৃতির ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজ মনোবিজ্ঞানী Kingsley Davis এর মতে, “মানুষের অস্তিত্বের আদ্যস্ত যদি কোথাও নিহিত থাকে তবে তা রয়েছে লোকাচার তথা সংস্কৃতিতে। কেননা, আমরা তাদের নিয়ে শুরু করি এবং সবসময় তাতেই ফিরে আসি।” তাই বলা যায় সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিত্ব এই দু'টির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।