বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতা হ্রাসের উপায় আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

সাধারণত বৈদেশিক সাহায্য বলতে কোন বিদেশী সরকার কিংবা সংস্থা কর্তৃক অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পাতব্য শর্তে প্রদত্ত এক ধরনের আর্থিক অনুদান (Grant) ও ঋণকে (Loan) বুঝায়। বৈদেশিক সাহায্যকে বৈদেশিক মূলধনও বলা হয়। অভ্যন্তরীণ বা দেশীয় মূলধনের স্বল্পতার কারণে যখন কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না, তখন সে দেশ বিদেশের নিকট হতে বিশেষ করে উন্নত দেশের নিকট হতে সাহায্য ও ঋণ গ্রহণ করে থাকে। স্বল্পোন্নত দেশসমূহ উন্নত দেশগুলোর নিকট হতে প্রকল্প সাহায্য, কারিগরি সাহায্য, পণ্য সাহায্য প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের সাহায্য গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং কোন দেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদেশের কাছ থেকে যে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য এবং ঋণ গ্রহণ করে তাকে বৈদেশিক সাহায্য বলা হয়।


বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতা হ্রাসের উপায় আলোচনা কর।


বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতা হ্রাসের উপায় :

বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পন্থা বা উপায়সমূহ অবলম্বন করা যায় :


১. দেশীয় পুঁজি গঠনে উৎসাহ প্রদান :

বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে হলে দেশের অভ্যন্তরে পুঁজি সংগঠন বৃদ্ধি করতে হবে। দেশে সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করে অধিকতর পুঁজি সংগঠন করা যেতে পারে। এজন্য দেশের জনসাধারণকে উৎসাহ প্রদান করতে হবে।


২. সরকারি খাতে সঞ্চয় বৃদ্ধি :

বাংলাদেশে সরকারি খাতে সঞ্চয় বৃদ্ধি করতে পারলেও বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। সরকারি খাতে সঞ্চয় বৃদ্ধির জন্য সরকারের কর রাজস্ব বাড়ানো যায়। বাংলাদেশের করের সিংহভাগ আসে পারোক্ষ কর থেকে। অতএব, আয়করের মাধ্যমে কর রাজস্ব বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। অন্যদিকে, সরকারের বায় হ্রাস করাও সম্ভব। এতে করে সরকারের উদ্বৃত্ত বাড়বে এবং সঞ্চয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে।


৩. বেসরকারি সঞ্চয় বৃদ্ধি :

বাংলাদেশে ২০০৫-০৬ সালে সঞ্চয় ছিল জি.ডি.পি. এর ২০-২৬ এবং বিদেশ থেকে প্রাপ্ত রেমিটেন্সসহ জাতীয় সঞ্চয় ছিল জি.ডি.পি. এর ২৬-৬১। আর বিনিয়োগ ছিল জি.ডি.পি. এর ২৪-৯৭%। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেশি। অতএব, বাংলাদেশকে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতা হ্রাস করার জন্য উপযুক্ত রাজস্ব ও মুদ্রানীতি প্রয়োগ করে বেসরকারি সঞ্চয় বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে।


৪. বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ :

বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) আকৃষ্ট করতে পারলে বৈদেশিক সাহায্যের নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমে যাবে। অতএব, বাংলাদেশে সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিস্থিতি, সর্বপ্রকার অবকাঠামোগত সুবিধা, মুনাফা বিদেশে নেওয়ার ব্যবস্থা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভয় থেকে মুক্তি ইত্যাদি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) আকৃষ্ট করতে হবে।


৫. বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি :

বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যের নির্ভরশীলতা হ্রাস করার লক্ষ্যে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য রাজস্ব ও মুদ্রাক্ষীতির মাধ্যমে অবাধ সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থা ও আর্থিক বাজারের সংস্কারের মাধ্যমে, বিনিয়োগের সুবিধা সৃষ্টি করা যেতে পারে।


৬. সাহায্য নিবিড় বিনিয়োগ হ্রাস :

বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতা হ্রাস করার লক্ষ্যে সাহায্য নিবিড় বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি পরিহার করতে হবে। তার পরিবর্তে যে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি দেশীয় উপকরণ ও বিশেষজ্ঞ ব্যবহার করে সেগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে।


৭. বর্তমান শিল্পকারখানায় উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার :

বাংলাদেশে অনেক শিল্পকারখানায় উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হয় না। রাজার মূল্য অনুযায়ী উৎপাদনে দক্ষ নয়, এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় না করে।আমাদের বর্তমান বন্ধ শিল্পকারখানাগুলোর উৎপাদন অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।


৮.উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহারের জন্য পরিকল্পনা:

বাংলাদেশে পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এমন প্রকল্পগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে যেগুলোর ইনপুট উৎপাদনকারী কারখানায় অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা অর্থনীতিতে বর্তমান আছে। এমন কোন নতুন প্রকল্প স্থাপন করা যাবে না যার সকল ইনপুট আমদানি করতে হবে।


৯. আত্মনির্ভরশীল সীমিত প্রবৃদ্ধির কৌশল :

B.ID.S একটি উন্নয়ন মডেল তৈরি করে দেখিয়েছে যে, আত্মনির্ভরশীলতা গ্রহণ (S.R.S : Self Reliance Ratio) বাড়ানো যায়, যদিও তাতে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমবে। ২০০৫-০৬ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৬.৬৩ এবং ২০০৬-০৭ সালে প্রবৃদ্ধির হার কমে শতকরা ৬.৫৩ হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি অধিক আত্মনির্ভরশীল হই তবে দেশের কলকারখানায় উৎপাদন ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় ব্যবহৃত হবে। ফলে উন্নয়নের ভিত্তি মজবুত হবে।


১০. খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন :

বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে হলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। আমাদের বৈদেশিক সাহায্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খাদ্য সাহায্য হিসেবে আসে। এমতাবস্থায় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারলে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে।


১১. পর্যাপ্ত খাদ্যের স্টক :

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের একটি অন্যতম সমস্যা। বাংলাদেশে প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয় বিধায় আমাদের খাদ্যের স্টক রাখা প্রয়োজন। দেশের সর্বত্র উপযুক্ত গুদামে খাদ্য স্টক রাখা অত্যাবশ্যক।


১২. আমদানি বিকল্প শিল্প স্থাপন :

বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে হলে আমাদের দেশে বিভিন্ন আমদানি শিল্প স্থাপন করতে হবে। বর্তমানে দেশে যে বিপুল পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী আমদানি করা হয় তার ব্যয় নির্বাহের জন্য বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। এমতাবস্থায় দেশে আমদানি বিকল্প ও আমদানি পরিপূরক শিল্প স্থাপন করা হলে, বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ হ্রাস পাবে এবং বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে।


১৩. রপ্তানি বাণিজ্যের সম্প্রসারণ :

দেশের অধিকসংখ্যক রপ্তানিমুখী শিল্প স্থাপন ও কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি বহুলাংশে দূর হবে এবং বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে।


১৪. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা :

বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে স্বনির্ভর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে হলে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব রয়েছে। সুতরাং দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলের সবিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত।


উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য ছাড়া আমাদের পক্ষে অগ্রসর হওয়া কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। অতএব, আমাদের সম্পূর্ণ বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর হওয়া কোনক্রমেই উচিত নয়। আর কোন দেশই চিরকাল বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর করে চলতে পারে না। সুতরাং আমাদেরকেও বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা ক্রমশ হ্রাস করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ ও তাদের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করতে হবে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!