সমাধি কী? সমাধির গুরুত্ব আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা: পালি সাহিত্যের ইতিহাসে ত্রিপিটক বহির্ভূত যেসব গ্রন্থ বিদ্যমান তাদের মধ্যে বিশুদ্ধমার্গ অন্যতম।এ গ্রন্থটি প্রখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিত আচার্য বুদ্ধঘোষ রচনা করেন।বিভিন্ন পন্ডিতের মতে, গ্রন্থটি বিনয়,সূত্র অভিধর্ম পিটকের সারসংক্ষেপ।এ গ্রন্থের মূল বিষয় বস্তৃকে তিনটি অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।সেগুলো হচ্ছে শীল,সমাধি প্রজ্ঞা।যদিও এখানে শীল সমাধির শ্রেণিবিভাগ গুরুত্ব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হলেও প্রজ্ঞার দ্বারা গ্রন্থের আলোচনা সমাপ্ত হয়।তবে এদের মধ্যে সমাধির গুরুত্ব অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।যার আলোকে গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তুকে মূল্যায়ন করা যায়


সমাধি: 

ত্রিপিটক অনুসারে সমাধি হলো কুশল চিত্তের একাগ্র নিস্তর অবস্থ।চিত্তের একাগ্রতা সাধনই সমাধি।সাধারনত চিত্ত চঞ্চল ইতস্ততঃ বিচরনশীল।নানা বিষয়ে চিত্ত বিক্ষিপ্ত থাকে।কাজেই চিত্তকে সংযত করতে না পারলে জগতে কোন কাজই সিদ্ধ হয়না।বিক্ষিপ্ত চিত্তে সদ্ধর্ম দর্শন অসম্ভব।সেই বিক্ষিপ্ত চিত্ত বা মনকে নির্দিষ্ট ধ্যান নির্দিষ্ট করাই হচ্ছে সমাধি।সকল প্রকার কুশলকর্ম সমাধিমূখী বা সমাধির দিকে ধাবমান এবং সমাধিতে স্থিত থাকে। সমাধিস্থ ব্যক্তিই যথাযথ জ্ঞাত হন


সমাধির শ্রেণিবিভাগ :

দুই প্রকার সমাধির ১ম পর্যায়:

লোকত্তর সমাধি: আর্যমার্গ সমাধি হলো লোকত্তর সমাধি। লোকত্তর সমাধিতে দোষ নিশ্রিত থাকেনা। লৌকিক সমাধি: অন্যান্য সমাধিকে লৌকিক সমাধি বলে।লৌকিক সমাধিতে দোষ নিশ্রিত থাকে


দুই প্রকার সমাধির ২য় পর্যায় :

মিথ্যা সমাধি: চিত্তের অকুশল একাগ্রতার নামই মিথ্যা সমাধি

সত্য সমাধি: কুশল একাগ্রতার নাম সম্যক/সত্য সমাধি


তিন প্রকার সমাধির ১ম পর্যায় :

সবিতর্ক সবিচার সমাধি: ১ম ধ্যানই হচ্ছে সবিতর্ক সবিচার সমাধি

অবিতর্ক সবিচার মাত্র সমাধি: ২য় ধ্যানে বিতর্ক নাই কিন্তু বিচার মাত্র বিদ্যমান। অবিতর্ক অবিচার সমাধি: অন্যান্য ধ্যানে বিতর্ক বা বিচার কোনোটাই নাই


তিন প্রকার সমাধির ২য় পর্যায় :

প্রীতির সাথে উৎপন্ন সমাধি: উৎপন্ন ১ম ২য় ধ্যানই প্রীতির সাথে উৎপন্ন সমাধি

সুখের সাথে উৎপন্ন সমাধি: ৩য় ধ্যানই সুখের সাথে উৎপন্ন সমাধি

উপেক্ষার সাথে সমাধি: ৪র্থ ধ্যানই উপেক্ষার সাথে সমাধি।:


তিন প্রকার সমাধির ৩য় পর্যায়:

কুশল সমাধি: আর্য মার্গলাভী শৈক্ষ্য পৃথকজন ভিক্ষু আচরিত রূপ অরুপ লোকের সমাধিকে কুশল সমাধি বলে

কুশল বিপাক সমাধি: রূপ অরুপ লোকে আর্যফলে প্রতিষ্ঠিত শৈক্ষ্য এবং রূপ অরুপ লোকে পৃথকজন ভিক্ষু অনুশীলিত সমাধিকে কুশল বিপাক সমাধি বলে

সম্যক সমাধি: অশৈক্ষ্য(অর্হৎ) ভিক্ষু আচরিত রূপ অরুপ লোকের সমাধিকে সম্যক সমাধি বলে


৪র্থ প্রকার সমাধির ১ম পর্যায় :

কামাবচর সমাধি: প্রতিপক্ সাহায্য পঞ্চ নীবরনের প্রত্যেক অপসারণ ইহার সংরক্ষণকে কামাবচর সমাধি বলে

