রসবাহিনীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। রস বাহিনীর উপাখ্যানের আলোকে নন্দীরাজের উপাখ্যানটি আলোচনা কর।
September 27, 2023
Tags
ঐতিহাসিক উপাখ্যান বলতে ইতিহাস আশ্রয়ী আখ্যান, গল্প, লোককথা ইত্যাদিকে বোঝায়। এ জাতীয় উপাখ্যান ইতিহাসের চুলচেরা নিয়ম অনুসরন করে না। এগুলো রুপকথার মত আকর্ষনীয় কাহিনী বটে কিন্তু কাহিনীর ভিত্তি বা প্রেক্ষাপট ঐতিহাসিক হওয়া ব্যঞ্চনীয়। ঐতিহাসিক কোন ব্যক্তি ফল বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে কাহিনী সৃষ্টি হয় তাই ঐতিহাসিক উপাখ্যান।তবে সব চরিত্র বা ঘটনা ইতিহাস ভিত্তিক সব সত্যের উপর নির্ভর করেনা। পালি সাহিত্যে এরকম অনেক উপন্যাস বা গ্রন্থের সৃষ্টি হয়েছে। এসব গ্রন্থগুলোর মধ্যে রসবাহিনী অন্যতম৷
রসবাহিনী সহজ-সরল পালি গদ্য ও পদ্য লিখিত একটি গল্প সংকলন। এতে সর্বমোট ১০৩ টি বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক এবং বৌদ্ধধর্মের প্রেক্ষাপটে রচিত কাহিনী সংকলিত হয়েছে।তবে বেশ কিছু সংখ্যক গল্প ঐতিহাসিক তথ্যপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুতত্বপূর্ণ।
পালি ভাষায় রচিত এই গল্প সংগ্রহটির রচনাকাল নিয়ে ঐতিহাসিক পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান।তবে ধারনা করা হয় যে,এই ইতিহাস সাশ্রয়ী গল্পগ্রন্থখানি সম্ভবত খৃষ্টীয় চতুৰ্দ্দশ শতাব্দীতে প্রথমার্দ্ধে রচিত।
রসবাহিনীর রচনাকারকের নাম হচ্ছে বিদেহ।তার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না।তবে ধারনা করা হয় তিনি সিংহলের বনবাসী নিকায়ের অনুসারী ছিলেন।রসবাহিনীর কাহিনীগুলো প্রধানত দুই অংশে বিভক্ত যথা- জম্বুদ্বীপের কাহিনী ও সিংহলের কাহিনী। এর মধ্যে জম্বুদ্বীপের কাহিনী ৪০ টি এবং বর্গ সংখ্যা দশটি।সিংহলের কাহিনী ৬৩টি।এই অংশের কাহিনীগুলোর মধ্যে শেষ তিনটি গল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
কথিত আছে যে পদমুত্তর বুদ্ধের সময় এক কুটুম্বিক ভগবান ভগবান পদুমুত্তর বুদ্ধের ধর্মীয় দেশনা শ্রবণ করে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে পদুমুত্তর বুদ্ধসহ ভিক্ষুসঙ্গকে নিজ গৃহে নিমন্ত্রন করে উত্তম আহার প্রদান করেন।সেই সময় পদুমুত্তর বুদ্ধের ভিক্ষুসংঘের মধ্যে অগ্রগণ্য মহাশ্রাবক বাসবথের কুটুম্বিকে গৃহে ভিক্ষান্নের জন্য উপস্থিত হন। এবং কুটুম্বিক ভিক্ষু বাসব থেরকে অত্যন্ত সমাদরে আতিথ্য প্রদান করেন।
ভোজন শেষে কুটুম্বিক ভগবানের কাছে ভগবানের সমমান কোন লোক আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে ভগবান বলেন যে-যে মুনীগণ পরিশুদ্ধভাবে প্রাতিমোক্ষ এবং প্রতিপালন করেন ধুতাঙ্গ ব্রত পালন করেন,পূণ্য কর্ম সম্পাদন করেন, সাধারন যীবন যাপন করেন,উপাসকদের নিমন্ত্রন ইচ্ছা পোষণ করেন,অল্পতেই সন্তুষ্ট হন,সংসার ধর্ম পরিত্যাগ করেন,পাপমুক্ত হয়ে বাস করেন তারাই ভগবানের সদৃশ্য। এই বলে বাসভ থের স্থবিরের দিকে নির্দেশ করলে কুটুম্বিক এরুপ গুনের কথা শ্রবণ করে মুগ্ধ হয়ে ভগবানের পাদমূলে নত হয়ে ধুতাঙ্গাধারীদের অগ্রপদ প্রার্থনা করেন এবং ভগবান বুদ্ধ জ্ঞাত হলেও সে কুটুম্বিক গৌতম বুদ্ধের সময়ে মহাকশ্যপ নামে অগ্র ধতাঙ্গধারী হবেন।
