ভূমিকা : চীনের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক কনফুসিয়াস। ৫৬১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে লু প্রদেশের চুক্ষু নগরে তার জন্ম। কর্মজীবনে তিনি শস্যগোলার সহকারী পদে নিযুক্ত ছিলেন। উনসত্তর বছর বয়সে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং শাসন বিষয়ে নানান উপদেশ দান করেন।
কনফুসিয়াসের মতবাদ :
নিম্নে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের বিভিন্ন দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. শিক্ষা দর্শন : একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের জীবনে শান্তি ও সফলতার চাবিকাঠি হচ্ছে তার জ্ঞান এবং জ্ঞানার্জন করা যায় নিরবচ্ছিন সাধনা দ্বারা। তাঁর মতে, যে সত্য সন্ধানী শিক্ষার্থী মলিন বসন পরিধান কিংবা মন্দ আহার গ্রহণে লজ্জাবোধ করে তার জন্য শিক্ষা অপ্রয়োজনীয়। কনফুসিয়াসের শিক্ষায়তনের শিক্ষার বিষয় ছিল তিনটি-ইতিহাস, পদ্য ও ব্যবহারিক সৌজন্য বা শালীনতার নিয়ামাবলি। কনফুসিয়ালের ছাত্রের সংখ্যা অল্প হলেও তাঁর শিক্ষার প্রভাব সুদূর প্রসারী। জীবিতকালের চেয়ে মৃত্যুর পর তার শিষ্য সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
২. নৈতিক দর্শন : কনফুসিয়াসের দর্শনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজকেন্দ্রিক সুখী-সমৃদ্ধ জীবনব্যবস্থা। নৈতিক দিক থেকে কনফুসিয়াস মানুষে মানুষে সহানুভূতি এবং আদান-প্রদানের ওপর আস্থাশীল ছিলেন। অনুগত পরম ধর্ম, কিন্তু নৈতিক বিধানের নির্দেশ পালন অনুগত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর। নীতি সম্বন্ধে পুত্র পিতাকে বিনীতভাবে উপদেশ দিবে। তাঁর চিন্তাধারা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তৎকালীন সমাজ ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের রাজনীতি ও নৈতিক দিক আলোকপাত করে। কনফুসিয়াস কোনো নতুন তত্ত্ব প্রচারের দাবি করেননি। বলেছেন, “আমি নতুন কিছু সৃষ্টি করিনি, প্রাচীন জ্ঞানকে প্রসারিত করেছি মাত্র।" তার নীতিতে স্বর্গীয় আদর্শ বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছেন।
৩. রাজনৈতিক মতবাদ : কনফুসিয়াসের মতে, রাষ্ট্র একটি প্রাকৃতিক প্রতিষ্ঠান, কিন্তু মানুষ একে পরিবর্তন করতে পারে। রাষ্ট্র মানুষের জন্য, কিন্তু মানুষ রাষ্ট্রের জন্য নয়। তাঁর মতে, রাজাকে আদর্শ গুণাবলির অধিকারী হতে হবে এবং রাজা প্রতিভাবান পণ্ডিতদের মধ্যে থেকে যোগ্যতম প্রার্থীদের নিয়োগের মাধ্যমে শাসন কাজ পরিচালনা করবে। শাসনকর্তা শুধু আদেশই দিবেন না বরং চরিত্র গঠনে জনগণের আদর্শ হবেন। রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য জনগণের অবস্থার উন্নতি করা এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানো। কনফুসিয়াস কেন্দ্রীয় শক্তিতে সামন্তবাদের প্রত্যাবর্তনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন, তবে তা অবশ্যই বুদ্ধিবৃত্তির যাচাই সাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে।
৩. সামাজিক মতবাদ : সমাজকে উন্নত করার লক্ষ্যে দুর্নীতি, বিভিন্ন আচার প্রভৃতি সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য। তিনি বিভিন্ন সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং প্রকাশ করেন। সুন্দর সমাজ নির্মাণের জন্য পারস্পরিক দরদ, সহানুভূতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে সুশীল সমাজ গঠনের উপদেশ দেন। তিনি বলেন, স্বর্গ যেমন বিশ্বব্রহ্মানে কেন্দ্রবিন্দু, তেমনি পিতা হলো পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, বিশ্ব নাগরিক হওয়ার পূর্বে নিজের সমাজের উপকারের দিকে জোর দিতে হবে।
৫. ধর্মীয় মতবাদ : ধর্ম সম্পর্কে কনফুসিয়াস বিশেষ চিন্তা না করলেও তিনি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকে সম্মান প্রদর্শন করেন। কনফুসিয়াস প্রাচীন ধর্মানুষ্ঠান বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলেন, পূর্ব পুরুষের প্রতি যেমন সকলের কর্তব্য আছে তেমনি জগদ্বীশ্বরের প্রতি রাজার কর্তব্য আছে। তিনি পরমেশ্বরকে স্বর্গ নামে উল্লেখ করেন এবং ঈশ্বরকে নৈতিক শক্তিরূপে ধারণা করেন। আত্মা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে বলেন, যতোদিন পর্যন্ত তুমি মানুষকে সেবা করতে না পারবে ততোদিন পর্যন্ত কেমন করে আত্মার সেবা করবে। পরজীবন সম্পর্কে তিনি বলেন, "যতোদিন পর্যন্ত আমরা জীবন সম্পর্কে না জানব ততোদিন পর্যন্ত কেমন করে মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পারব।
৬. পারিবারিক মতবাদ : কনফুসিয়াস পারিবারিক মতবাদ দিতে গিয়ে বলেন, সমাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের অঙ্গ। আর পরিবার হলো সমাজব্যবস্থার ভিত্তি। তিনি পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের পক্ষপাতী ছিলেন।
৭. সামাজিক সম্পর্ক : কনফুসিয়াস সামাজিক জীবনে পাঁচটি সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন, একেই পৃষ্ঠ সম্পর্ক বলা হয়। (১) রাজা-প্রজা সম্বন্ধ (২) পিতা-পুত্ৰ সম্বন্ধ (৩) স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধ (৪) অগ্রজ অনুজ সম্বন্ধ (৫) বন্ধু-বন্ধু সমত এ সম্বন্ধ পঞ্চকের আদর্শকে সংযম ও সদাচারের নৈতিক বিধান দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত করেন কনফুসিয়াস।
৮. জ্ঞানার্জন সম্পর্কিত মতবাদ : কনফুসিয়াসের মতে, জ্ঞানই হলো সকল সফলতার চাবিকাঠি এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি দ্বারা সকল জ্ঞানার্জন করা যায়। তার মতে, জ্ঞান ছাড়া কুসংস্কার দূর হবে না। একটি প্রদীপের আলো যেমন পৃথিবীর অন্ধকার গ্রাস করতে পারে না। তেমনি জ্ঞানীকে কুসংস্কার, দুর্নীতি ও অন্যায় গ্রাস করতে পারে না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, চীন সভ্যতাকে পথপ্রদর্শন বিশেষ গুণগত উৎকর্ষতা প্রদান করা প্রভৃতি বিচারে কনফুসিয়াস যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন। তার শিক্ষা ক্রমান্বয়ে চীন ও পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে বিস্তার লাভ করে এক ধরনের দর্শন ধর্মে রূপ নেয়।