বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে নিয়োজিত এনজিও গুলোর কার্যক্রম আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

দারিদ্র্য হল একটি বিশেষ আর্থসামাজিক অবস্থার নাম। এ অবস্থাটির সৃষ্টি হয় তখন, যখন সমাজে জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। সমসাময়িক বিশ্বে দারিদ্র্য একটি বহুল আলোচিত বিষয়, যা মানবতার প্রতি একটি বড় অভিশাপ। আধুনিক মানবতা বিকাশে দারিদ্র্য একটি মারাত্মক অন্তরায়। অনুন্নত ও তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের বিশেষ করে বাংলাদেশের অনুন্নয়নের অন্যতম কারণ হল দারিদ্র্য।


বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে নিয়োজিত এনজিওগুলোর কার্যক্রম আলোচনা কর


বস্তুত দারিদ্র্য ব্যাপারটি একান্তই আপেক্ষিক। কেননা কেউ অন্য কারও তুলনায় দরিদ্র বা ধনী হতে পারে। আমরা সাধারণত বলি, “যেসব লোক জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে সক্ষম তারাই দরিদ্র।” আবার বিশ্বব্যাংকের মতে যারা এক ডলারের নিচে আয় করে তাদের দরিদ্র বলা হয়। তাহলে আবার প্রশ্ন উঠবে মৌলিক চাহিদাগুলো কতটা না মিটলে দারিদ্র্য বলা যাবে? কি মানের খাদ্য চাই, কি মানের বস্ত্র ও বাসস্থান চাই? বস্তুত আমেরিকার সমাজের একজন দরিদ্র ব্যক্তির জীবনধারা, দারিদ্র্য কবলিত যে কোন সমাজের দরিদ্র ব্যক্তির জীবনধারা অপেক্ষা উন্নত বলা যায় ।


বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে নিয়োজিত কতিপয় সংস্থাসমূহ :

দারিদ্র্য বলতে এমন এক পীড়াদায়ক ও অবাঞ্ছিত আর্থসামাজিক পরিস্থিতিকে বুঝায়, যেখানে জনগণ জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না, জীবনধারণের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল এবং সমাজে নিপর্যায়ে পড়ে থাকে। দারিদ্র্য কেবলমাত্র বাংলাদেশে নয়, উন্নয়নশীল সকল দেশেই সবচেয়ে মারাত্মক সামাজিক সমস্যা হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। আমাদের দেশে দারিদ্র্য সমস্যা সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কতকগুলো কার্যক্রম চালু রয়েছে। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল :


১. স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর :

স্থানীয় সরকার, পল্লিউন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়াধীন এ অধিদপ্তরে বিভিন্ন অবকাঠামোমূলক উন্নয়ন প্রকল্প, বিশেষ করে পল্লি অঞ্চলে গ্রামীণ সড়ক, গ্রোথ সেন্টার, বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে । এতে পল্লি অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। ১৯৯০-৯১ সাল হতে ২০১৩-১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪৩ কোটি শ্রম দিবসের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।


২. গ্রামীণ ব্যাংক :

ড. মুহাম্মদ ইউনুস, ১৯৮৩ সালে এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত করে। তবে ১৯৭৬ সালে এর কার্যক্রম একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্পের অধীনে শুরু হয়। নিঃস্ব, অসহায় কিন্তু কর্মঠ, বিত্তহীনদের সংগঠিত করে দলভিত্তিক ঋণের মাধ্যমে তাদের আয়, পুঁজি ও সম্পদ গঠনের উদ্দেশ্যে এ ব্যাংকের বিস্তার লাভ করে। গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে এবং তা সর্বক্ষেত্রে প্রশংসিত হচ্ছে। বর্তমানে ৬০টিরও অধিক দেশে এ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশে (২০০৭ পর্যন্ত) ৭০,০৫,৯২৬ জন লোক সুবিধাভোগ করছে।


৩. খাদ্য সহায়তায় পল্লি রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি :

বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। (CARE) এর সহযোগিতায় এদের কর্মসূচির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয় এবং ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে 'খাদ্য সহায়তা Sa৮ সালে এ সংস্থার কার্যক্রম শুরু হয়। কানাডা থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কেয়ার করি রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি' তৃতীয় পর্যায়ের স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের (LEGE) নিকট স্থানান্তরিত হয়।


৪. বাংলাদেশ পল্লিউন্নয়ন বোর্ড :

সমগ্র দেশব্যাপী সমবায় ও অনানুষ্ঠানিক গ্রুপ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশ পল্লিউন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) বাংলাদেশ সরকার ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পল্লিউন্নয়ন এবং পল্লি দারিদ্র্য বিমোচনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বিআরডিবির মাধ্যমে ডিসেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত ১৬৩৭৩৭টি সমিতি/দল গঠন করে 30.61 লক্ষ উপকারভোগরি মধ্যে ৫৫৭১.৪২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে এবং ৪৮৭৩.৩০ কোটি টাকা আদায় করেছে। ঋণ আদারের হার ছিল শতকরা ১৩ ভাগ।


৫. বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন একাডেমি :

১৯৫৯ সালে বিশিষ্ট সমাজসেবক আখতার হামিদ সিদ্দিকী এ সংস্থাটি গঠন করেন। এ গ্রন্থাকে সংক্ষেপে বার্ড' (BARD) বলে। মূলত এ বার্ড বা বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন একাডেমি বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা সবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ২২টি উপজেলায় ‘ক্ষুদ্র কৃষক ও ভূমিহীন শ্রমিক উন্নয়ন প্রকল্প' নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। হেক্সের মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষক, ভূমিহীন, মজুর ও দরিদ্র মহিলাদেরকে বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক গ্রুপে সংগঠিত করে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষণ প্রদান এবং আয় বৃদ্ধি ও মূলধন গঠনের জন্য ঋণ দিচ্ছে।


