বিশাখা কে? “ বিশাখানারী সমাজের একজন আদর্শ মহিলা” এই উক্তিটির যথার্থতা প্রতিপাদন কর ।

admin

ভূমিকা:

বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে এমন কিছু নারী পুরুষ আছেন যারা আজও নানা কারনে স্মরনীয় ও বরনীয় হয়ে আছেন।তারা বুদ্ধের ধর্মের প্রতি অনুপ্রানিত হয়ে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন।অনেকে আবার গৃহী জীবন যাপন করেও বৌদ্ধ ধর্মের ও বুদ্ধের অনুসারী সংঘের সেবা করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে তারা বিশিষ্ট বৌদ্ধ নামে খ্যাত। এদের মধ্যে মহাপূণ্যবতী,শীলাবতী ও মিগারমাতা বিশাখার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।তিনি মহাউপাসিকা নামেও পরিচিত।তিনি শুধু একজন বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন না,তিনি ছিলেন একজন নারী সমাজের আদর্শ মহিলাও।



বিশাখার পরিচয়:


বুদ্ধের সময়ে অঙ্গরাজ্যের ভদ্দিয় নগরে মহাপূণ্যবতী বিশাখার জন্ম।তার পিতার নাম ছিল ধনজয় শ্রেষ্ঠী এবং মাতার নাম ছিল সুমনাদেবী।বিশাখার পিতামহ ছিলেন ভদ্দিয় নগরের ধনবান মেস্তক শ্রেষ্ঠী।তারা অত্যন্ত ধার্মিক এবং দান ও সেবাপরায়ন ছিলেন।কথিত আছে বিশাখার বয়স যখন সাত বছর ছিল তখন তিনি বুদ্ধের সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং বুদ্ধের অমৃতময় ধর্ম উপদেশ শ্রবণ করে স্রোতাপত্তি ফল লাভ করেন।


কালক্রমে বিশাখা বিবাহ যোগ্য হয়ে ওঠেন।পিতামাতা তার বিয়ের জন্য তৎপর হলেন।এই মিগার শ্রেষ্ঠীর পূন্যবর্ধন নামে এক পুত্র ছিল। পারিবারিক উদ্যোগে পূণ্যবর্ধনের সাথে বিশাখার বিয়ে হয়।বিশাখার বাবা বিশাখাকে বহু দাস দাসী, রথ ও মহামূল্য মনিমুক্তা উপহার দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে পাঠান।


বিশাখা নারী সমাজের আদর্শ মহিলা বিশাখা ছিলেন একজন আদর্শ নারী আর এ আদর্শের সত্যতা প্রতিফলনের জন্য আমরা তার নিকট যে আদর্শিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুনাবলী দেখতে পায়,তাতে বুঝা যায় যে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মহিলা।নিম্নে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুনাবলী আলোচনা করা হলো।



বিশাখার গৌতম বুদ্ধের ভক্ত:

মিগার শ্রেষ্ঠী সাতদিন ব্যাপী পুত্রের বিবাহ উৎসব পালন করেন।স্বয়ং কোশলরাজ সৈন্যসামন্তসহ বর যাত্রী রূপে বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন।মিগার শ্রেষ্ঠী নিগ্রন্থ উলঙ্গ জৈন ধর্মালম্বী ছিলেন।গুরু পূজা উপলক্ষে বিশাখাকে উলঙ্গ সন্যাসীর সামনে নিয়ে গেলেন।এতে বিশাখা বিরক্ত বোধ করলেন।নিগ্রন্থ সন্যাসী বিশাখার ভাব বুঝতে পেরে শ্রেষ্ঠীকে বললেন,এই রমনী গৌতমের শিষ্য, একে ঘর থেকে বের করে দাও।তা না হলে তোমার সর্বনাশ হবে।


বিশাখার পিতার উপদেশ রক্ষা:

বিশাখার বিয়ের সময় পিতা ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠী বিশাখাকে দশটি উপদেশ দিয়েছিলেন।বিশাখা সেগুলো শ্বশুরবাড়িতে অটুটভাবে পালন করতে সক্ষম হন।বিশাখাকে পিতা যে দশটি উপদেশ দিয়েছিলেন তা নিম্নরুপ:-

১.শ্বশুরকুলে বাস করার সময় ঘরের আগুন বাইরে নিওনা।

২.বাইরে আগুন ঘরে এনো না।

৩.যে দেয় তাকে দেবে।

৪.যে দেয় অথবা না দেয় তাকেও দেবে।

৫.যে দেবে না তাকে দেবে না। ৬.সুখে আহার করবে।

৭.সুখে উপবেশন করবে।

৮.অগ্নি পরিচর্যা করবে। ৯.সুখে শয়ন করবে।

১০.শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ও স্বামী প্রভৃতি গুরুজনদের দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করবে।


