বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের উপায়গুলো আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা: 

বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষে প্রণীত উন্নয়ন পনিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের প্রয়োজন হয়। এ অর্থসম্পদ প্রধানত দু'টি উৎস হতে সংগৃহীত হয়। যথা : ১. অভ্যন্তরীণ উৎস ২. বৈদেশিক উৎসবাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার মোট ব্যয়ের সিংহভাগই বৈদেশিক উৎস হতে সংগৃহীত হয়। তবে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস এবং একটি স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের উপর বিশেষ জোর দেওয়া প্রযোজন।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের উপায়গুলো আলোচনা কর


উদ্দেশ্যে অভ্যন্তরীণ উৎসসমূহ হতে সম্পদ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যেমন- রাজস্ব বাজেটের উদ্বৃত, অতিরিক্ত করারোপ, ঘাটতি ব্যয় পদ্ধতি অবলম্বন, বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নীট মূলধন আয়, বেসরকারি সঞ্চয় প্রভৃতি উৎস হতে অভ্যন্তরীণ সম্পদের সমাবেশ ঘটানো হয়। এভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয়নির্বাহের জন্য বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ উৎস হতে অর্থসম্পদ সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশ বলা হয়।


বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের উপায় :

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অর্থসংস্থানে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশ বৃদ্ধির জন্য সরকারি এবং বেসরকারি খাতে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে :


ক. সরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ ও বৃদ্ধির উপায় :

বাংলাদেশে সরকারি খাতে সম্পদ আহরণও বৃদ্ধির যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এ উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা যেতে পারে :


১. সরকারি ব্যয় হ্রাস :

সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ হ্রাস করে রাজস্ব উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করা যায়। অর্থনীতির দীর্ঘকালীন সমৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বল্পকালে সরকারি ব্যয় হ্রাস করা একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, আমাদের দেশের সরকারের ব্যয় ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এ প্রবণতা রোধ করে রাজস্ব খাতে সরকারি ব্যয় হ্রাস করা প্রয়োজন। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের সংস্থান হবে।


২. কর বহির্ভূত রাজস্ব বৃদ্ধি :

আমাদের দেশে কর বহির্ভূত রাজস্বের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মুনাফা, টেলিগ্রাম ও টেলিফোন বোর্ডের আয়, বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত কর্পোরেশনের আয় প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অধিকতর লাভজনক হলেও আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ ক্রমাগত লোকসানে পতিত হচ্ছে। এসব লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে সরকারের কর বহির্ভূত রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যাবে।


৩. আয়কর বৃদ্ধি :

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ করের পরিমাণ অনেক বেশি। পরোক্ষ করের বোঝা অধিকাংশ দেশের গরিব লোকেরাই বহন করে। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে পরোক্ষ করের পরিমাপ আয় বৃদ্ধি না করে ধনিক শ্রেণীর আয়করের পরিমাণ বৃদ্ধি করা উচিত। এতে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির চাপও কিছুটা হ্রাস পাবে।


৪. মূল্য সংযোজন করের (VAT) আওতা বৃদ্ধি :

বর্তমানে VAT এর মাধ্যমে সরকারি আয়ের বড় অংশ অর্জিত হয়। তথাপিও ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার এবং সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে এখানে সরকারি আয় বৃদ্ধির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।


৫. অলস সঞ্চয়ের উপর প্রত্যক্ষ কর :

দেশের বিত্তশালী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ অলস সঞ্চয়ের সৃষ্টি করে। এগুলো উৎপাদনে ব্যবহৃত হতে পারে না। বিত্তশালী জনগোষ্ঠী কর্তৃক সৃষ্ট এসব অর্থ সঞ্চয়ের উপর প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি করতে হবে।


৬. বিদেশ হতে প্রেরিত অর্থের উপর কর :

বর্তমানে অনেক বাংলাদেশী বিদেশে কর্মরত আছে। তারা তাদের আয়ের একাংশ প্রেরণ করছে। সরকার বিদেশে অর্জিত এরূপ আয়ের উপর ক্রমবর্ধমান হারে আয়কর ধার্য করলে সরকারি রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।


৭. কৃষি আয়কর :

আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে অনেক ধনী কৃষক ও ব্যাপারী রয়েছে। এদের সঠিক সম্পদের হিসাব জানা যায় না। তাই এসব লোকের সম্পদের সঠিক হিসাব নির্ণয় করে এদের উপর অবিলম্বে আয়কর ধার্য করা উচিত।


৮.আপ্যায়ন কর :

বর্তমানে আমাদের দেশে আপ্যায়নের উপর কিছু কিছু বিধিনিষেধ প্রচলিত আছে। কিন্তু বাস্তবে এদের প্রয়োগ তেমন দেখা যায় না। বিবাহ, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের আপ্যায়নের উপর কর ধার্য করে সরকারি রাজস্বের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা যেতে পারে।


৯. কর ফাঁকি রোধ :

আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের জনসাধারণের নৈতিক চরিত্রের মান আশানুরূপ নয়। অনেকেই আয়কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। অতএব, কর প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর ফাঁকির প্রবণতা রোধ করতে পারলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বৃদ্ধি পাবে ।