রুপাবচর সমাধি: চারি ধ্যানকে রূপ লোকে সমাধি বলে

অরুপাবচর সমাধি: চারি অরুপ লোকের ধ্যান কর্মের ফলকে অরুপাবচর সমাধি বলে

অপস্যাপন্ন সমাধি: চারি মার্গ চারি ফলের সমাধিকে অপসাপন্ন সমাদি বলে


৪র্থ প্রকার সমাধির ২য় পর্যায়
  • স্থুলবুদ্ধি সাধকের দুঃখ পতি 
  • তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সাধকের দুঃখ পদ্ধতি 
  • তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সাধকের সুখ পদ্ধতি 
  • স্থুলবুদ্ধি সাধকের সুখ পদ্ধতি

৪র্থ প্রকার সমাধির ৩য় পর্যায় :

সসীম আরম্মনে সসীম সমাধি:যে সমাধি দুর্বল আরম্মনের সাথে চিত্তের সমতা রক্ষা করতে পারেনা তাকে সসীম আরম্মনে সসীম সমাধি বলে

অপ্রমেয় আরম্মনে সসীম সমাধি : যে সমাধি সবল আরম্মনের সাথে চিত্তের সমতা রক্ষা করতে পারেনা তাকে অপ্রমেয় আরম্মনে সসীম সমাধি বলে

সসীম আরম্মনে অপ্রমেয় সমাধি : যে সমাধি দুর্বর আরম্মনের সাথে চিত্তের সমতা রক্ষা করতে পারে তাকে সসীম আরম্মনে অপ্রমেয় সমাধি বলে

অপ্রমেয় আরম্মনে অপ্রমেয় সমাধি: যে সমাধি সবর আরম্মনের সাথে চিত্তের সমতা রক্ষা করতে পারে তাকে অপ্রমেয় আরম্মনে অপ্রমেয় সমাধি বলে

৪র্থ প্রকার সমাধির ৪র্থ পর্যায়:

  1.  ছন্দ সমাদি
  2. বির্য সমাধি
  3. চিত্ত সমাধি
  4. বিচার সমাধি

চার প্রকার সমাধির ৫ম পর্যায়:

  1.  যে সমাধি বুদ্ধ লাভ করে কিন্তু শ্রাবক লাভ করে না, এরুপ সমাধি 
  2.  যে সমাধি শ্রাবক লাভ করে কিন্তু বুদ্ধ লাভ করে না, এরুপ সমাধি 
  3. যে সমাধি বুদ্ধ শ্রাবক উভয়ই লাভ করতে পারে, এরুপ সমাধি 
  4. যে সমাধি বুদ্ধ শ্রাবক উভয়ই লাভ করতে পারেনা,এরুপ সমাধি


চার প্রকার সমাধির ৬ষ্ঠ পর্যায়:

  1. উৎপত্তির হেতু কিন্তু নিরোধের হেতু নহে-এরুপ সমাধি 
  2. নিরোধের হেতু কিন্তু উৎপত্তির হেতু নহে-এরুপ সমাধি 
  3. উৎপত্তি নিরোধ উভয়ের হেতু-এরুপ সমাধি
  4. উৎপত্তি কিংবা নিরোধ কোনটিরই হেতু নহে-এরুপ সমাধি


চার প্রকার সমাধির ৭ম পর্যায় :

  1. প্রথম ধ্যান
  2. দ্বিতীয় ধ্যান
  3. তৃতীয় ধ্যান
  4. চতুর্থ ধ্যান


পাঁচ প্রকার সমাধির ১ম পর্যায়:

/প্রথম ধ্যান: বিতর্ক, বিচার,প্রীতি,সুখ একাগ্রতা দ্বারা পঞ্চ নিবারন বিনাশ করার নাম হলো প্রথম ধ্যান। 

/দ্বিতীয় ধ্যান: বিতর্কের বিনাশের নাম হলো দ্বিতীয় ধ্যান

/তৃতীয় ধ্যান:বিতর্ক বিনাশের নাম হলো তৃতীয় ধ্যান

/চতুর্থ ধ্যান:বিতর্ক,বিচার প্রতির বিনাশের নাম হলো চতুর্থ ধ্যান

/পঞ্চম ধ্যান:বিতর্ক, বিচার,প্রীতি সুখের বিনাশের নাম হলো পঞ্চম ধ্যান


সমাধির গুরুত্ব:

বিশুদ্ধমার্গ গ্রন্থের অন্যতম প্রধান অধ্যায় হচ্ছে সমাধি। অধ্যায়ে বুদ্ধঘোষ উল্লেখ করেছেন যে,কুশলচিত্তে একাগ্রতাই সমাধি।একাগ্রতা,স্থিরতা,অবিক্ষিপ্ততা সমাধির লক্ষণ।বিক্ষিপ্তকে বিধ্বংসই এর রুপ,প্রকম্পস এর প্রত্যুপস্থান।অপরদিকে উপাচার অর্পনা, লৌকিক লোকত্তর,হীন-মধ্যম প্রনীত এরুপ প্রকার পর্যায় বশে সমাধি ব্যাপন বহুবিধ।


