ভূমিকা : হাতিয়ার ও দক্ষ মানব সংস্কৃতির অন্যতম পরিচায়ক। প্রস্তুর যুগে মানুষ প্রধানত প্রকৃতি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতো একই সাথে তারা দলবদ্ধভাবে বসবাস করতো, তবে এই প্রস্তর যুগেই মানুষ পশু শিকারের জন্য পাথরের ব্যবহার রপ্ত করে। তারা পাথর দিয়ে যেসব হাতিয়ার বানাতো তার মধ্যে অন্যতম ছিল হাত কুড়াল, শাঁস ও কর্তন হাতিয়ার। তবে মধ্য ও উচ্চতর প্রাচীন প্রস্তর যুগে এগুলোর উদ্ভব ও আবিষ্কারের সাথে ব্যাপকভাবে ব্যবহার বেড়ে যায়।
মধ্য প্রস্তর যুগের জীবন প্রণালি : মধ্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি শুরু হয় তৃতীয় আন্তঃ তুষার যুগের প্রথমে। প্রধান হিমবাহ উল্লেখযোগ্য অগ্রসর না হওয়া পর্যন্ত এ সংস্কৃতি বর্তমান ছিল। ইউরোপের আদিম যুগ শেষ হবার সাথে সাথে এ যুগের সূচনা হয় । নিম্নে এ যুগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১. সংস্কৃতি : এ যুগের প্রধান সংস্কৃতি ছিল মোস্তেরীয় সংস্কৃতি। এ যুগের সংস্কৃতির প্রথম বিকাশ হচ্ছে আগুনের ব্যবহার। দীর্ঘকালে অবিরতভাবে গুহার অধিকারের উদ্দেশ্যমূলক কবর, হলুদ রং, লাল রং মৃত দেহ লেপোন প্রভৃতি স্থানীয় খাদ্যের উপর অধিক গুরুত্বারোপ এ যুগের সংস্কৃতির প্রধান বিকাশ। এ যুগে প্রধান তিনটি সংস্কৃতি লক্ষ করা যায়।
১. মোন্তেরীয়,
২. পেরিগোড়,
৩. লোডালৌহসীয় ।
২. হাতিয়ার : এ সময় হাতিয়ারের সংস্কৃতিক সাধারণত উল্লেখ করা হয় মোন্তেরীয় সংস্কৃতি হিসেবে। মোস্তেরীয় যুগে চকমকি পাথরের হাতিয়ারগুলো অন্যান্য হাতিয়ারগুলোর থেকে স্বতন্ত্র ছিল। এরা ছোট আকারের চকমকি পাথর থেকে আলাদা করে হাতিয়ার তৈরি করতে পারতো। এরা পাথরের প্রান্ত থেকে ছোট ছোট কুঁচি পাথর সরিয়ে ফেলে এক প্রান্ত পাতলা ও অন্য প্রান্ত ধারালো করতো। নিয়ান্ডার্থাল মানুষেরা শিকারের জন্য বর্ণা ও বল্লমের ব্যবহার করতো।
৩. প্রাকৃতিক পরিবেশ : ওর্ম ও শেষ প্লাইস্টোসিস তুষার যুগের বরফ অগ্রসর হওয়ার সময় মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। এসব গুহা থেকে পরবর্তীকালে হাড়ের সন্ধান পাওয়া যায়। আজকাল ইউরোপে যে রকম জলবায়ু বর্তমান তৃতীয় আন্তঃ তুষার যুগ বা আদি ওর্ম যুগের তুলনায় অধিক প্রবল ছিল।
৪. খাদ্যাভ্যাস : এ যুগের মানুষ ফলমূল আহরণের সাথে উন্নত মাত্রায় শিকারি ছিল। এ সময়ে ইউরোপে বলগা হরিণ, মেরু শৃগাল, মেরু খরখোশ, ঘোড়া, লোমশ পান্ডার প্রভৃতি তৃণভোজী পশু শিকার এবং ভল্লুক, সিংহ, চিতা বাঘ ও নেকড়ে পাওয়া যেত। যা থেকে তারা নিরামিষের সাথে আমিষ ভোজন করতে পারত। তাদের সবচেয়ে সাফল্যের ব্যবহার হলো- এ সময় তারা যে-কোনো খাবার ঝলসে খেতে পারত।
৫. মানবজাতির উপস্থিতি : এ যুগে নিয়ান্ডাথাল মানুষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। ঐ অঞ্চলের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সামর্থ্য হওয়া নিয়ান্ডায়াল মানুষেরা আগুনের গুহার মধ্যে বসবাস করত। আগুনের ব্যবহারের মাধ্যমে তারা নিজের শরীরকে উষ্ণ বা ধর্ম রাখতো। এর সাথে লোমযুক্ত পশুর চামড়া দিয়ে শীত নিবারণ করতো।
৬. ধর্ম : উপস্থিত বস্তু, নিদর্শন, খবর থেকে বোঝা যায় এ যুগের মানুষের মধ্যে ধর্ম প্রচলন ছিল। এ সময়ের সমাজ জীবন পূর্ববর্তীদের চেয়ে উন্নত ছিল। তাদের টোটেন নামে যে ধর্ম বিশ্বাস চালু হয় তার বিধি-নিষেধ ট্যাবু নামে পরিচিত ছিল।
