ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের বর্ণনা দাও।

admin

ভূমিকা :

বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯২৯) মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন । ফ্রয়েড হাজার হাজার মানসিক রোগীর জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে যে মতবাদের প্রবর্তন করেন তাকেই ফ্রয়েড মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব বলেছেন। মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বটি মূলত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। ফ্রয়েড গতিশীলতা ও সহজাত প্রবৃত্তির কথা বালছেন, চেতনা ও অবচেতন মনের অস্তিত্ব তুলে ধরেন এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশে যৌন প্রভাবকে নিয়ামক হিসেবে উল্লেখ করেন। এর সাথে ফ্রায়েড উিদ্বেগ থেকে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে কতকগুলো প্রতিরক্ষা কৌশলের কথা বলেছেন।


ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের বর্ণনা দাও।


ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব : সিগমুন্ড ফ্রয়েডই হল মনঃসমীক্ষণ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। ফ্রয়েডের এ মতবাদ মানুষ সম্পর্কিত ধারণার নবতর মূল্যায়নে উদ্বুদ্ধ করেছে। মনঃসমীক্ষণ মতবাদ মনোবিজ্ঞানের অন্যান্য মতবাদ থেকে ব্যতিক্রম ও বিশ্লেষণধর্মী । মনঃসমীক্ষা মতবাদ মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করেছে এবং আচার আচরণ ও বিভিন্ন কর্মপ্রেরণার অন্তরালে যে উৎস শক্তি কাজ করে তারও সন্ধান করেছে। মানুষের গভীরে গোপন মনের খবর নেওয়া, মানসিক বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ক্রমিক বৈশিষ্ট্যকে বিশ্লেষণ করা প্রভৃতি মনঃসমীক্ষণ মতবাদের মাধ্যমেই জানা যায়।

ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ মতবাদের মূল সিদ্ধান্তসমূহকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যেগুলো ব্যক্তিত্ব ও মানসিক ক্রিয়ার বিশেষ দিকগুলো উন্মোচিত করে থাকে। এগুলো হল


ক. মানসিক যন্ত্র : ফ্রয়েড তার অবস্থান বিন্যাসের ক্ষেত্রে মানুষের মনের তিনটি স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন। এ তিনটি স্তর হল:


১. নির্মান বা অবচেতন মন : ফ্রয়েডের মতে, "অবচেতন বা নির্জন মন সবসময়ই থাক চেতন মনের নিচে অবস্থান করে। মানুষের মনের অধিকাংশ জায়গা নিয়ে এর অবস্থান রয়েছে। চেতন মনে যেমন শৃঙ্খলা, সংস্কৃতি থাকে, তেমন করে অবচেতন মনে থাকে বিশৃঙ্খলা ও অসংহতি । " ফ্রয়েড, ব্যক্তির অবচেতন মনের প্রক্রিয়াকে অসংগতিপূর্ণ শিশুসুলভ ও আদিম প্রকৃতির বলে উল্লেখ


২.প্রাক চেতন মন:  প্রাক চেতন মন চেতন মনের ঠিক পরেই অবস্থান করে থাকে। আমাদের সস্তার বাইরে অবস্থান করে। যেসব ঘটনা আমাদের মনে নেই অথচ চেষ্টা করলেই আমরা মনে করতে পারি, সে ঘটনাগুলোর অবস্থিতিই হল থাকছেন স্তর। অর্থাৎ, থাক চেতন মনে সেসব চিন্তা ও অসি থাকে যাকে বিশেষ চেষ্টায় ইচ্ছা করলেই আমরা চেতন মনে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারি। থাক চেতন অংশ থেকে আমরা পূর্বস্মৃতি চেতন মনে ফিরিয়ে নিয়ে আসি।


৩. চেতন মন: ফ্রয়েডের মতে, আমাদের যেমনটি বারে কাগজের সাথে সহযা এবং সমদ্ধে আমরা সচেতন থাকি তাকেই চেতন মন বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, মনের চেতন অংশ হল সে অংশ যে অংশ সম্পর্কে আমরা অব্যবহিতরূপে জানি। আমরা এ মুহূর্তে সেসব চিন্তা ও অনুভূতি সম্পর্কে জাত, যেসব চিন্তা ও অনুভূতি নিয়ে চেতন মन গঠিত হয়। এ চেতন মন অবচেতন মনের চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র। আয়তনে প্রায় ৭ ভাগের এক ভাগ। তাছাড়াি, চেতন প্রক্রিয়ার একটি বড় অংশ অচেতন প্রক্রিয়ার প্রভাব হতেই জন্মলাভ করে থাকে।


