দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্ব আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সুষ্ঠ রাজস্ব নীতির বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কাজটি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে পালন করে প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম “বাংলাদেশ ব্যাংক'। অন্যান্য দেশে বেসরকারি মালিকানাধীন ও মিশ্র মালিকানাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আছে। তবে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানাধীন। দেশের মুদ্রার যোগান এবং ঋণপদ্ধতির ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ এ ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য।

তাছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে সরকারের সার্বিক আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মুদ্রানীতি । মুদ্রা ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক বাজার ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি কাজগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক করে থাকে।


দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্ব আলোচনা কর।


অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা :

বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ এসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সাধারণ কার্যাবলি ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব বহন করতে হয়।

নিম্নে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ভূমিকা আলোচনা করা হল :


১. মুদ্রা বাজারের উন্নয়ন :

বাংলাদেশের মুদ্রা বাজার তেমন উন্নত ও প্রশস্ত নয়। এর ফলে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংককে দেশের মুদ্রা বাজারকে সুসংহত করার জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হয়।


২. ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়ন :

বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা অনুন্নত। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক গুরুত্ব দেশে ব্যাংকসমূহের শাখা বৃদ্ধি পেয়ে ৮৬৮৫টিতে উন্নীত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অনুন্নত ও পল্লি এলাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কৃষি ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা লাভের সময় দেশে ব্যাংকসমূহের মোট শাখার সংখ্যা ছিল মাত্র ১,১৬৯ টি। ডিসেম্বর সাল নাগাদ ব্যাংকের নতুন নতুন শাখা স্থাপনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।


৩. মূলধন গঠন :

মূলধন গঠন হচ্ছে উন্নয়নের চাবিকাঠি। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক মূলধন গঠনে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট। কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশে ঋণের প্রয়োজন এত বেশি যে, সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশ্বে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে ঋণের সম্পূর্ণ চাহিদা মিটানো সম্ভব হয় না।

এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও অন্যা ঋণদানকারী সংস্থাসমূহে আর্থিক সাহায্য প্রদান করে থাকে। এভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকের যাণদান ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।দেশের কৃষি ও শিল্পোন্নয়নে প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহ করে থাকে।


৪. মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ :

বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা একান্ত অপরিহার্য। কারণ মূল্যস্তরের স্থবিরতা যেমন খারাপ, তেমনি লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতিও কারও কাম্য নয়। উন্নয়নের জন্য মৃদু মুদ্রাস্ফীতি উপকারী। আবার অধিক হারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটলে উৎপাদন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে দেশের মুদ্রাস্ফীতি স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করে । বাংলাদেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় ৭.৫৪% বিরাজমান রয়েছে।


৫. ব্যাংক কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ :

বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবসায়ের পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সুযোগ্য কর্মচারীর নিতান্ত অভাব রয়েছে । সুতরাং আমাদের দেশে দক্ষ ব্যাংক কর্মচারী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।


৬. সরকারের ঘাটতি ও ব্যয়নীতি :

বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের সরকারের বাজেটেও ঘাটতি বাজেট বিরাজমান। দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে এ জাতীয় ঘাটতি ব্যয়নীতি অবলম্বন করতে হয়। দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে সরকার এ ঘাটতি পূরণ করে। এছাড়া টাকা ছাপিয়ে, বন্ড বিক্রি ইত্যাদি মাধ্যমে অর্থের যোগান বাড়ানোর মাধ্যমেও সরকার অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাপারে সরকারকে সর্বতোভাবে সহায়তা প্রদান করে থাকে।


৭. সুষ্ঠ ব্যাংক ব্যবস্থা :

দেশের সর্বত্র সুষ্ঠু ব্যাংক ব্যবস্থা বিরাজমান থাকলে জনগণের সঞ্চয় দ্বারা সহজেই মূলধন গঠন করা সম্ভব হয়। আর এ সুষ্ঠু ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। অতএব, দেশের সার্বিক ব্যাংক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করে।


৮. আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা :

দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সক্রিয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের মুদ্রাস্ফীতির চাপ রোধ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল উৎপাদনশীল খাতে ঋণদানের নীতি গ্রহণ করেছে। ঘাটতি ব্যয়ের পরিমাণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্যও সরকার পরামর্শ প্রদান করেছে। ব্যাংক ঋণের উৎপাদনমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ঋণদান নীতি নিয়ন্ত্রণ করে ।


৯. ব্যাংক ব্যবসায়ের প্রসার :

বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করতে হবে। তাই এসব দেশে প্রয়োজনীয় ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই নিতে হয়। আমাদের দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আর্থিক সাহায্যদান ছাড়াও নতুন নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে । এতে ব্যাংকিং সেবারও ব্যাপক প্রসার ঘটছে।


১০. মূলধন বাজার উন্নয়ন :

বর্তমানে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশটি ক্রমশ বাজার অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বাধীন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ স্থাপিত হয়েছে এবং জমে উৎকর্ষতা অর্জন করছে।


১১. পরিকল্পনা প্রণয়ন :

সুষ্ঠ মুদ্রা নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ তত্ত্বাবধানে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন এবং সর্বোত্তম আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতিনীতি প্রবর্তন ও ব্যাপকভিত্তিক কম্পিউটারাইজেশন প্রক্রিয়ায় অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি দক্ষ ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশ্লেষণমূলক নীতি, সুপারিশ, মুদ্রানীতি ইত্যাদি কাজ সুনিপুণভাবে করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা সেল রয়েছে। এ গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিভিন্নভাবে সরকারকে সহায়তা করে থাকে।


উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, স্বাধীনতা লাভের পর অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে একটি সুষ্ঠু ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে এবং দেশের সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থাকে উন্নয়নমুখী করে তুলেছে। বস্তুত স্বাধীনতা উত্তরকালে আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থার কর্মপদ্ধতিতে যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে তার মূলে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সক্রিয় সহযোগিতা।

তাই বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারকে সর্বতোভাবে সহায়তা প্রদান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব বলে বিবেচিত হয়।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!