বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বলতে কি বোঝা। মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা আলোচনা কর।

admin


ভূমিকা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের শুধু চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকারীই নয়, সে নিজেকে সংবিধানের অপ্রতিদ্বনী অভিভাবকে পরিণত করেছে। শুধু তাই নয়, বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আদালতে পরিণত করেছে।


বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বলতে কি বোঝা। মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা আলোচনা কর।


বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা : বিচার বিভাগ কর্তৃক আইনসভায় ও শাসন বিভাগের কার্যক্রমের সাংবিধানিক যাচাইয়ের নামই হলো বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা। মূলত বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বলতে সে পদ্ধতিকে বুঝায়, যার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট কংগ্রেস বা অঙ্গরাজ্যের আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন এবং শাসন বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ ও নির্দেশের সাংবিধানিক বৈধতা বিচার করে বা নির্ধারণ করে। ঐ আইন বা নির্দেশ সংবিধান বিরোধী মনে হলে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করতে পারে।


বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা সম্পর্কে ডিমোক ও ডিমোক (Dimock and Dimock) বলেন, “বিচারের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে আনীত কোন বিশেষ মামলা পরিচালনাকালে সুপ্রিম কোর্ট প্রয়োজন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদান ও বিরোধীয় বিষয়বস্তু পরীক্ষা করে কোন বিশেষ আইন বা শাসন বিভাগের কোন নির্দেশকে সংবিধান অবৈধ করতে পারে।"


বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা সম্পর্কে Robert D. Canton বলেছেন, "Judicial review is the authority of the Supreme Courts to determine whether legislative and executive acts are constitutional judicial review is a check on the power of the executive and legislative branches of government."


এভাবে সুপ্রিম কোর্ট যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র ব্যাখ্যা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোন বিশেষ আইন বা শাসনব্যবস্থা সংক্রান্ত আড্ডা বা আদেশ শাসনতান্ত্রিক নিয়মানুসারে অবৈধ কি না তা ঘোষণা করে থাকে। অর্থাৎ বিচার বিভাগ সংবিধান ব্যাখ্যা করে কোন আইন বা প্রশাসনিক বিধিবিধানের সাংবিধানিক বৈধতা বিচার করার যে ক্ষমতা ভোগ করে তাকেই বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা বলে ।


বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা মার্কিন সুপ্রিম কোর্টকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আদালতে পরিণত করেছে- উদ্ভিন্ন ব্যাখ্যা নিম্নে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা যে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আদালতে পরিণত করেছে তা আলোচনা করা হলো :


১. সংবিধানের গতিশীলতা রক্ষা : সংবিধানের পতিশীলতা রক্ষার মাধ্যমে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আদালতে পরিণত করেছে। আইন ও সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের নমনীয়তা বজায় রাখে। পরিবর্তিত আর্থিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে সুপ্রিম কোর্ট মার্কিন সংবিধানকে নমনীয় ও গতিশীল করে তুলেছে। সংবিধানের পরিবর্তন পদ্ধতির তথ্যগত জটিলতা * সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতার একটি  অন্যতম কারণ।


২. সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যাই হলো সংবিধান : সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী।  সুপ্রিম কোর্ট হলো মার্কিন সংবিধানের অভিভাবক ও চরম ব্যাখ্যাকারক। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের যে ব্যাখ্যা দেয় তা চূড়ান্ত এবং সে ব্যাখ্যা গ্রহণ সর্বজনীনভাবে বাধ্যতামূলক। সুতরাং এদিক থেকেও বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা মার্কিন সুপ্রিম কোর্টকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আদালতে পরিণত করেছে।


আরো দেখুন : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কীভাবে রক্ষা করা যায় আলোচনা কর।


৩. নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি : সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার মাধ্যমে নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আদালত কংগ্রেসের আইনকে অবৈধ ঘোষণা করে ইতিবাচক ও কল্যাণমূলক ব্যবস্থার পথ উন্মুক্ত করে। বিদ্যালয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নিগ্রোদের নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে আদালত বিচার বিভাগীয় | পর্যালোচনার ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে।


৪. শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ : মার্কিন শাসন বিভাগকে সুপ্রিম কোর্ট তার বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা দ্বারা শাসন বিভাগের যে কোন আদেশ নির্দেশ সংবিধান পরিপন্থী। হলে তা বাতিল করতে পারে। এদিক দিয়ে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা মার্কিন সুপ্রিম কোর্টকে অন্যতম শক্তিশালী আদালতে পরিণত করেছে।