খ. ব্যক্তিত্বের কাঠামো : :ফ্রয়েডের মতে, মানুষের নির্মান মনে দু' রকমের উপাদান আছে। যেমন- একটি হল মানুষের প্রতি এছাড়া, মানুষ তাদের অবাঞ্ছিত অসামাজিক বাসনা, কামনা অবদ স্তরে পাঠিয়ে দিয়ে থাকে। এ অবন অন্যটি হল মানুষের অবদমিত কামনা, বাসনা, প্রভৃতি মূলত লোক, কামমূলক, ধ্বংসমূলক। এগুলো মনের নিজ্ঞান স্তরে থাকে। কামনা নিয়ে নিজ্ঞানের আরও একটি অংশ গঠিত হয়ে থাকে। ফ্রয়েড এ দুটি অংশের একত্রিতভাবে নামকরণ করেছেন। তা (অপস), ফ্রয়েড ব্যক্তিসত্তার সাংগঠনিক বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে আরও দু'টি অংশ যেমন- অহং ও অধিপত্তা দেখতে পান। নিচে এ বিষয়ে আলোচনা করা হল :


১. আদিপত্তা ব্যক্তিত্বের একটি প্রাথমিক সত্তা হল আদিসতা। এটি হল মানুষের মজ্জাগত জৈবিক সত্ত্বা বা সব কামনা বাসনার আধার। ইদ হল এমনসব কামনা, বাসনা বিষয়ক সহজাত প্রতিবর্তী এবং অন্যান্য জৈবিক বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি যা আমরা জন্মগতভাবেই পেয়ে থাকি। সুতরাং, ইদ হল অবচেতন মনের এক স্বার্থপর শিশু। ইদ 'আনন্দনীতি' দ্বারা পরিচালিত হয়। জৈবি তাড়নায় নিবৃত্তি করেই সুখ লাভ করা হল এ নীতির মূল কথা। এ সভার মাধ্যমেই ব্যক্তিত্বের বিকাশের শক্তি সঞ্চারিত হয়ে থাকে। এজন্য একে ব্যক্তির মানসিক শক্তির সংরক্ষণাগার বলা হয়ে থাকে। ফ্রয়েডের মতে, “আদিসত্তা যেন অবচেতন মনের এক স্বার্থপর শিশু। সে শুধু তৃপ্তি চায়, সুখ চায়। সে কোন ধরনের যুক্তি, বিচার বুদ্ধি বা নৈতিক জ্ঞানের ধার ধারে না। আর এ আদি সবার কামনার সাথে পরিবেশের দ্বন্দ্ব সংঘাতের ফলে ক্রমশ ব্যক্তিত্বের পরবর্তী দু'টি সত্তা ইদ এর সাথে ইগো বা অহংবোধ জন্ম নেয়।


২. ইগো বা অহং : আদিম সত্তার তাড়নায় বাহ্যিক পরিবেশে তৃপ্তি খুঁজতে শিশুকালে যে প্রয়াস দেখা দেয় তাই ধীরে ধীে সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে ব্যক্তিমনে জানা নেয় অহংবোধ বা ইগো। ইগো 'বাস্তবতার নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়ে। থাকে। বাস্তবতা নীতির উদ্দেশ্য হল যথাযোগ্য বস্তুর মাধ্যমে প্রয়োজন মেটানো। এ নীতির মূল কাজ হল অভিজ্ঞতা সত্য না মিথ তলিয়ে দেখা। অহংবোধ সর্বত্র বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন এবং যুক্তিবাদী। ফ্রয়েডের মতে, “অহং যখন আদিসত্তার তীব্র কামনা ও কঠোর নিয়মকানুনের মুখে তার সমন্বয় হারিয়ে ফেলে, তখন ব্যক্তিত্বের বিপর্যয় ঘটে থাকে। আদিম সত্তা ও অহং এর সম্পর্ককে অশ্বারোহী ও ঘোড়ার সাথে তুলনা করা যায়।"


৩. অধিসত্তা বা সুপার ইগো : ব্যক্তিত্ব কাঠামোর তৃতীয় ও সর্বশেষ পর্যায় হল অধিসত্তা বা সুপার ইগো। অর্থাৎ, যাকে আমরা বিবেক বলে থাকি তাই হল অধিসত্তা বা সুপার ইগো। হল ও লিন্ডজ এর ভাষায়, “সুপার ইগো হল ব্যক্তিত্বের নৈতিক হাতিয়ার ) সুপার ইগো বাস্তবকে নয়; আদর্শকে প্রতিফলিত করে এবং আনন্দের বদলে পূর্ণতা খোঁজে। সুপার ইগোর সৃষ্টি হয় সমাজের নিয়মকানুনের আত্মীকরণ থেকে । সমাজের শাস্তি এড়ানোর জন্য শিশু যখন সমাজের বিধিনিষেধকে নিজের বলে গ্রহণ করতে শেষে তখন জন্ম নেয় তার বিবেক।