সমাধি নিদ্দেশে বলা হয়েছে যে, প্রথমে কর্মস্থান প্রদানকারী কল্যাণমিত্ৰ অর্থাৎ বুদ্ধ পরবর্তী মহাশ্রাবক, তাদের না পেলে প্রতিসম্ভিদা প্রাপ্ত ত্রিপিটক ধর্ম অর্হৎ ভিক্ষু তাদের পাওয়া না গেলে পর্যাটক্রমে ত্রিপিটিকধর অর্হৎ, স্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী,অনাগামী প্রয়োজনে বিনয়ধর ভিক্ষুর নিকট গমনপূর্বক নিজের স্বভাব অনুরুপ অর্থাৎ রাগচরিত,দ্বেষচরিত, মোহচরিত শ্রদ্ধাচরিত,বুদ্ধচরিত বিতর্কচরিত কর্মস্থান গ্রহণ করবেন।


অতঃপর যৌগী নিরুপদ্রব,অন্তরায়হীন,অভয়ারণ্য স্থানে গমনপূর্বক কর্মস্থান বা সমাধি অনুশীলন করবেন।আচার্য বুদ্ধঘোষ সমাধি নিদ্দেসে চল্লিশ প্রকার কর্মস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন।এদের মধ্যে কৃৎস্ন ভাবনা দশ প্রকার,ব্রহ্মবিহার ভাবনা চার প্রকার, অরুপ ভাবনা চার প্রকারএকপ্রকার সংজ্ঞা  এক ব্যবস্থান ভাবনা বা কর্মসংস্থান তা থেকে যে কোন এক প্রকার কর্মসংস্থান ভাবনা অনুশীলন করলেই যোগী সমষ্টি দ্বারা যা লভ্য তা লাভ করতে সক্ষম হন আচার্য বুদ্ধঘোষ আরো উল্লেখ করেন যে,যোগী যদি সমাধির সর্ব্বোচ্চ স্তরে উপনীত হন তাহলে তিনি পঞ্চভিজ্ঞতা অর্থাৎ দিব্য চক্ষু,দিব্য কর্ণ,বিবিধ ঋদ্ধিজ্ঞান,জাতিস্মর জ্ঞান এবং পরচিত্ত বিজনন জ্ঞান সহ অষ্টসমাপত্তি ফল লাভ করেন

 এই অষ্টসমাপত্তি ফল হলোপ্রথম ধ্যানদ্বিতীয় ধ্যানতৃতীয় ধ্যানচতুর্থ ধ্যান এবং চারি প্রকার অরুপ ধ্যান,নিরন্তর অভ্যাসের ফলে মন বা চিত্ত ধীরে ধীরে ধ্যান বিষয়ে নিবিষ্ট বা একাগ্র হয়

জগত দুঃখময় দুঃখে পরিপূর্ণ।সংসারের সবকিছু পরিবর্তনশীল।কোন কিছুই নিত্য নই। এই পরিবর্তনশীলতাকে বজায় রেখে মানব মনের বা চিত্তের যে পরিবর্তনের সন্নিবেশ তা আমাদের নিয়ত কার্যক্রমের উপর প্রভাব বজায় রাখে। 


এতে অনেক সময় দেখা যায় যে, মানুষ সেই প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে অকুশল কাজকে প্রাধান্য দিয়ে নিয়ত দুঃখে পরিপূর্ণ অজ্ঞানতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর তাই তথাগত ভগবান বুদ্ধ সেই অজ্ঞানতা অকুশল কাজ থেকে নিজের দেহ মনকে কুশলাবস্থায় বজায় রাখতে সমাধির প্রয়োজনীয়তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার জন্য নির্দেম দিয়েছেন।


যার মাধ্যমে মানুষ নিজের চিত্তকে ক্রমাগত কুশল কাজের দিকে ধাবিত করে জগৎ দুঃখে থেকে মুক্তির সন্ধান দেখায়। আর এজন্য তথাগত গৌতম বুদ্ধ প্রদত্ত চতুরার্যসত্য, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছেন।আর এসব নীতি অবলম্বন করতে গেলে সবচেয়ে যেটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে সমাধি।তাই মানব জীবনে সমাধির গুরুত্ব অপরিসীম


উপসংহার :

উপরে উল্লেখিত বিষয়ের আলোকে আমরা উল্লেখ করতে পারি যে আচার্য বুদ্ধঘোষের রচিত বৌদ্ধ ধর্মীয় উপাদেয় গ্রন্থ বিশুদ্ধমার্গ এক অনন্য অবদান যা মানব সমাজ তথা বৌদ্ধ মানব সভ্যতাকে করেছে পরিপূর্ণ

 

 

 


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!