পরে কুটুম্বিক মৃত্যুর পর দেবঐশ্বর্য ভোগ করে বিপসশী বুদ্ধের কাছে এক মহাদান করেন। সেখান হতে মৃত্যুর পর কাশ্যপ বুদ্ধের সময়ে শ্রেষ্ঠী হয়ে জন্ম নিয়ে দান কর্ম সম্পাদন করেন।সেই সময় কুটুম্বিক এক অরন্যচারী প্রত্যক্ষ বুদ্ধকে ছিন্ন চীবর সেলাই করতে দেখে নিজের চাদর দান করেন। এভাবে কুটুম্বিক তার দানকার্য সম্পাদন করে মৃত্যুর পর তাকতিংস স্বর্গে উৎপন্ন হন এবং শেষ জন্মে বারানসী নগর হতে তিন যোজন দূরের একটি স্থানে নন্দী নামে জন্মগ্রহন করেন।
তার সাত ভাইবোনের মধ্যে অন্যরা নানাবিধ কাজ কর্ম করে মাতাপিতাকে প্রতিপালন করলেও নন্দী ছিলেন অকর্মণ্য।নন্দী তার বাড়ি থেকে বের হয়ে এক বনিকের গৃহে উপস্থিত হয় এবং ঐ গৃহে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে এক স্বপ্ন দেখলেন যে সমগ্র জম্বুদ্বীপ তার মুখ দিয়ে প্রসারিত হচ্ছে এবং কে যেন গর্ভ অভ্যন্তরে প্রবেশ করল।নন্দী ভয়ে চিৎকার করে ।বনিককে তার স্বপ্নের কথা জানালে বনিক তার কূল পরিব্রাজককে এর অর্থ জিজ্ঞেস করেন এবং এর অর্থ অনুধাবন করতে পেরে নন্দী রাজা হবেন এই চিন্তা করে তার ছোট মেয়ের সাথে বিবাহ দিয়ে নন্দীকে প্রচুর সম্পত্তি দেন ৷
তারপর বিয়ে সপ্তম দিন পর একদিন নন্দী ঘুরতে ঘুরতে রাজা উদ্যানে উপস্থিত হন সেদিন ছিল বারানসী রাজ্যের মৃত্যুর সপ্তম দিবস এবং রাজসিংহাসন তখনো শূণ্য ছিল।রাজা বিহীন রাজ্য থাকতে পারে না চিন্তা করে রাজার মন্ত্রী আমত্যগণ পুষ্পরথ সজ্জিত করে চারটি সিন্ধু ঘোটক ছেড়ে দেন এবং ঘোষনা করেন যে আহোরন করতে সমর্থ হবেন তিনিই রাজা হবেন এবং বারানসী রাজের একমাত্র কন্যার সহিত তার বিবাহ প্রদান করা হবে।ভাগ্যের ফলপ্রসূত নন্দী সেই রথে আহোরন করতে সমর্থ হন এবং তাকে বারানসী রাজা নির্বাচিত হন।
নন্দী রাজ রাজত্ব লাভ করার পর তার দেবীর পরামর্শে দান কর্ম সম্পাদন করতে শুরু করেন এবং পাঁচশত প্রত্যক প্রত্যক বুদ্ধকে তার প্রাসাদে আমন্ত্রন করে উতত্তমভাবে দান কর্ম সম্পাদন করেন।তাদের জন্য বাস স্থান নির্মাণ করলেন।প্রত্যকবুদ্ধদের মৃত্যুর পর তাদের ধাতু নিয়ে চৈত্য নির্মাণ করলেন এবং শেষ জীবনে চিন্তা করলেন যে এরুপ মহৎ মহানুভব মহাত্মাদের মৃত্যু যেখানে নিশ্চিত সেখানে আমাদের কথা কি। এরুপ সংবেগ উৎপন্ন হলে তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্রকে রাজ্যভার অর্পণ করে নিজে প্রব্রজ্জিত হয়ে উদ্যানে উভয়ে ধ্যানস্থ হয়ে ধ্যান-সুখ উপভোগ করেন এবং আয়ুশেষে ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হন।
এই উপখ্যানটি পড়ে আমরা এটিই জানতে পারি যে, পূণ্যের ফল বিষ্ময়কর। নন্দীরাজ তার বিভিন্ন জীবনে অশেষ পূণ্য সংশয় করে পরবর্তীতে ভগবান গৌতম বুদ্ধের সময় তার অন্যতম অগ্রমহাশ্রাবক মহাকশ্যপ হয়ে জন্ম নেন।