গ. ব্যক্তিত্বের গতিশীলতা : ফ্রয়েডের মতে, "সব পরিণত বয়স্ক ব্যক্তির চরিত্রেই তার মানসিক শক্তির কটনের উপর নির্ভর করে। এ বণ্টনের বেশিরভাগই তার শৈশবে সাধিত হয়। অর্থাৎ কোন শিশু বড় হয়ে কোনরকম ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবে তার বীজ শিশুর শৈশবকালেই নিহিত থাকে। পরিণত বয়স্কের ব্যক্তিত্ব তার শিশুকালের অভিজ্ঞতাই নির্ধারিত করে দেয়। শিশুকালের এ অভিজ্ঞতার পিছনে রয়েছে এক ধরনের প্রবৃত্তি। " ফ্ররেডের মতে, “আমাদের আদিম ও মৌলিক চাহিদাগুলোই আমাদের কর্মে প্রযুক করে থাকে। আর এ চাহিদাগুলোর পশ্চাতে থাকে মানসিক শক্তি।” ফ্রয়েড এর নাম দিয়েছেন প্রবৃত্তি। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো এ প্রবৃত্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ফ্রয়েডের মতে, মানুষ জন্মগতভাবেই কতকগুলো প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এদের উল্লেখযোগ্য হল। ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও যৌন আকাঙ্ক্ষা।


ঘ. ব্যক্তিত্বের বিকাশ ফ্রয়েড তার মনঃসমীক্ষণ মতবাদে এ সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন যে, মানুষের মনোজীবন ও ভার যৌনজীবন ক্রমবিকাশের ধারায় পরস্পর সম্পৃক্ত। যৌন কামনা হল মানুষের আদি ও মৌলিক কামনা। এ কামনা চরিতার্থ করার জন্য মানুষ শিশুকাল হতে নানাভাবে আচরণ করে এবং জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর অতিক্রমের মাধ্যমে বিকশিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়। ফ্রয়েড দেখেছেন, যৌনতা নিয়েই সব শিশু জন্মগ্রহণ করে। যৌন জীবনের অপরিপক্বতা, অপরিপূর্ণতা বা বিকৃত প্রকাশ নির্ভর করে দু'টি বিশেষ প্রভাবের উপর, যথা :

ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় থেকেই অনেকের দেহ যেমন দুর্বল বা পঙ্গু থাকে, সবরকম চেষ্টা যত্নে তাদের দেহের পুষ্টি বৃদ্ধি বা পূর্ণতা হয় না, তেমনি অনেকেই জন্মগতভাবে দুর্বল ও সীমিত যৌনতার অধিকারী হয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকে। এদের যৌন জীবনে কোন সময় স্বাভাবিক পূর্ণতা আসে না।


৪. পারিপার্শ্বিক অবস্থার বৈরিতার জন্য যৌন জীবনে অপূর্ণতা বা বিকৃতি দেখা দিতে পারে। ফ্রয়েড মনে করেন যে, যৌন পরিপূর্ণতা, মনের পরিপূর্ণতার সাথে সমানভাবে এগিয়ে যায়। এ অগ্রগতির বিভিন্ন স্তর বা ধাপ আছে। এ ধাপ বা স্তরগুলো ছকে বাঁধা এবং এর মূল উৎস হল জৈবিক প্রেরণা।

যৌন কামনা ব্যক্তিত্ব রূপায়ন কিভাবে করে এর একটি পরিচয় দিতে গিয়ে ফ্রয়েড ব্যক্তিত্ব বিকাশ স্তরকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হল :

১. মুখকাম স্তর, ২. পায়ুকামস্তর, ৩. লিঙ্গকামস্তর, ৪. যৌনন্তর।


উপসংহার : পরিশেষে একথা বলতে পারি যে, ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বটি ত্রুটিমুক্ত নয়। তথাপি আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের কাছে এ তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, এ তত্ত্বের উপর নির্ভর করেই বর্তমানে মনোবিজ্ঞানীরা অনেক পারি না। বিস্ময়কর অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাছাড়া ফ্রয়েডের অবচেতন মনের আবিষ্কারকে আমরা কখনই অস্বীকার করতে


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!