বিশাখার জনসেবা:

বিশাখা ছোটকাল থেকে জনসেবা এবং দানের প্রতি অনুরাগী ছিলেন।তার পিতা ও বিশাখার শিক্ষা দীক্ষার প্রতি বিশেষ যত্নশীল ছিলেন।তিনি বিশাখার দ্বারাই দান করে আনন্দ পেতেন।বিশাখা দরিদ্র ও পীড়িতের দুঃখ দূর করার জন্য নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখতেন এবং দরিদ্র মানুষগুলো তার সেবায় মুগ্ধ হতেন ৷


পঞ্চকল্যানবতী নারী:

বিশাখা পঞ্চকল্যানবতী নারী ছিলেন। পঞ্চকল্যান গুলো নিম্নে দেওয়া হল:-

১. কেশ কল্যাণ

২.মাংস কল্যাপ ৩.অস্থি কল্যাপ ৪. ছবি কল্যাণপ

৫. বয়স কল্যাণ


ধর্মীয় জীবনে আদর্শময়ী নারী:

ধর্মীয় জীবনে বিশাখা এক আদর্শময়ী নারী ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই।তিনি সবসময় দানকর্ম, ভিক্ষুসংঘকে সেবা করতেন এবং মাত্র সাত বছর বয়সে বুদ্ধের নিকট ধর্ম শ্রবণ করে স্রোতাপত্তি ফল রাভ করেন। সেই থেকে বিশাখা বুদ্ধের একনিষ্ঠ শ্রদ্ধাবান উপাসিকা হন।


বিশাখারসংসারের প্রতি কর্তব্য:

বিশাখা ছিলেন সাংসারিক কর্তব্যের এক আদর্শ নারী।তিনি শ্বশুর বাড়িতে যাবার পর থেকে সংসারের সমস্ত কাজ নিজ দায়িত্বে তদারকি করতেন এবং সংসারের প্রতি তার যে দায়িত্ব তা পালন করতে করতে চেষ্টা করতেন।তার দায়িত্ব দেখে তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ী অত্যন্ত খুশি হতেন।






ত্রিরত্নের প্রতি শ্রদ্ধাশীলা:

একদিন মিগার শ্রেষ্ঠী মহাপালঙ্কে বসে মধুপায়েস খাচ্ছিলেন।এমন সময় এক পিন্ডাচারী বৌদ্ধভিক্ষু মিগার শ্রেষ্ঠীর বাড়িতে ভিক্ষার জন্য আসেন।শ্রেষ্ঠী তাকে দেখেও কোন কিছু দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন না।শ্বশুরের অনুমতি ছাড়া বিশাখার পক্ষেও কোনকিছু দেওয়া সম্ভব নয়।তখন বিশাখা আগন্তুক ভিক্ষুককে বললেন,ভন্তে আপনি অন্যত্র যান।আমার শ্বশুর বাসি খাবার খাচ্ছেন।মিগার শ্রেষ্ঠী একথা শুনে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হলেন।বিশাখাকে বললেন তুমি এ বাড়ি থেকে চলে যাও।তিনি বিশাখাকে বের করে দিতে দাসদাসীদের আদেশ দিলেন।


কিন্তু বাড়ির অন্তঃপুরের সকলেই ছিল বিশাখার ভক্ত। একথা শুনে বিশাখা বললেন, আমি ক্রীতদাসী নই আমাকে ইচ্ছা করলে তাড়িয়ে দেওয়া যায়না। আমার পিতা ৮ জন সম্ভ্রান্ত নীতিজ্ঞলোককে সাক্ষী করেই আমাকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়েছেন।তাদের আহ্বান করুন।বিচারে বিশাখাকে ঐরুপ কারন জানতে চাওয়া হয়।উত্তরে বিশাখা বললেন, আমার শ্বশুর বাসি খাবার খাচ্ছেন বলার অর্থ এই যে,তিনি পূর্বজন্মের পূণ্যফলের প্রভাবে অর্জন করা খাবার খাচ্ছেন। ভবিষ্যতে ভোগ করার মত কোন পূণ্য তার শ্বশুর সঞ্চয় করছেন না। এ অর্থে বিশাখা পুরনো বাসি খাবার খাচ্ছেন বলেছেন। এতে তার শ্বশুর নিজের ভুল বুঝতে পারেন। এতে বুঝা যায় যে,বিশাখা ত্রিরত্নের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল ও কর্মফল বিশ্বাসী ছিলেন।


বিশাখা কর্তৃক মহালতা প্রসাধন দান:

বিশাখা অতীতের অষ্টপরিষ্কার দানের ফলে বর্তমান জন্মে মহালতা প্রসাধন লাভ করেছিলেন।বিশাখা একদিন ধর্ম শ্রবনের নিমিত্তে জেতবন বিহারে গিয়ে মহালতা প্রসাধনটি রেখে এসেছিলেন।এতে পুনরায় দাসীকে মহালতা প্রসাধনটি আনার নিমিত্তে পাঠালেন এবং বিহারে আনন্দ স্থবির মহালতা প্রসাধনটি সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন।দাসী এসে উক্ত ঘটনাটি বিশাখাকে বললে বিশাখা তার মূল্যবান অলংকারটি দান করার জন্য সংকল্প করলেন এবং বিহার নির্মানের নিমিত্তে বুদ্ধ প্রমূখ ভিক্ষুসংঘকে দান করেছিলেন।


বিশাখার পূর্বারাম বিহার নির্মান ও দান:

বিশাখা ছিলেন দানশীল এক নারী।বিশাখা মহালতা প্রসাধনটির মূল্যের বিনিময়ে নয় কোটি টাকার বিনিময়ে শ্রাবস্তীর পূর্বারাম বিহারটি নির্মান করেন এবং বুদ্ধ ও তার ভিক্ষুসংঘের বসবাসের নিমিত্তে তা বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্যে দান করেছিলেন।কথিত আছে যে বুদ্ধ এই পূর্বারাম বিহারে তার দ্বিতীয় বর্ষা যাপন করেছিলেন।


বিশাখার "মিগারমাতা" উপাধি লাভ:

একদিন বিশাখা পিতৃগৃহে চলে যেতে প্রস্তুত হলেন।তখন মিগার শ্রেষ্ঠী নিজের দোষ স্বীকার করে বিশাখাকে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। তখন বিশাখা বললেন, আপনি যদি আমাকে ইচ্ছামত দান করতে এবং ধর্মকথা শুনতে অনুমতি দেন তবে থাকতে পারি।এতে মিগার শ্রেষ্ঠী রাজি হলেন। বিশাখা একদিন শ্বশুর বাড়িতে বুদ্ধ প্রমূখ ভিক্ষুসংঘকে নিমন্ত্রন করেছিলেন।সেই খবর পেয়ে মিগার ঘরের ভিতর লুকিয়ে বসলেন।


এদিকে বিশাখা দান কার্য সমাপ্ত করে মিগার শ্রেষ্ঠীকে বুদ্ধের অমৃতময় ধর্মদেশনা শুনার জন্য ডাকলেন কিন্তু তিনি আসলেন না।কারন তিনি উলঙ্গ সন্যাসীদের ভক্ত।তখন বুদ্ধ বললেন, শ্রেষ্ঠী আপনি পর্দার আড়ালে প্রাচীরের অন্তরালে, পাহাড়ে অন্তরালে অথবা দিকচক্রবালের অন্তরালে যেখানেই বসুন না কেন, আমার শব্দ সর্বত্র ঘোষিত হবে। এই বলে মহাকারুনিক বুদ্ধ ধর্মদেশনা শুরু করলেন।বুদ্ধের দেশনা শেষ হলে শ্রেষ্ঠী স্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হন।তারপর তিনি বুদ্ধের সামনেই পুত্রবধু বিশাখাকে জ্ঞানদায়িনী মাতা বলে সম্বোধন করে বললেন, যা তুমি এতদিনে এই সন্তানকে উদ্ধার করলে। সেই থেকে বিশাখাকে মিগারমাতা বলে সম্বোধন করা হয়।


বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন বিশাখা:

একদিন বিশাখা রাতে আলো নিয়ে ঘরের বাইরে গিয়েছিলেন। অশ্বশালায় ঘোড়ার বাচ্চা প্রসবের খবর নেওয়ার জন্য তখন তার শ্বশুর বিশাখাকে বললেন, তোমার পিতা তোমাকে ঘরের আগুন বাইরে না নেওয়ার জন্য বলেছিলেন।কিন্তু তুমি ঘরের আগুন বাইরে নিয়ে যাচ্ছ কেন?তখন বিশাখা বললেন,ঘরের আগুন বলতে নিজ গৃহের নিন্দা ও কুৎসা বাইরে প্রকাশ না করা। এরপর বিশাখা বাবার দেয়া অন্য উপদেশও ব্যাখ্যা করে দিলেন। এতে বুঝা যায় যে বিশাখা ছিলেন একজন বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন নারী।


উপসংহার:

আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, বিশাখা ছিলেন একজন আদর্শ নারী।তিনি ছিলেন ধৈর্য্যশীল,সাহসিক,ধর্মপরায়ন,শীলবান,বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন নীতিবান-যা আধুনিক সমাজের মধ্যে বিশাখার মত মহিলা পাওয়া বিরল।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!