১০.বিশাল দ্রব্যের উপর কর :

অনাবশ্যকীয় ও বিলাসজাত দ্রব্যের আমদানির উপর আরও অধিক হারে আমদানি শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন সরকারের আয় বাড়বে, অন্যদিকে দুষ্প্রাপ্য বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় হবে।


১১. আবগারি শুল্ক :

দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত ক্ষতিকর ও বিলাসজাত দ্রব্য যেমন- মদ, সিগারেট প্রভৃতির উপর আরও অধিক হারে আবগারি শুল্ক ধার্য করতে হবে। এর ফলে সরকারি আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে ঐসব ক্ষতিকর ও বিলাসজাত দ্রব্যের ভোগ হ্রাস পাবে এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে।


খ. বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বৃদ্ধির উপায় :

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা যায়।


১.সঠিক মুদ্রানীতি :

উপযুক্ত মুদ্রানীতির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বেসরকারি সঞ্চয় উৎসাহিত করা যায়। বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা যেতে পারে।


২. রাজস্ব নীতি :

রাজস্ব নীতির প্রয়োগের মাধ্যমেও অভ্যন্তরীণ বেসরকারি সঞ্চয় উৎসাহিত করা যায়। সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিনিয়োগকারীদেরকে উৎসাহিত করার জন্য রাজস্ব নীতির মাধ্যমে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর মওকুফ করা যেতে পারে।


৩. ব্যাংক সার্ভিস উন্নয়ন :

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বেসরকারি সম্পদ আহরণের জন্য ব্যাংক সার্ভিস অতি গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা মানুষের ব্যক্তিগত সঞ্চয় একত্রিত করে মূলধন গঠনে সহায়তা করে। আমাদের দেশেও ব্যাংক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন হলে মানুষের মনে সঞ্চয়ের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে।


৪. শেয়ার মার্কেটের উন্নয়ন :

বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটগুলো এখনও অনুন্নত পর্যায়ে আছে। সুতরাং শেয়ার মার্কেটের উপযুক্ত সংস্কার সাধন করে সঞ্চয়কারীকে শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগে উৎসাহিত করা যায়।


৫. করমুক্ত বিনিয়োগ :

করমুক্ত বিনিয়োগের সুবিধা আরও প্রসারিত করতে হবে। যে আয়ের সাহায্যে শেয়ার বা বস্তু ক্রয় করা হয়, তাকে সম্পূর্ণ আয়কর মুক্ত করা প্রয়োজন ।


৬. শিক্ষা বিস্তার :

উন্নয়নশীল দেশের জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক ও ভৌত উভয় প্রকার উৎপাদনশীল সম্পদ সৃষ্টি করতে হলে প্রয়োজন সামাজিক খাতে ব্যাপক ব্যয়। আর এই ব্যয়নির্বাহের জন্য শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে জনগণকে সঞ্চয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। দেশে যতই শিক্ষার প্রসার ঘটবে, মানুষ ততই নিজের ও সমাজের কল্যাণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে। ফলে তারা সঞ্চয়ে প্রবৃত্ত হবে ।


৭. বিনিয়োগের সুযোগ :

সঞ্চিত অর্থের লাভজনক বিনিয়োগ সম্ভবপর হলে মানুষ সঞ্চয়ে উৎসাহিত হয়। সুতরাং সঞ্চয় বৃদ্ধি করতে হলে আমাদের দেশেও বেসরকারি বিনিয়োগের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে বিনিয়োগের উপর সিলিং তুলে দেওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।


৮. মুদ্রাস্ফীতি রোধ :

অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় সংগ্রহ বৃদ্ধি করতে হলে দেশে মুদ্রাস্ফীতির চাপ স্বাভাবিক রাখতে হবে। মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমলে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পাবে। এতে জনগণের প্রকৃত আয় বাড়বে এবং সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।


৯. সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদান :

দেশে বেসরকারি সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়াতে হলে জনসাধারণকে সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ লক্ষ্যে ব্যাংকের সুদের হার বাড়ালে জনগণের সঞ্চয় বাড়বে। তাছাড়া, বিভিন্ন সরকারি স্কিমের দ্বারাও মানুষকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা যায়। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার প্রাইজবন্ড, প্রতিরক্ষা সঞ্চয় পত্র, বোনাস সঞ্চয় পত্র প্রভৃতি সঞ্চয় প্রকল্প প্রবর্তন করেছেন।


১০. জনসংখ্যা হ্রাস :

জন্ম শাসনের মাধ্যমে জনসংখ্যা হ্রাস করে দেশে মাথাপিছু উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। জনসংখ্যা হ্রাস ও কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায়ও কৃষিক্ষেত্রে উদ্বৃত্তের সৃষ্টি করা সম্ভব। এতে জনগণের সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে ।


উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য ছাড়া আমাদের পক্ষে অগ্রসর হওয়া কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। তাছাড়া, কোন দেশই চিরকাল বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর করে চলতে পারে না। | সুতরাং আমাদেরকেও বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা ক্রমশ হ্রাস করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ ও তাদের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করতে হবে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!