৭. ভাষা : শ্রেষ্ঠতম গুণাবলি ও আবিষ্কারে ভাষা, প্রয়োজনে মান ভাব প্রকাশে প্রথমে চিত্র ব্যবহার করত। চিত্র ছিল একটি ভাষা। পরবর্তী সময়ে তারা ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠ স্বরের মাধ্যমে ভাষার উদ্ভব ঘটায়।
উচ্চতর প্রাচীন প্রস্তর যুগ :
উচ্চতর প্রাচীন প্রস্তর যুগের সময়কাল ছিল ৪০ হাজার থেকে ৯ হাজার খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। মাত্র ৩১ হাজার বছর স্থায়ী হওয়া সত্ত্বেও প্রাচীন প্রস্তর যুগে দ্রুত সমাজ ও বাস্তবতায় পরিবর্তন দেখা যায়। এ যুগের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবন প্রণালি আলোচনা করা হলো :
১. সংস্কৃতি : উচ্চতর প্রাচীন প্রস্তর যুগে ইউরোপে ৫টি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায় ।
১. আদি পেরিলোডীয়;
২. আন্তঃ পেরিলোডীয়;
৩. অরিগনেসীয় সংস্কৃতি;
৪. সলুট্রীয় ও
৫. ম্যাগডালেনীয়
২. বাসস্থান : উচ্চ প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষ শীতের প্রকোপ ও হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য গুহায় বসবাস করত। তবে তারা কোনো ঘর-বাড়ি তৈরি করেনি। তারা চুনাপাথরের পাহাড় কেটে গুহা বানিয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করত।
৩. খাদ্যাভাস : এ যুগের মানুষ অত্যন্ত দক্ষ শিকারি ছিল। তারা দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন জাতের বন্য পশু বধ করতো। তবে অন্যান্য যুগের চেয়ে তারা হাতিয়ারের পাশাপাশি উন্নত মানের কৌশল অবলম্বন করতে জানতো। তারা হাতি, ঘোড়া, শৃগাল, খোরগোস, বনমোরগ, হাঁস, পাখিসহ ফল ও তৃণভোজী আহার করতো।
৪. তাদের পোশাক পরিচ্ছেদ : এ যুগের মানুষ চামড়ার পোশাক পরিধান করতো। এ সময় কাপড়ের প্রচলন না থাকায় তারা চামড়াগুলো গায়ের মাপে কেটে তা সেলাই করে লজ্জা ও শীত নিবারণ করতো। এ ছাড়াও তারা চামড় সেলাইয়ে হাড়ের সুচ ও গাছের শক্ত বাকল ব্যবহার করত। এভাবে তারা তাদের পোশাকের চাহিদা নিবারণ করতো।
৫. ধর্ম : প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষ অলৌকিক শক্তি, যাদুবিদ্যা, ভৌতিক ক্রিয়াকলাপের প্রতি বিশ্বাসী ছিল। তারা মুত ব্যক্তি সৎকারের ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নবান ছিল। তারা মৃত ব্যক্তিকে কবরে দেবার সময় তার ব্যবহৃত দ্রব্য-সামগ্রী ও কবরে দিয়ে দিত।
৬. হাতিয়ার : এ যুগে মানুষ অন্যান্য যুগ থেকেও পাথরকে নিপুণভাবে কেটে অস্ত্র বা হাতিয়ার তৈরি করতো। তারা ছিদ্র করার ছাঁচালে পাথর, বর্শা, কর্ষণযন্ত্র, তীর ইত্যাদি ব্যবহার করত। এছাড়াও তারা জীবজন্তুর শিং ও হাড় দিয়ে মসৃণ সব হাতিয়ার বানাতে সক্ষম ছিল। হাড় দিয়ে তারা বিশেষত সূচ তৈরি করতে পারত।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষ তার নিজের আহার সংগ্রহের প্রয়োজনে দূর দূরান্তে ছুটে চলতো। এ সময় মানুষের খাদ্য সংগ্রহ ও জীবনধারণ ছিল প্রধান কর্ম। অর্থাৎ, তখন মানুষের জীবন ছিল টিকে থাকার সংগ্রাম। ফলে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে ও হিংস্র জন্তুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে এবং খাদ্য সংগ্রহের জন্য নানা প্রকার পন্থা ও কৌশল অবলম্বন করে। খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তাদের মধ্যে বিকাশ লাভ করে হাতিয়ার, বাসস্থান, পোশাক, পরিচ্ছেদসহ অন্যান্য জিনিসের।