৬. পল্লি কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন :

পল্লি কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন ১৯৯০ সালে স্থাপিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি সহযোগিতা সংস্থা এনজিও এর মাধ্যমে লক্ষ্যভিত্তিক দরিদ্র এবং বিত্তহীন জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে আসছে। এসব ঋণ কার্যক্রমের মধ্যে নার্সারী, বেতের কাজ, গরু মোটাতাজাকরণ, হাঁস-মুরগি পালন, রিকশা-ভ্যান ক্রয় এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য। পল্লি অসহায়ক ফাউন্ডেশন এ ঋণ কার্যক্রমের লক্ষ্যে সহযোগী এনজিওগুলোর ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও নৈপুণ্য বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।


৭. আশা:

দরিদ্র বিমোচনে নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আশা অন্যতম। ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান, আর্থিক ক্ষমতায়ন, [ সৃষ্টি, সঞ্চয় ও আয় বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়ন প্রভৃতির মাধ্যমে এ সংস্থা ১৯৯২ সাল হতে দরিদ্র বিমোচনে কাজ করে আসছে।


৮. বাংলাদেশ পল্লিউন্নয়ন কমিটি-ব্র্যাক :

বিশিষ্ট সমাজসেবক ফজলে হাসান আবেদ ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অসহায়, নিঃস্ব মানুষদের বেসরকারি উদ্যোগে সাহায্যের জন্য 'বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন কমিটি' বা সংক্ষেপে ব্র্যাক (BRAC) গঠন করে। এদেশের দরিদ্র বিমোচনে 'ব্র্যাকের' ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত এ সংস্থা ক্ষুদ্র ঋণদান, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা, প্রভৃতি কার্যক্রমে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে এবং খাবার স্যালাইন, মহিলাদের অধিকার সম্বন্ধীয় আইনগত পরামর্শদানের মাধ্যমে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।


৯. কর্মসংস্থান ব্যাংক :

বাংলাদেশে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ব্যাংক ১৯৯৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কার্যক্রম শুরু করে এবং ফেব্রুয়ারি ২০০৭ পর্যন্ত মোট ঋণ দেয় ৩৩০ ৭৬ কোটি টাকা, এবং আদায় করে ২৭২৪৫ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে আদায়ের হার হয় ৮০%। এ ব্যাংক দেশের ৬৪টি জেলাতে ৯৫,১৯৮ জনকে সুযোগ সুবিধা দিয়েছে।

[অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০০৭]


১০. প্রশিকা মানব উন্নয়ন কেন্দ্র :

১৯৭৬ সালে প্রশিকা বাংলাদেশে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (NGO) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ সংস্থার কার্যক্রমগুলো হল ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান, মৎস্য ও পশু সম্পদ উন্নয়ন, রেশম সম্পদ উন্নয়ন, সেচ কর্মসূচি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, নলকূপ স্থাপন ও বিতরণ, পরিবেশসম্মত কৃষি, সামাজিক বনায়ন ও গৃহায়ন কর্মসূচি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।


১১. পল্লিউন্নয়ন একাডেমি বগুড়া :

বগুড়া পল্লিউন্নয়ন একাডেমি দরিদ্র বিমোচনে, সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি, প্রাথমিক বনায়ন ও ক্ষমতায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এসব প্রকল্পের ঋণ বিতরণ পরিমাণ ছিল ১:৪১ কোটি টাকা।


১২. স্বনির্ভর বাংলাদেশ :

১৯৭৫ সালে এটি স্থাপিত হয়। এ সংস্থাটি ঋণদান, প্রশিক্ষণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাক্ষরতা অভিযান, কৃষি উন্নয়ন প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করে দারিদ্র্য বিমোচনে একটি বেসরকারি সংস্থা (NGO) হিসেবে সহায়তা করে আসছে।


১৩. বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচি :

বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ অংশগ্রহণ করছে। এ কর্মসূচির অধীনে ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র কৃষককে ঋণ সরবরাহ করা হয়। এনজিওসহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এ ঋণ সরবরাহ করা হয় এবং এসব ব্যাংকসমূহের নিজস্ব কর্মসূচিও রয়েছে।


১৪. অন্যান্য :

দারিদ্র্য বিমোচনে অন্যান্য সংস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে গ্রামীণ সেবা, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট এলাকায় সুশীলন, অন্যান্য বিদেশী সাহায্য সংস্থা, আঞ্চলিক সাহায্য সংস্থা, বিশেষ করে জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন উল্লেখযোগ্য।


উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার শেষ প্রান্তে আমরা বলতে পারি যে, দরিদ্র হল একটি আর্থসামাজিক অবস্থার নাম। এ দরিদ্র বর্তমান বাংলাদেশের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। বস্তুত দরিদ্রতা একটি অভিশাপ। কেননা আমাদের সমাজে একমাত্র দরিদ্রতার কারণে নানান ধরনের অপরাধ ও অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিনিয়ত সংগঠিত হচ্ছে।


এজন্য যে কোন মূল্যে আমাদের সমাজব্যবস্থা থেকে দরিদ্রকে সমূলে উৎপীড়ন করতে হবে। আর ঐ লক্ষ্যে সরকারের সচেতনমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন এবং উক্ত বেসরকারি সংস্থার (NGO) পাশাপাশি দেশের সর্বস্তরের জনগণকে আরও সচেতন হতে হবে। তাহলে 'দরিদ্র' নামক সামাজিক অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!