৫. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ : গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আইন ও শাসন বিভাগের স্বেচ্ছাচারিতা থেকে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনাই কেবল নাগরিকদের রক্ষা করতে পারে। নাগরিকদের রক্ষা করার মাধ্যমে এর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয়ে উঠে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা মার্কিন সুপ্রিম কোর্টকে অন্যতম শক্তিশালী আদালতে পরিণত করেছে।


সংবিধান পরিবর্তন ও পরিবর্ধন বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা সংবিধানকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করেছে। সুতরাং সংবিধান পরিবর্তন ও পরিবর্ধনে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।


৭. কেন্দ্রীয় ও অঙ্গরাজ্য সরকারের মধ্যে সমন্বয় সাধন : বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ও অঙ্গরাজ্য সরকারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতে ফৌজদারি মামলায় বিবাদিদের জন্য "বিল অব রাইটসে' সে অধিকার দেয়া হয়েছে। এভাবে কেন্দ্রীয় ও অঙ্গরাজ্যের সরকারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা মার্কিন সুপ্রিম কোর্টকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী আদালতে পরিণত করেছে।


৮. বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদালতের সাথে তুলনা : বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিচার বিভাগ বর্তমানে অনেক বেশি ক্ষমতা ভোগ করছে। তবে অন্যান্য দেশের বিচার বিভাগ অনেক বেশি ক্ষমতা ভোগ করলেও মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের মত তাদের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ক্ষমতা নেই। এদিক থেকে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা মার্কিন সুপ্রিম কোর্টকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী আদালতে পরিণত করেছে। নিম্নে কতিপয় দেশের আদালতের সাথে এর তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপন করা হলো :


ক. ফ্রান্সের আদালত : ফ্রান্সের বিচার বিভাগ উচ্চতর পরিষদ গঠন বিচারকদের নিয়োগ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। সরকারের অন্য দু'টি বিভাগের প্রভাবমুক্ত থেকে ফ্রান্সের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। এছাড়া বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে প্রেসিডেন্টের শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে ফ্রান্সের উচ্চ আদালত। কিন্তু ফ্রান্সের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইন ও শাসন বিভাগীয় নির্দেশকে সংবিধান বিরোধী বলে বাতিল করতে পারে না এবং ফ্রান্সের আদালত সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যা করতে পারে না। তবে মার্কিন আদালতের এ ক্ষমতা রয়েছে। এদিক থেকে মার্কিন আদালত ফ্রান্সের আদালতের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।


খ. ব্রিটেনের আদালত : ব্রিটেনের বিচার বিভাগ ও বিচারকরা পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে। ব্রিটেনের আদালত নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করে। এখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত এবং আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। কিন্তু ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনের বৈধতা বিচার করতে পারে না। সুতরাং বলা যায়, মার্কিন আদালত ব্রিটেনের আদালতের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।


গ. সুইজারল্যান্ডের আদালত : সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় ট্রাইব্যুনাল হলো সুইজারল্যান্ডের আদালতের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালত। সুইজারল্যান্ডের সংবিধান এবং আইনের ব্যাখ্যা করায় ক্ষমতার অধিকারী হলো সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা। সুইজারল্যান্ডের সর্বোচ্চ আদালত সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় ট্রাইব্যুনাল সংবিধান ব্যাখ্যা করতে পারে না। এছাড়া আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনকে সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় ট্রাইব্যুনাল অবৈধ ঘোষণা করতে পারে না। সুতরাং মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের মত সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় ট্রাইব্যুনাল প্রতার প্রতিপত্তি ও মর্যাদার অধিকারী হতে পারে নি। সুতরাং সুইজারল্যান্ডের আদালতের তুলনায় মার্কিন আদালত অনেক বেশি শক্তিশালী একথা নির্দ্বিদায় বলা যায়।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা মার্কিন সুপ্রিম কোর্টকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী আদালতে পরিণত করেছে। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট কংগ্রেস ও রাজ্য আইনসভা প্রণীত আইন এবং শাসন বিভাগের আদেশ সংবিধান বিরোধী হলে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট মার্কিন জাতির সর্বোচ্চ আদালত। মার্কিন বিচার বিভাগীয় কাঠামো পিরামিডের মত। আর সুপ্রিম কোর্ট এর শীর্ষদেশে অবস্থিত। সুতরাং সকল আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা দ্বারা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আদালতে পরিণত হয়েছে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!