বুদ্ধঘোষ কে ছিলেন? একজন অর্থকথাকার হিসেবে বুদ্ধঘোষের মূল্যায়ন কর।

admin

ভূমিকা:

পালি সাহিত্যের ইতিহাসে বুদ্ধঘোষের নাম চির স্মরনীয় হয়ে থাকবে।তার পান্ডিত্য ,ভঙ্গী,শব্দ,সংকলন,রচনার পরিপট্য,শব্দের সংহতি এবং বর্ণন কুশলতা অনন্য সাধান।অভিধর্ম পিটকের সমস্ত জটিল বিষয়গুলো তিনি অত্যন্ত সহজ ও সরল করে পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপন করেন। এজন্য পাঠক তার গ্রন্থ অতি উৎসাহের সঙ্গে পড়তে এবং জ্ঞান আহরন করতে উৎসাহিত হন।এমন একজন অনন্য সাধারন প্রতিভাবান শুধু পালি সাহিত্যে নয় সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল।

বুদ্ধঘোষ কে ছিলেন

বুদ্ধঘোষের পরিচয়:

অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় যে,বৌদ্ধ সাহিত্যের অনন্য লেখকদের মত বুদ্ধঘোষের আত্মজীবনী সম্বন্ধে ও বিশেষ কিছু জানার উপায় নেই।বৌদ্ধ সাহিত্যের বিভিন্ন স্থান থেকেও কতগুলো প্রবাদ এবং কিংবদন্তিদের জীবনে ইতিহাস থেকে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়।এভাবে মহাবংশের সপ্তবিংশতী অধ্যায়ের দ্বিতীয়াংশে বুদ্ধঘোষ সম্বন্ধে কিছু ধারনা পাওয়া যায়। মহাবংশের এ অধ্যায়টির কিছুটা শুধু রচনা বলে প্রমাণিত হলেও পন্ডিত মহলে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন নি।গন্ধবংশে অভিধর্ম পিটকের অর্থকথা গুলিকে একত্রে পরমথকথা নাম দেওয়া হয়েছে।জাতক অর্থকথা ও বুদ্ধ ঘোষের রচনা বলিয়া কথিত আছে।


বুদ্ধঘোষ প্রনীত অর্থকথাগুলির ত্রিপিটকের গ্রন্থাদির বিষয়বস্তু ও ব্যবহৃত শব্দগুলির বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা ছাড়াও ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট।বুদ্ধঘোষুপ্পতি গন্ধবংশ,সাসনবংশ,সদ্ধমবংশ প্রভৃতি গ্রন্থে তার সত্যতা প্রমাণ করে।প্রাচীন ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের বহু উপাদান ইহাদের মধ্যে পাওয়া যায়।যেমন সমস্ত পাসাদিকার ভমিকায় মৌর্য সম্রাট অশোকের কাহিনী,তৃতীয় সংগীতি ও বহির্বিশ্বে প্রচারক প্রেরনের বিতরন ইহাতে লিপিবদ্ধ আছে। সুমঙ্গলবিলাসিনীতে শাক্যবংশের উৎপত্তি কথা আলোচিত হয়েছে। ঐতিহ্যসমূহে বুদ্ধঘোষের জন্মস্থান সম্পর্কে দু ধরনের তথ্য পাওয়া যায়।


বৌদ্ধসাহিত্যে অর্থকথাকার:

অটঠকথা ত্রিপিটক রচনার পরে বৌদ্ধ সমাজে অর্থকথার রচনা শুরু হয়েছিল।ভারতীয় ও সিংহলী পন্ডিতগণ টীকা রচনার ব্রতী হয়েছিলেন। পরবর্তী কালে ব্রহ্মদেশীয় ভিক্ষুগণ টীকা রচনা করেন।সে সব অর্থকথা রচয়িতা বা ভাষ্যকারদের মধ্যে বুদ্ধদত্ত, বুদ্ধঘোষ ধম্মপালনের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া চুল্লধম্মপদ,উপসেন,মহানাম,অনুরুদ্ধ প্রমূখ আরও বহু বিশিষ্ট ভাষ্যকার টীকা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।


শ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রধান অর্থকথাকার:

