বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণগুলো আলোচনা কর।

admin

 ভুমিকা:

বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান সমস্যা হল বাপক মুদ্রাস্ফীতি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি বিদ্যমান। অবশ্য এ মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের  অর্থনীতিকে কোন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এমন বলা যায় না, বরং উন্নয়নের জন্য কিছুটা মুদ্রাস্ফীতি সুবিধাজনক। কিন্তু বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি দেশের জন্য মারাত্মক বিরূপ প্রক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এবং ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বর্তমানে সরকারিভাবে দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার ৭.৩ শতাংশেরও বেশি, যা নিঃসন্দেহে বিরূপ প্রক্রিয়া সৃষ্টি করছে।


বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণগুলো আলোচনা কর।


মুদ্রাস্ফীতির কারণ :

বাংলাদেশে ২০১২-'১৩ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৬.৭৮% এবং এপ্রিল, ২০১৪ সাল (প্রক্ষেপিত) সময়কালে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭.৩৮% । মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হল :


১. উন্নয়ন ব্যয় :

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অধীনে অবকাঠামো গঠনের জন্য প্রচুর ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে ত সাথে স র পরিমাণ বৃদ্ধি পায় না। ফলে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়।


২. অর্থের যোগান বৃদ্ধি :

বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ হল অ অর্থের যোগান বৃদ্ধি । বাংলাদেশের জুলাই ২০০৬ থেকে মার্চ ২০০৭ সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যুকৃত মুদ্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০.২৪ শতাংশ। ফলে ঐ সময়ে ব্যাপক অর্থের যোগান বেড়ে গিয়েছে ৭.৩৫% শতাংশ। অথচ ঐ সময়ে দেশের সমপরিমাণে পণ্যের উৎপাদন বাড়ে নি। ফলে স্বাভাবিকভাকেই মূল্যস্তরের উপর ঊর্ধ্বচাপ দেখা দেবে। সুতরাং মুদ্রার যোগান বৃদ্ধি পেলে মুদ্রাস্ফীতিও বেড়ে যায় ।


৩. উৎপাদন হ্রাস :

বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হল উৎপাদন হ্রাস। বিগত স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসায় বাণিজ্য ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায়ই ফসল বিনষ্ট হয় ও খাদ্যশস্যের অধিকাংশই খাদ্যদ্রব্যের জন্য ব্যয়িত হয় । শস্যহানির কারণে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে দেশে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়।


৪. উদার ঋণনীতি :

বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হল ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি। স্বাধীনতা উত্তরকালে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭২ সালের জুন মাস নাগাদ বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৬৪.২৪ কোটি টাকা। ২০০৭ সালের মার্চ মাস নাগাদ মোট ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৮,৬৫০-৩০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের এরূপ ব্যাপক ঋণদান নীতি বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ ।


৫. উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি :

পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে উৎপাদন কার্যে ব্যবহৃত তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রভৃতির মূল্য বারবার বৃদ্ধি করা হচ্ছে । ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গিয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে।


৬. সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি :

সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অধীনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সরকারকে বিভিন্ন খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এসব ব্যয়ের বিপরীতে সমপরিমাণে দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদিত পাচ্ছে এবং দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে চলেছে । ত হচ্ছে না। ফলে দ্রব্যসামগ্রীর সরবরাহ কমে গিয়ে এর মূল্য বৃদ্ধি


৭. বেতন ও মজুরি বৃদ্ধি :

বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের চাপে স্বাধীনতার পরবর্তীকালে শ্রমিকের বেতন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেতন ও মজুরি কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেতন ও মজুরি কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে। এতে একদিকে যেমন বাজারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে তেমনি উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে বেতন ও মজুরি বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়িয়েছে ।


৮. পরোক্ষ কর :

বাংলাদেশের কর কাঠামো প্রধানত পরোক্ষ করের উপর নির্ভরশীল এবং ২০০৭ সালে মোট জিডিপির ৫৫.০১ শতাংশ রাজস্ব আয় পরোক্ষ কর থেকে উৎপাদিত হয়েছে। ভ্যাটের বিস্তৃত আওতার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা হয়। ফলে ভ্যাট সংযুক্ত হয়ে পণ্যসমূহের দাম বৃদ্ধি পায়। অতএব পরোক্ষ কর মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ ।


৯. আমদানি দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি :

আমদানিকৃত দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিও বাংলাদেশে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির একটি অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে -যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়েছে। বিশ্বের বাজারে পেট্রোলিয়াম, গম, ভোজ্য, তেল, সার, সিমেন্ট ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয়।দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি অনাকাঙ্ক্ষিত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশেও এসব আমদানিকৃত দ্রব্যের মূল্য যথেষ্ট বেড়েছে।


১০. টাকার অবমূল্যায়ন :

বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হল বাংলাদেশী টাকার অবমূল্যায়ন । টাকার অবমূল্যায়ন করা লে এর বাহ্যিক মূল্য হ্রাস পায়। ফলে আমদানিকৃত পণ্যের জন্য বেশি মূল্য দিতে হয়। এছাড়া রপ্তানি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে র মূল্যও বৃদ্ধি পায়। এভাবে টাকার অবমূল্যায়ন করা হলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে ।


১১. রপ্তানি বৃদ্ধি :

বাংলাদেশ রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যের যোগান হ্রাস পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে।


১২. মজুতদারি :

অসৎ ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে পণ্য মজুত করে কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করে। ফলে মূল্যস্তর বৃদ্ধি পায়।


১৩. অনুন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা :

বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত। পরিবহণ ও যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধার ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত পণ্যসামগ্রী স্থানান্তর করা যাচ্ছে না। পরিবহণের এরূপ অবস্থার ফলে বাজারের উপর প্রভাব পড়ছে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে করিম অভাবের সৃষ্টি হয়ে দ্রবামূল বৃদ্ধি পাছে।


১৪. চোরাকারবার :

মুদ্রাস্ফীতির জন্য চোরাকারবারিও অনেকাংশে দায়ী। বাংলাদেশ থেকে চোরাইপথে বিভিন্ন পণ্য সীমান্তের ওপারে চলে যায়। ফলে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের সংকট সৃষ্টি হয় এবং দ্রব্যমূল্য বেড়ে গিয়ে মূল্যস্তরের উপর উর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি করে।


১৫. আমদানি নীতির প্রভাব :

বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল আমদানি নীতি। বৈদেশিক মুদ্রার স্বল্পতার জন্য বাংলাদেশে বিদেশ হতে পণ্যসামগ্রীর আমদানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বিলাসজাত দ্রব্য এবং কিছু কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানির উপর উচ্চহারে শুল্ক ও কর ধার্য করা হয়েছে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।


১৬.জনসংখ্যা বৃদ্ধি :

বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির আরেকটি প্রধান কারণ হল জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ এবং এখানকার জনসংখ্যা ক্রমাগত হারে বেড়েই চলেছে। কিন্তু জনসংখ্যার অনুপাতে দ্রব্য উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে ।


১৭. অনুৎপাদনশীল খাতে অধিক ব্যয় :

বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হল অনুন্নয়ন ও অনুৎপাদনশীল খাতে অধিক যায়। বিগত কয়েক বছরে দেশে স্টেডিয়াম, শিশুপার্ক নির্মাণ প্রভৃতি অনুৎপাদনশীল খাতে যথেষ্ট ব্যয় করা হয়। কিন্তু এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়ায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির গতি তীব্রতর হয়েছে।


উপসংহার :

উপর্যুক্ত কারণে বাংলাদেশে মূল্যস্তর বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে মৃদু বর্ধনশীল দামস্তর খুব একটা উদ্বেগের কারণ নয়। তবে মূল্যস্ফীতির শতকরা হার যাতে ১০এর উপরে যেতে না পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ মূল্যস্ফীতির শতকরা হার ১০ কিংবা ততোধিক হলে দেশের জন্য তা মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!