বৌদ্ধ সাহিত্যে যে প্রধান তিনজন অর্থকথা রচয়িতাদের কথা বলা হয়েছে তারা হলেন-বুদ্ধঘোষ,বুদ্ধদত্ত ও ধর্মপাল। এই তিনজন অর্থকথা রচয়িতাদের মধ্যে বুদ্ধঘোষকে শ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রধান বলে গণ্য করা হয়েছে।পালি সাহিত্যের ইতিহাসে অনন্য সাধারন অবদান চিরস্মরনীয়।বৌদ্ধ ঐতিহ্য মতে তিনি সর্বাধিক ত্রিপিটক গ্রন্থাবলির উপর অর্থকথা রচনা করেছিলেন।তার রচনাভঙ্গী,শব্দ নির্বাচন ও সংহতি এবং নিপুন রচনা শৈলী অতুলনীয়।অভিধর্মের দুরূহ ও জটিল বিষয়গগুলো তার বচনকুশলতায় পাঠকের নিকট অনেক বোধগম্য হয়েছে।বুদ্ধের সমগ্র ধর্মতত্ত ও অভিধর্মের সার স্বরুপ তার রচিত বিসুদ্ধি মাগগো একটি অসাধারন গ্রন্থ।

 

অর্থকথার রচনা:

বুদ্ধঘোষের ভিক্ষু বেরতের সাথে থাকাকালীন সময়ে তিনি জ্ঞানোদয় ও অত্থসাসাহিনী গ্রন্থ দুটি রচনা করেন এবং সে সময়ই বুদ্ধঘোষ পরিত্ত অটঠকথা নামক ত্রিপিটকের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য রচনা করেন।এরপর বেরতের পরামর্শে সিংহল রাজা মহানামের রাজত্বকালে সিংহলে গমন করে স্থবির সংঘপালের তত্ববধানের মহা বিহারে সিংহহলী অটঠকথা অধ্যায়ন করেন এবং বিসুদ্ধি মগ্ন গ্রন্থটি রচনা করেন।ইহাতে মহা-বিহারস্থ স্থবিরের সম্মতি লাভ করে উক্ত অটঠকথা পালি ভাষায় অনুবাদ করেন। এই সময় তিনি "পন্দাকর"বিহারে অবস্থান করেন এবং অনুবাদ কার্য সম্পন্ন হলে জম্বুদ্বীপে প্রত্যাবর্তন করেন।


সময়কাল:

চুলবংসে বর্ণিত ঘটনাসমূহের সঙ্গে বুদ্ধঘোষ প্রনীত অটঠকথা বর্ণিত ঘটনার ও সময়কাল খুবই সাদৃশ্য। এই হিসেবে তার কার্যাবলির সময় খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর সময়।

বুদ্ধঘোষের রচিত অর্থকথাগুলি যে বিপুল সংখ্যক গ্রন্থের রচয়িতা বলে বৌদ্ধ ঐতিহ্য উল্লেখিত রয়েছে তা সত্য হলে বুদ্ধঘোষ ছিলেন গভীর ও ব্যাপক পান্ডিত্যের অধিকারী। অর্থকথা সাহিত্য রচনার তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।গন্ধবংসের মতে,বুদ্ধঘোষের নিম্নলিখিত অটঠকথা গ্রন্থাবলি রচনা করেছিলেন। যথা:-


১.সমস্ত পাসাদিকা (বিনয়পিটক অর্থকথা)

২.বশট কঙ্খাবিতরনী (পাতিমোকখ)

৩. সুমঙ্গলবিলাসিনী (দীর্ঘ নিকায়)

৪.পপঞ্চসূদনী (মধ্যম নিকায় )

 ৫.সারথপ্রকাশনী (সংযুক্ত নিকায় 

৬. মনোরথ পূরনী (অঙ্গুত্তর নিকায় )

৭.পরমখাজোতিকা (খুদ্দক পাঠ ও সুত্তনিপাত) 

৮.অত্থসালিনী (ধম্ম সংগনি

৯.সম্মোহবিনোদনী (বিভঙ্গ)

১০.পঞ্চ পকার অটঠকথা (অভিধর্ম পিটকের অবশিষ্ট)

ধাতুকথা,যমক, পুরলপঞ্চঞ্চতি,কথাবন্ধু পটঠান প্রভৃতি পাঁচ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত অর্থকথা)


গন্ধবংশ অভিধর্ম পিটকের অর্থকথাগুলোকে একত্রে পরমন্থকথা নাম দেয়া হয়েছে। জাতক অটঠকথা,ধম্মপদ অটঠকথা ও অপদান অটঠকথা বুদ্ধঘোষ রচনা করে কথিত আছে।


বিসুদ্ধিমগ্ন:

বিসুদ্ধি মার্গ বুদ্ধঘোষের একটি অনবদ্য গ্রন্থ।চুল্লবংস মতে সিংহলী অটঠকথা সম্পূর্ণ অবিগত হবার পর কখন বুদ্ধঘোষ স্থবির সংঘপালের অনুরোধ ঐ অর্থকথা পালি ভাষায় অনুবাদ করতে চাইলেন তখন মহাবিহারের ভিক্ষুগণ তাকে পরীক্ষা করার জন্য গাথা বলে সেইগুলোর উপর ব্যাখ্যা পুস্তক লিখতে বলেন। গাথা দুটি হলো-

সীলে পতিটঠনি মারো সপঞঞো চিত্তং পঞঞং চ'জারয়ং

আতপী নিপকো ভিক্ষু:সো ইমং বিজটয়ে জটং তি

অস্তো জটা,বহি জটা, জটায় জটিকা পজা

তং তং গোতম,পুছামি কো ইমং বিজটয়ে জটংতি


এ গাথাগুলোর উপর ভিত্তি করে গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিসুদ্ধি মগ্ন অটঠকথাসহ ত্রিপিটকের সংক্ষিপ্ত রুপ বুদ্ধ বচনের সার গ্রন্থ। এতে বুদ্ধের নির্বানোপলব্ধি সম্পর্কীয় উপদেশসমূহ পরিচ্ছেদ আলোচিত হয়েছে।


এ গ্রন্থটি তিনটি অংশে বিভক্ত। যথা:-শীল নির্দেশ,চিত্ত বা সমাধি নির্দেশ ও প্রজ্ঞা নির্দেশ।বিসুদ্ধি অর্থ নির্বানকে বুঝায়,ভাবের প্রকৃষ্ট উপায়কে বুঝায়। সুতরাং বিসুদ্ধি বা নির্বানের কথা বৌদ্ধ সাহিত্যে অর্থকথার বুদ্ধঘোষের অবদান:বৌদ্ধ সাহিত্যে অর্থকথাকার বুদ্ধঘোষের অবদান অপরিসীম।তিনি যে বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেছেন তা বৌদ্ধ সাহিত্যে এখনও উজ্জল নক্ষত্রের মত জল জল করছে।তার প্রতিটি গ্রন্থ বৌদ্ধ সাহিত্য সমৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছে।যে উদ্দেশ্যে বৌদ্ধ সাহিত্যে অর্থকথার সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ করছেন বুদ্ধঘোষ তার সহজ সরল,সুন্দর সারলীল লেখার মাধ্যমে। 


অর্থকথা রচয়িতায় তিনি অদ্বিতীয়।আচার্য বুদ্ধঘোষ বিনয় পিটক অটঠকথা সমস্ত পাসাদিকার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।যে অটঠকথাই তার গ্রন্থটি রচনার উৎস সেই অটঠকথা সিংহলী ভাষায় রচিত। স্থবির বুদ্ধসিবির পরামর্শক্রমে ভিক্ষুদের বোধগম্য করবার জন্য তিনি সেই অটঠকথা পালি ভাষায় অনুবাদ করেন। তার রচনার প্রধান উৎস মহা অটঠকথা।কিন্তু মহাপচ্চরী অটঠকথা,করুদী অটঠকথা প্রভৃতি অন্যান্য অটঠকথা হইতে তিনি উপাদান সংগ্রহ করেন।চুল্লপচ্চরী,অন্ধঅটঠকথা, সংক্ষেপ অটঠকথা প্রভৃতি অটঠকথার উল্লেখ পাওয়া যায় সমস্ত পাসাদিকার দুটি টীকা বজির বুদ্ধি ও সারাদীপনীতে।


উপসংহার:

বুদ্ধঘোষ প্রনীত অটঠকথাগুলির ত্রিপিটকের গ্রন্থাদির বিসয়বস্তুর ও ব্যবহৃত শব্দগুলির বিশ্লেষণ ও ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট। প্রাচীন ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের বহু উপাদান ইহাদের মধ্যে পাওয়া যায়। যেমন সমস্তপাসাদিকার ভূমিকায় মৌর্য অশোকের কাহিনী ৩য় সংগীতির ও বহির্ভারতের বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক প্রেরণ বিবরন ইহাতে লিপিবদ্ধ আছে।সুমঙ্গলবিলাসিনীতে শাক্যবংশ উৎপত্তির কথা আলোচিত হয়েছে।বুদ্ধঘোষের গ্রন্থাবলীর মধ্যে বিসুদ্ধি মঞ্চের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যায়।

 

 

 

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!